মোঃ মেহেদী হাসান: পথের ধারে দাঁড়ালে চোখে পড়ে কাঠবোঝাই ট্রাকের দীর্ঘ সারি, একটির পর একটি ট্রাক আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে সোজা এগিয়ে যায়, যেন সবুজ বনানীর হৃদয় চিরে নির্বিকার গতিতে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিঃশব্দ আর্তনাদ। শতবর্ষী বৃক্ষ কেটে ফেলা হচ্ছে, শিকড়সহ তুলে নেওয়া হচ্ছে মাটির বুকে গাঁথা সবুজ রক্ষাকবচ। যেন সভ্যতার স্বার্থে সভ্যতাকেই ধ্বংস করা হচ্ছে নিঃশব্দে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে প্রশ্ন তুললে উত্তর প্রায় একই: “এগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মালিক চাইলে বিক্রি করতেই পারেন।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি একবিংশ শতাব্দীর জলবায়ু সংকটের এই যুগে বৃক্ষকে কেবল ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হিসেবে দেখতে পারি? যে বৃক্ষ আমাদের শ্বাসের বাতাস তৈরি করে, মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আঘাত শোষণ করে এবং জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, তাকে কি কেবল জমির কাগজের সঙ্গে বাঁধা কোনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা ন্যায়সঙ্গত?
একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে গড়ে প্রায় ২১-২২ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আমাদের জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এটি কেবল পরিবেশকে শীতল রাখে না, বরং ভূমিক্ষয় রোধ, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অমূল্য ভূমিকা রাখে। তবু প্রতিদিন এই অঞ্চলে ২০-৩০টি কাঠবোঝাই ট্রাক নির্দ্বিধায় পাড়ি দেয় আঞ্চলিক মহাসড়ক, আর সেই সঙ্গে কমে যায় আমাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, যার বড় অংশই ব্যক্তিগত মালিকানার জমিতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হারে বন উজাড় চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে দেশের মোট বনভূমি এক-তৃতীয়াংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বৃক্ষের গুরুত্ব উন্নত বিশ্ব অনেক আগেই বুঝেছে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া বা জাপানের মতো দেশে গাছ কাটতে হলে কঠোর সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- জার্মানি: কোনো নাগরিক যদি অনুমতি ছাড়া রাস্তার ধারের গাছ বা এমনকি নিজের উঠানের বড় গাছ কাটেন, তাকে সর্বোচ্চ ৫০,০০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হয়।
- অস্ট্রেলিয়া: অনেক অঙ্গরাজ্যে একটি গাছ কাটার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলের লিখিত অনুমতি বাধ্যতামূলক। এমনকি শাখা-প্রশাখা ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রেও আইন মানতে হয়।
- জাপান: শহুরে এলাকায় একটিমাত্র গাছও কাটার আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক। না মানলে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলগুলোর একটি। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নোনাজলের অনুপ্রবেশ আর নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখানকার মানুষের জীবনের অংশ। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক বৃক্ষবেষ্টনী ঘন হলে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ৭০% পর্যন্ত কমানো যায়।
বৃক্ষ শুধু বাতাস থামায় না—এটি ঝড়ের শক্তি শোষণ করে, জলোচ্ছ্বাসের গতি কমায় এবং ভূমি ক্ষয় রোধ করে। অথচ আমরা সেই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাকে নিজের হাতে ধ্বংস করছি প্রতিদিন। এরই ফল ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপপ্রবাহ ও পানির সংকটের মতো বহুমুখী বিপর্যয়।
বাংলাদেশে বৃক্ষ কাটার বিষয়ে কিছু আইন থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ আজও অপ্রতুল। ব্যক্তিগত জমিতে গাছ কাটার ওপর কার্যকর কোনো অনুমতি ব্যবস্থা নেই। ফলে “ব্যক্তিগত সম্পত্তি”র দোহাই দিয়ে চলছে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মাহফুজা রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন:
“ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই অধিকার কখনোই সমষ্টিগত জীবনের ক্ষতি করার স্বাধীনতা দিতে পারে না। জলবায়ু সংকটের এই সময়ে বৃক্ষকে কেবল ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দেখা আত্মঘাতী মানসিকতা।”
এখন আর সময় নেই বিলম্ব করার। আমাদের দরকার সমন্বিত ও শক্তিশালী পদক্ষেপ:
- বৃক্ষ কাটার জন্য সরকারি অনুমতি বাধ্যতামূলক করা।
- প্রতিটি পৌরসভা ও ইউনিয়নে “বৃক্ষরক্ষা কমিটি” গঠন করে কাঠ পরিবহনে নজরদারি নিশ্চিত করা।
- স্কুল-কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করে তোলা।
- বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ব্যক্তিগত জমিতে গাছ রোপণে কর সুবিধা দেওয়া।
প্রকৃতি কখনো শত্রু নয়, কিন্তু যখন আমরা তার হৃদয় বিদীর্ণ করি, সে তখন প্রতিক্রিয়া দেখায়, প্রবল ঝড়ে, অকাল বৃষ্টিতে, অনিয়ন্ত্রিত তাপপ্রবাহে। এই প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাবে না কেউ, না ধনী, না গরিব।
আজ যদি আমরা বৃক্ষকে ভালোবাসতে না শিখি, কাল আমাদের সন্তানরা নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাসও হয়তো কিনতে হবে বোতলে। গাছ কাটা মানে কেবল কাঠ পাওয়া নয়, এটি ভবিষ্যৎ কেটে ফেলা।
মানুষ আর কবে সচেতন হবে, এই প্রশ্ন আজ কেবল আক্ষেপ নয়, এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের বেঁচে থাকা, আগামী প্রজন্মের হাসি, ভবিষ্যতের পৃথিবী, সবকিছুই নির্ভর করছে আজ আমরা বৃক্ষকে কতটা ভালোবাসতে পারি তার ওপর।
এখনই সময় বৃক্ষের পক্ষে দাঁড়ানোর। না হলে একদিন গাছহীন এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা শুধুই বলব “তখন বুঝিনি, এখন অনেক দেরি।”
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.