ব্রেকিং নিউজ
Home - অন্যান্য - ধর্ম ও জীবন - শাবান মাসের মধ্য রজনী তথা শবে বরাত এর ফযিলত

শাবান মাসের মধ্য রজনী তথা শবে বরাত এর ফযিলত

হিজরী সালের শাবান মাস পবিত্র রমজান মাসের অগ্রদূত। এ মাসের মধ্যবর্তী একটি বরকতময় রজনী আছে। সেটি হল ১৪ তারিখের দিবাগত রাত। শাবান শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ হওয়া,সম্প্রসারিত হওয়া ও ফুল- ফল পএ পল্লবে সুশোভিত হওয়া। সুতরাং এ মাসের মধ্যবর্তী বরকতময় রাতের সামান্য ইবাদত আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণতায় উন্নীত করেন। হযরত আবু উমামা বাহেলী রঃ থেকে বর্নিত আছে, যখন শাবান মাস আসত তখন রাসুল সঃ বলতেন,তোমরা তোমাদের প্রবৃত্তিকে পবিত্র ও নিয়ত বিশুদ্ধ করে নিও। এ মাসের মধ্যবর্তী রাত অর্থাৎ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলা হয়। আমাদের দেশে বলা হয় লাইলাতুল বরাত বা শবেবরাত। পবিএ কুরআন এবং সহীহ হাদীসে লাইলাতুল বরাত নামে কোনও রাতের উল্লেখ নেই।তবে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান উল্লেখ আছে। হযরত রশীদ ইবনে সায়ীদ ইবনে রশীদ রামলী রহঃ– হযরত আবু মুসা আশআরী রাঃ থেকে

বর্ণিত আছে যে,হযরত রাসুলে করিম সঃ বলেছেন, ” শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে তোমরা নামাজ পড় এবং দিনে রোজা পালন কর। কারণ এদিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করেন, আমার কাছে কেউ ক্ষমা প্রার্থী আছ কি?এ রাতে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হবে। কিন্তু আংশীবাদী,অপরের সম্পদ আত্মসাৎকারী,পিতা- মাতার অবাধ্য, ব্যভিচারী, ফেতনাবাজ,চোগলখোর ও হিংসুকদেরকে ক্ষমা করা হবে না। ” (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত শরীফ)।
এ মাস মুসলমানদেরকে পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার জন্যে প্রস্তুতির আহবান জানায়। শাবান মাসের মধ্যে ভাগে তিনটি রোজা রাখার বিধান আছে। এ রোজা নফল হলেও এর সওয়াব অপরিসীম। এ মাসের তিনটি রোজা মুসলমানদেরকে রমজানের রোজা রাখার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতের ফযিলত নিয়ে ইদানিং আলেম সমাজের মধ্যে মত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাধারণ মুসলমানেরা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। এ মত বিরোধ নিরসন হওয়া উচিত। মত বিরোধ নিরসনকল্পে ইসলামী চিন্তাবিদ এবং হাদীসে কুদসীহ বিভিন্ন হাদীস ও কিতাবে বরণিত উক্তি নিম্নে দেওয়া হলোঃ

