ব্রেকিং নিউজ
Home - জাতীয় - কিভাবে এলো জয় বাংলা স্লোগান।

কিভাবে এলো জয় বাংলা স্লোগান।

মো: রাসেল সবুজঃ জয় বাংলা বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার ন্যায় সংগত দাবী দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলনকে ধাপে ধাপে বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরের মূল শ্লোগান। আসলে জয় বাংলা শুধুই শ্লোগান নয়, “জয়বাংলা” বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শানিত অস্ত্র, জয় বাংলা একটি দর্শন।

“১৯৬৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাবি ক্যাম্পাসে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের উদ্যোগে শিক্ষা দিবসের আলোচনা সভা চলছিল। সভা চলাকালীন অনেকটা হটাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিলেন ছাত্রলীগ ও নিউক্লিয়াসের সদস্য আফতাব উদ্দিন আহমেদ, পরক্ষনেই সেই শ্লোগানের রিপ্লাই দিলেন চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। এরপরে কিছুক্ষণ ঐ শ্লোগান চললো। সেটাই এই বাংলার বুকে প্রথম জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করা।
যদিও এর আগেই “স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস” এর অধীনে একটি হাতে লেখা তিন পেইজের পত্রিকা বের হতে থাকে, যার নাম ছিল “জয় বাংলা”। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারী ছাত্রলীগের ২২ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর কর্মসূচী ছিল রমনা বটমূলে সভা ও সেখান থেকে র্যালী। সেই সভায় প্রধান অতিথি ও সভাপতি ছিলেন যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ন্যাপের মোজাফ্ফর আহমেদ। প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর পরে সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করা।আর এই কারণেই ব্যাপক উপস্থিতি রমনার বটমূলে। মঞ্চে বসে থাকা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পিছনে দেবদারু পাতায় ছাওয়া ব্যানারে হলুদ গাঁদা ফুল দিয়ে লেখা ছিল পাঁচটি অক্ষর “জয় বাংলা”, যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐ সমাবেশেই বক্তব্য শেষে সিরাজুল আলম খান বললেন জয় বাংলা। এতেই মুহুর্মুহু ঐ শ্লোগানে মুখরিত হয় পুরো এলাকা। এতে আওয়ামীলীগের কিছু সংখ্যক নেতা পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মীদের সাথে রাগারাগি করেন। তাঁরা জয় বাংলা শ্লোগান দেয়া ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ইত্যাদি বলে অভিহিত করেন। তারপরেও ওই শ্লোগান চলে দীর্ঘ ক্ষণ। পরে জয় বাংলা লেখা ঐ ব্যানারসহ র্যালী শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পর দিন ৫ জানুয়ারী দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর কোন কোনটিতে প্রথম পাতায় ছবিতে বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর পিছনে পরিষ্কার জয় বাংলা লেখাটা দেশবাসীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।
‘৭০এর ১১ই জানুয়ারী পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তখনকার দিনে যে কোন দলের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেই অন্যরা দল বেঁধে সেই সব সমাবেশের ভাষণ শুনতে যেতেন। সেদিনের জামাতের জনসভার এক পর্যায়ে পাকিস্তান জামাতের নেতা আবু আলা মওদুদী বক্তৃতা দিতে উঠে ছয় দফা এবং এগারো দফার আন্দোলনকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন নামে অভিহিত করে বক্তব্য রাখতে থাকেন। এতে উপস্থিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ কর্মী-সংগঠকরা মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় বেশ কিছু শ্রমিক জনতা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে শ্লোগানে তেতে উঠে পল্টন। এতে সভায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে মঞ্চের নীচে লুকানো লাঠি সোঠা বের করে জামাতের নেতা কর্মীরা জয় বাংলা শ্লোগান দেয়া ছাত্র জনতার উপরে চড়াও হয়। এতে প্রাথমিক অবস্থায় ছাত্র জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও হটাত করে সেখানে সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ায় জনতা। আশে পাশের দোকান পাট, হোটেল রেস্তোরাঁ থেকের লাঠি, চেলা কাঠ সংগ্রহ করে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই দিনের সংঘর্ষে দুই জন জামাত কর্মী নিহত এবং ৫০০ জন আহত আহত হয়। পণ্ড হয়ে যায় মওদুদীর জনসভা।
১৯৭০ এর ১৮ জানুয়ারী, রোববার পল্টন ময়দানের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের জনসভায় পুরো পল্টন জুড়ে ছিল প্রচুর জনসমাগম। একমাত্র মসজিদটি ছাড়া তখনকার আউটার স্টেডিয়ামে আর কোনো স্থাপনা ছিল না। পেছনে ডিআইটির দিকে বাস্কেটবল খেলার জন্য ছোট ছোট স্টেডিয়ামের মতো কয়েকটি স্থাপনা ছিল মাত্র। সে সময় পল্টন ময়দানে এক লক্ষের মতো লোকসমাগম হতে পারতো। তেমনই লোকে লোকারণ্য অবস্থায় সেদিনের জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়। বক্তৃতা মঞ্চটি ছিল বিশেষভাবে নির্মিত বেশ কিছুটা উঁচু। মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও গাজী গোলাম মোস্তফা ছাড়া অন্য কোন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না। তবে আওয়ামী লীগ করতেন না কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রধান কাজে সদা ব্যস্ত থাকতেন এমন একজন ব্যক্তির সেই মঞ্চে উপস্থিতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন সিরাজুল আলম খান। সভা শুরু হলে প্রথম ২/৩ জন বক্তৃতা দেয়ার পর সিরাজুল আলম খান মাইকের সামনে এলেন। এসে অত্যন্ত আবেগ মিশ্রিত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন-
“ “আজ থেকে ‘জয় বাংলা’কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের প্রতীকী স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আসুন, আমরা সবাই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলি ‘জয় বাংলা’।” তখন আকাশ থেকে বাজ পড়ার কানফাটা আওয়াজের মতো লক্ষ কণ্ঠে সমস্বরে ‘জয় বাংলা’শ্লোগানের ধ্বনিতে সারা পল্টন ময়দান মুখর হয়ে উঠে। সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণ প্রথম জানলো তাদের আগামী দিনের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। বলাই বাহুল্য, ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) এর সিদ্ধান্ত অনুসারেই একাজটি করা হয়।
উল্লেখ্য যে, সে সময় ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ‘জয় হিন্দ’ এবং ‘জিও সিন্ধ’ (জিএম সৈয়দের নেতৃত্বে সিন্ধুতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন) স্লোগান দু’টি বেশ জনপ্রিয় ছিল। এ থেকেই ‘নিউক্লিয়াস’এর তরুণ নেতারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উদ্ভাবন করেন এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকী স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়ার পর থেকে তখনকার আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা আন্দোলন বিরোধীরা ভারতের ‘জয় হিন্দ’ ও সিন্ধুর ‘জিও সিন্ধ’ এর সাথে মিশিয়ে এক ধরণের ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো। সুযোগ পেলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর চড়াও হতো। যদিও পরবর্তীতে জয় বাংলা শ্লোগানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও বিস্তারের কারণে তাঁরা এই শ্লোগান মেনে নিতে বাধ্য হন।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় বিএনপির নির্বাচন বিরোধী প্রচারপত্র বিলি

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আওয়ামীলীগের একতরফা নির্বাচন বন্ধের দাবী ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে না ...