ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে যাকাত তৃতীয় অর্থাৎ নামাজের পরেই এর স্থান। প্রত্যেক ধনবান মুসলমানের উপর যাকাত আদায় করা ফরজ। পবিত্র কুরআনের প্রায় সর্বত্রই নামাজের সাথে সাথে যাকাতের আদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, হাদিস শরিফে যাকাত সম্পর্কে রাসুল(সঃ) এর অসংখ্য বাণী রয়েছে। যাকাত ধনী ও গরীবের মধ্যে সহানুভূতি ও অর্থনৈতিক এক কল্যাণকর ব্যাবস্থা এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কর্তব্য ও একটি মৌলিক ইবাদাত। পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলগণের সময়ে এটি ফরজ হিসেবে প্রচলিত ছিলো। তবে কতো ধনের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে তার পরিমান এবং যাকাত ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ছিলো। কেউ যাকাতকে ফরজ রূপে অস্বীকার করলে মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
যাকাত কি? যাকাত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পবিত্র হওয়া ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। আল্লামা শামী(রহঃ) বলেন, যাকাতের আরো দুটি অর্থ আছে। যথাঃ বরকত ও গুণকীর্তণ। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো একমাত্র শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নিসাব পরিমান সম্পদ হতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ নিঃস্বার্থভাবে গরীব ও মিসকীনদের মলিকানা প্রদান করা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিসাব কি? সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭.৪৮ গ্রাম সোনা বা সাড়ে বায়ান্নো তোলা বা ৬১২.৪১২ গ্রাম রূপা কিংবা উহার সমমূল্যের সম্পদকে নিসাব বলে এবং এর মালিককে “মালিকে নিসাব” বলা হয়। যে ব্যাক্তি উক্ত নিসাবের মালিক হবে এবং এক বছর যাবৎ স্থায়ী হবে, তার উপর যাকাত ফরজ হবে। ইহা অপেক্ষা কম হলে যাকাত ফরজ হবেনা।
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আদেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করার প্রয়াস পায়। সম্পদের লোভ-লালসা এবং কৃপণতার কলুষ দূর হয়। নামাজ ও রোজার মাধ্যমে যেমন দৈহিক নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়, তদ্রুপ যাকাত প্রদানের দ্বারা আর্থিক নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। যাকাত প্রদানে ত্যাগ ও কুরবানির অভ্যাস গড়ে ওঠে। যারা যাকাত প্রদান করেনা মহান আল্লাহ তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন এর সুরা তওবার ৩৪-৩৫ নং আয়াতে কঠোর শাস্তির কথা বলেছেন, “আর যারা সোনা ও রূপা গচ্ছিত করে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা, তাদেরকে কঠোর শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে উহা উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাট,পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠ দেশে দাগ দেয়া হবে, সেদিন বলা হবে, ইহাই উহা যা তোমরা নিজেদের জন্যে গচ্ছিত করতে। সুতরাং তোমরা গচ্ছিত করেছিলে তা আস্বাদন গ্রহণ করো।”
মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে যে, যার নিকট সোনা ও রূপা তথা সম্পদ মওজুদ থাকা সত্ত্বেও সে তার যাকাত প্রদান করেনা, কিয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে আগুনের পাত বানানো হবে এবং এগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার বুকে, পিঠে, পাঁজরে, ঘাড়ে ও কপালে দাগ দেয়া হবে। পাতগুলো একবার ঠান্ডা হয়ে গেলে পূণরায় উত্তপ্ত করা হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এরূপ চলতে থাকবে(হাদিস নং ৮৩১)
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
১/ যাকাত প্রদানকারীকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। অমুসলমানদের উপর যাকাত ফরজ নয়। অমুসলমান গরীবদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে দান করা যাবে।
২/ যাকাত প্রদানকারীকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির মালিকানায় সম্পদ থাকতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির মালিকানায় সম্পদ থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩/ যাকাত প্রদানকারীকে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হতে হবে। জন্মগত পাগল বা আকস্মিক মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে পূর্ণ এক বছর কাল পাগল অবস্থায় থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ নয়।