সৌদি আরবের উচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য সাইখ আবদুল্লাহ আল মুতলাক বলেন,শাবান মাসের মধ্য রজনীর ফজিলত অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেছেন এটা একটি শ্রেষ্ঠ রজনী। মিশকাত শরীফে বর্নিত আছে যে, এ রাতে দয়াময় আল্লাহর নির্দেশে ফেরেস্তাগন মানব জাতির পরবর্তী মধ্য শাবান মাস পর্যন্ত দীর্ঘ একবছরে হিসাব-নিকাশ স্থির করেন। মানব জাতির হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত, উত্থান-পতন, ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মান-সম্মান, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি ভাগ্যলিপি ফেরেস্তাগন লিখেন। হাদিস শরীফে এ রাতের ফযিলত সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ননা আছে।তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও মিশকাত শরিফে বর্নিত আছে যে,হযরত আয়শা (রা:)একদিন রাতে ঘুম ভাঙার পর রাসুল সঃ কে বিছানায় না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে জান্নাতুল বাকি কবর স্হানে আসেন।রাসুল সঃ মোনাজাত শেষে হযরত আয়শা (রাঃ)কে দেখে তিনি বলেন,আয়শা,তুমি কি জান আজ কোন রাত?আজ হল মধ্য শাবানের রাত।এরাতে মহান আল্লাহ পৃথিবির কাছাকাছি আকাশে অবস্হান করেন।তুমি শুনলে অবাক হবে।বনি কলব গোত্রের যত মেষ আছে,ঐ মেষ গুলোর গায়ে যত পশম আছে তত সংখ্যক গোনাহগার বান্দাকে এরাতের উসিলায় ক্ষমা করে দেন। সহীহ বুখারী,মুসলিম ও আবু দাউদ শরীফে হযরত আয়েশা রাঃ কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসুল সঃ রমজান মাস ছাড়া শাবান মাসে অধিক রোজা পালন করতেন,যা অন্য কোন মাসে করতেন না।
পবিত্র কুরআন শরীফে সুরা আদ দুখানের ২-৪নং আয়াতে পরম করুনাময় আল্লাহ রব্বুল আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষনা করেন যে, “সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। আমি এ কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি কোন এক বরকতময় রজনীতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী ছিলাম। এ রজনীতে প্রত্যেক হিকমতময় বিষয় স্থিরকৃত হয়”। উপরিউক্ত আয়াতের অর্থ দ্বারা প্রমানিত হচ্ছে যে, আল্লাহরব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনকে মধ্য শাবান মাসে অবতীর্ন করেছেন। আবার সুরা আল কদরে ঘোষনা করেছেন কুরআন কদরের রাতে নাযিল করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কোন তারিখটি সঠিক? উত্তর হচ্ছে দুটোই সঠিক। তার মানে হচ্ছে কুরআন নাযিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে মধ্য শাবান মাসে, আর সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে শবে কদরে। (মিরাজুল মুমিনীন- শায়খুল হাদিস আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী, পৃষ্ঠা – ১১৯)। কোন কোন তাফসীরকারক বলেছেন,পবিত্র কুরআন মধ্য শাবান মাসে নাযিল হয়েছে। তাঁরা “লাইুলাতুম মুবারাকাহ” এর তাফসির করেছেন মধ্য শাবান মাস বা শবেবরাত। বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) স্বীয় তাফসির “ইবনে আব্বাস”এ বলেছেন “লাইলাতুম মুবারাকাহ” বলতে সাবান মাসের মধ্য রজনী। মহান আল্লাহ এ রাতে প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলো সমাধান করে থাকেন। অধিকাংশ তাফসিরকারের মতে কুরআন শবেকদর নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনে “লাইলাতুল কদর” উল্লেখ আছে। এ রাতে ইবাদত বন্দেগী করা সৌভাগ্যের বিষয়। একমাত্র শবেবরাতের রাত ছাড়া এ রাতের সমতুল্য অন্য কোন রাত নেই। সুতরাং এ দু’টো রাতের ফযিলত অত্যন্ত বেশী।
হযরত ইমাম গাযযালী রঃ তাঁর “মুকাশাফাতুল কুলূব ” কিতাবে বর্ণিত আছে, পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্যে যেমন দুটি ঈদের দিন আছে, তেমনি ফেরেশতাদের জন্যেও আসমানে দুটি ঈদের রাত আছে।মুসলমানদের জন্যে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আর ফেরেশতাদের জন্যে শবে বরাত ও লাইলাতুল কদর। এ জন্যে শবে বরাতকে ” ঈদুল মালায়েকা” নাম দেয়া হয়েছে। এ রাতকে শাফায়াতের রাতও বলা হয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসুল সঃ উম্মতের জন্যে ১৩ শাবানের রাতে সুপারিশ করেছিলেন, তাতে কবুল হয়েছিল এক তৃতীয়াংশ,অতপর ১৪ শাবানের রাতে পুনরায় সুপারিশ করেছেন,তাতে কবুল হয়েছে আরেক তৃতীয়াংশ। অতপর ১৫ শাবানের রাতের সুপারিশে অবশিষ্ট তৃতীয়াংশ কবুল হয় এবং পরিপূর্ণতা লাভ করে।তবে খারাপ মানুষের জন্যে সুপারিশ কবুল হয়নি।
শাবান মাসের মধ্য রজনী তথা শবেবরাতের সম্মান ও কদর করতে হলে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে সন্ধ্যা থেকে সারারাত ইবাদত-বন্দেগী তথা বেশী বেশী নফল নামাজ পালন, কুরআন পাঠ, তসবিহ পাঠ, তওবা পাঠ, দোয়া-দরুদ পাঠ এবং দিনের বেলা রোজা পালন করা। তবে মনে রাখতে হবে যে, সারারাত নফল ইবাদত করতে গিয়ে যেন ফজরে নামাজ ছুটে না যায়।
আমাদের দেশে শবে কদরের চেয়ে শবে বরাতের মূল্যায়ন বেশী করা হয়। এটা ঠিক নয়। ইদানিং ইবাদতের নামে হিন্দুদের দেওয়ালী উৎসবের ন্যায় এ রাতে অসংখ্য মোমবাতি বা মশাল জ্বালিয়ে, শরীরে রং ছিটিয়ে আমোদ উৎসব করা হয়। এ উৎসব ইসলাম ধর্মের বিরোধী তথা পাপের কাজ। এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আমি সকল মুসলমানকে অনুরোধ করছি।

হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলে করীম (সঃ) বলেছেন, তোমরা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন হও এবং দিনে রোজা রাখ। কেননা এ রাত অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ ও বরকতময়। এ রাতে তিনি নিজেই ইবাদত করতেন এবং সাহাবীগনকে ইবাদত করতে বলেন। তিনি কবরবাসিদের জন্যে মাগফিরাত কামনা করেন। এ রাতে আল্লাহ পৃথিবীর নিকটতম আকাশে অবস্থান করে ঘোষণা করেন,” তোমাদের মধ্যে কেউ কি ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ? আমি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেব। কেউ বিপদগ্রস্ত আছ কি? আমি বিপদ মুক্ত করে দেব। কেউ রিজিক অনুসন্ধানকারী আছ কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে প্রার্থিত বস্তু দেব। (ইবনে মাজাহ এবং মিশকাত শরীফ)।

ইমরান ইবনে হোসাইন (রাঃ)এর নাম উল্লেখ করে হাদ্দাব ইবনে খালেদ (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি শাবান মাসের মধ্যভাগে রোজা রেখেছিলে? তিনি বলেন, না। তখন রাসূল (সঃ) বলেন, যখন তুমি রোজা রাখ নাই, তখন ২ দিন রোজা রাখবে।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্নিত আছে যে,নবী করীম (সঃ) বলেছেন শবে বরাতে আল্লাহর রহমতের দরজা খোলা রাখেন। মদখোর,সুদখোর, ঘুষখোর, মুশরিক, হিংসুক, ব্যাভিচারী,যাদুকর, গনক, পিতা-মাতার অবাধ্য, অপরের সম্পদ হরণকারী,ফেতনাবাজ ছাড়া শবে বরাতে সকল ইবাদতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন, যদি তারা খালিস নিয়তে তওবা করে। কারণ, আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা যুমার ৫৩নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন যে, হে আমার বান্দাগণ, তোমরা যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছ,তারা আমার রহমত থেকে নিরাশ হইওনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করবেন। বশ্তুতঃ তিনিই পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (ইবনে মাজাহ)।শাবান মাসের মধ্য রজনী তথা শবেবরাতের ফযিলত।
শবে বরাতের নামাজ অত্যন্ত ফযিলত ও বরকত পূর্ণ। এ নামাজ আদায় করতে হলে প্রথমে এশার ফরয ও সুন্নাত নামাজ আদায় করে লাইলাতুল বরাত নফল নামাজের নিয়তে ২ রাকাআত করে যথাসাধ্য বেশী পরিমান নামাজ আদায় করবেন। যতবেশী আদায় করবেন ততবেশী সওয়াব আপনার আমল নামায় লেখা হবে।ব্যবসা-বানিজ্যে আমরা যেমন বেশি লাভের চেষ্টা করি,তেমনি পরকালে সুখ শান্তিতে থাকার জন্য বেশি নফল নামাজ আদায় করা উচিত।পীরানপীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর লিখিত “গুনিয়াতুত ত্বালেবীন” কেতাবে লাইলাতুল বরাত নফল নামাজ ১০০ রাকাতের কথা বর্ণিত আছে।এ নামাজে প্রতি রাকাআতে সুরা ফাতিহা পাঠ করার পর ১০বার সুরা ইখলাস পাঠ করা হয়।কেউ কেউ সুরা ফাতিহার পর সুরা কদর এবং সুরা ইখলাস ২১,২৭,৩১,৩৩,এবং ৫০বার পাঠ করেন। এ নামাজকে নামাজে খায়ের বলা হয়। শেষে তিন রাকাআত বিতর নামাজ আদায় করতে হয়।অধিকাংশ আলেমের মতে অধিক সংখ্যক সুরা পাঠ না করে কম সংখ্যক সুরা দ্বারা নামাজ আদায় করাই উত্তম।কারণ,হৃদয় ও মন প্রানের একাগ্রতা হচ্ছে নামাজের প্রধান অংশ।বেশী সংখ্যাক সুরা পাঠ করলে নামাজের একাগ্রতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।যে পরিমান সুরা পাঠ করা সহজ হবে,সেই পরিমান পাঠ করাই উত্তম।হাতে তসবীহ নিয়ে কিংবা হাতের কড়ায় সুরা সংখ্যা গণনা করা মাকরুহ।এ জন্যে বেশী সংখ্যায় সুরা পাঠ না করাই উত্তম।আসুন,আমরা পরম করুনাময় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি, ইহকাল ও পরকালে আমাদের সুখ ও শান্তির জন্যে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্যে।
আল্লাহ হাফিজ।

Leave a Reply

x

Check Also

শারদীয় দূর্গা উৎসব উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বস্ত্র বিতরণ

পিরোজপুর প্রতিনিধি : শারদীয় দূর্গা উৎসব উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে পিরোজপুরে বস্ত্র বিতরণ ...