৪/ সম্পদের পূর্ণ মালিকের উপর যাকাত ফরজ। যার তত্ত্বাবধানে সম্পদ থাকে, তাকে যাকাত দিতে হবে না। কারণ, সে সম্পদের মালিক নয়।
৫/ যাকাত প্রদানকারীকে স্বাধীন হতে হবে। ক্রীতদাসের উপর যাকাত ফরজ নয়। কারণ সে সম্পদের মালিক নয়।
৬/ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিককে যাকাত দিতে হবে। এর কম হলে যাকাত দিতে হবে না।
৭/ জীবন যাপনের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেমন, পরিধানের কাপড়,বাসগৃহ, পরিবার ও আবাস গৃহের আসবাবপত্র, বই-পুস্তক, আরোহনের গাড়ী ইত্যাদির উপর যাকাত দিতে হবে না।
৮/ নিসব পরিমাণ সম্পদ ঋণমুক্ত হওয়া অর্থাৎ কোন ব্যক্তির নিকট ৬১২.৪১২ গ্রাম রুপা বা সমমূল্যের নগদ টাকা আছে, কিন্তূ অই পরিমাণ টাকা পূর্ণ এক বছর ঋণও আছে। এমত অবস্থায়, ওই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়। তবে ঋণ পরিশোধের পর নিসাবের পরিমাণ সম্পদ থাকলে, তাকে যাকাত দিতে হবে।
৯/ বর্ধিষ্ণু সম্পদের যাকাত দিতে হবে। কোন ব্যক্তি তার ব্যবহৃত গাড়ি বা আসবাবপত্র ভাড়া দিলে এবং ভাড়া উপার্জিত টাকা নিসাব পরিমাণ হলে তাকে যাকাত দিতে হবে।
১০/ যাকাত প্রদানের জন্যে নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত না করে শুধু দান করলে যাকাত আদায় হবে না। মুসলমান গরীব- মিসকিনদেরকে ফি সাবিলিল্লাহ বলে যাকাত প্রদানের সময় অবশ্যই মনে মনে নিয়ত করতে হবে। আমি যাকাত দিচ্ছি এরুপ মনে মনে নিয়ত করলেই হবে।
যাকাতের পরিমাণঃ
সোনা, রুপা ও পনদ্রব্যের যাকাত ৪০ ভাগের একভাগ। সিঞ্চিত জমির উৎপন্ন ফসলের ২০ ভাগের এক ভাগ, অসিঞ্চিত জমির উৎপন্ন ১০ ভাগের এক ভাগ এবং নগত টাকা শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।
যেসব পশু বংশ বৃদ্ধির জন্যে চারণভূমিতে বছরের অন্তত ছয় মাসের অধিক প্রতিপালিত হয়, সেগুলোর যাকাত দেয়া ওয়াজিব। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যের প্রতিপালিত হয়ে থাকলে পন্যদ্রব্য হিসেবে এসব পশুর যাকাত দিতে হবে। পশুর মধ্যে উট,গরু, মহিষ,ছাগল ভেড়া,ও ঘোড়ার যাকাত দিতে হয়। অন্য পশুর যাকাত দিতে হয় না। গরু ও মহিষ ৩০ টি হলে একটি এবং ছাগল, মেষ ও ভেড়া ৪০ টি হলে একটি যাকাত দিতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা হস্তগত হলে যাকাত দিতে হবে।
নিজের পরিবার- পরিজনের আবশ্যকীয় অভাবসমুহ মেটানোর জন্যে পরিশ্রম করা এবং প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের তথা মুসলমানের ফরজ। একব্যক্তি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু তা শুধু জনগণের কল্যাণে নিয়োগ করার জন্যে পারবে। বিলাস, জাঁকজমক বা ক্ষমতা লাভের জন্যে উপারর্জন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জীবনকে সার্থক, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে গড়ে তোলা র জন্যে আল্লাহর সম্পদে প্রত্যেক মানুষেরই শ্রম নিয়োগ করে প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের অধিকার ইসলাম দিয়েছে। নিছক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও ক্ষমতা অরজনের জন্যে কিংবা ব্যাক্তির ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্যে সম্পদ সংগ্রহের অধিকার ইসলামে নেই। পবিত্র কুরআনের সূরা তাহা এর ৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,” পৃথিবীতে ও আকাশসমুহে এবং উভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে বা ভুগর্ভে যা কিছু ধনসম্পদ আছে সবাই আল্লাহর। আসুন, আমরা সবাই যাকাত প্রদান করি এবং মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি হে আল্লাহ, আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের ভাল ও কল্যাণ দান করুন আর আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।”
এ বছর ঘাতক ব্যাধি করোনা ভাইরাস সংক্রমন প্রতিরোধকল্পে সরকার সারা দেশ লক ডাউন ঘোষণা দিয়ে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সবাইকে নিজ নিজ ঘরে অবস্হান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এহেন অবস্হায় দেশে গরীব,অসহায় এবং খাদ্যহীন লোকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই যাকাত প্রদানকারীগণকে এ বছর অসহায় ও খাদ্যহীন মানুষের মধ্যে দ্রুত যাকাত বিতরণ করার জন্যে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। আল্লাহ হাফিজ