ব্রেকিং নিউজ
Home - অন্যান্য - পৃথিবীটা মানুষের একার নয়

পৃথিবীটা মানুষের একার নয়


🌿
১.
আমার তখন ক্লাস চার। হাফপ্যাণ্ট বেলা। আমি গ্রাম্য পোলা ঘুড়ির সাথে সখ্য জীবন। তো বিকালে আমার মিঠাখালী গ্রামের বাড়ির পাশের উত্তর মাঠে ঘুড়ি ওড়াই। মাঠ তো বলতাম না বলতাম উত্তর কোলা। সেই উত্তরের কোলায় আমার ঘুড়ি উড়ছিলো আকাশে। মাঠে তখন কৃষক ছিলো । আমি পাকা ধানক্ষেতের আলের ভেতর দাড়িয়ে ধলুদার দোকান থেকে আট আনায় কেনা রঙিন ঘুড়ি দক্ষিণা বাতাসে ওড়াই।
হঠাৎ পাকা ধানক্ষেতের মধ্যে কিসের যেন চলার শব্দ। খসখস শব্দ , কান পাতি …। কিছুই দেখা যায়না । ভাবি গরু নয়েতো ছাগল ধান খায় বুঝি।

একটু উঁকিঝুকি মারি। না কিছুই তো নেই। পাকা ধান ক্ষেতের ভেতর খসখস শব্দটা আরও স্পষ্ট হতে থাকে । আমি ঘুড়ির নাটাইটা মাঠের নরোম মাটিতে পুঁতে দেই। ধানক্ষেতে আলের ভিতর একটু এগিয়ে দেখি একটা হরিণ বিচরণ করছে। ভয় পাই । দৌড়ে খোলা মাঠের দিকে এসে কাছের কৃষক মফেজ চাচাকে ডাক দেই। বলি চাচা ধান খ্যাতের ভেতর একটা হরিণ । চাচা দৌড়ে আসে ..। দৌড়ে আসে মাঠের আরও কৃষক, আসে পূবের গ্রাম থেকে উৎসুক মানুষ। সবাই পাকা ধানক্ষেতের মধ্যে হরণিটারে ধাওয়া শুরু করে। আতংকে হরিণটিও দৌড়া দৌড়ি শুরু করে।

বহুক্ষণ তাড়া খায় হরিণটি। তবে গ্রামবাসি তারে ধানক্ষেতের ভেতর থেকে আটক করতে পারেনা। এর আগেই মাঠের উত্তর পাড়ার বনেদী খান সাহেবের বাড়ির লোকজন মাঠে নামে। তাদের কেউ কেউ চিৎকার দিতে থাকে। আমি স্পষ্ট শুনি, এই তোমরা থামো । ওটা খান সাহেবের পালিত হরিণ। গ্রামবাসি থামে বিদ্যুত শকের মতোন। খান সাহেব হচ্ছেন বনেদী আর ভিষণ রকম প্রভাবশালী আর এলাকায় সম্মানী মানুষ । ধানক্ষেতের হরিণটা খান সাহেবের গৃহপালিত শখের হরিণ। সকালে ওটা বাড়ি থেকে সকলের অগোচরে ধানক্ষেতে নেমে পথ হারিয়ে ছিলো।
লোকজন মাঠ থেকে টাসকি খেযে বাড়ি ফেরে আমিও ফিরি। আমার আকাশের ঘুড়ি তখন বাতাসের অভাবে ধান ক্ষেতে নেতিয়ে পড়ে।
২.
বছর ২০ আগে আমি তখনও সাংবাদিক । শেষ রাতে খবর পাই ট্রলার ভর্তি ১৯টা হরিণ আটক করছে পুলিশ। তবে চোরা শিকারীদের কেউ আটক হয়নি। হরিণগুলো সব থানায় নিয়ে আসা হইছে। আমি ভোররাতে ঘুমঘুম চোখে থানায় গিয়ে তাজ্জব বনে যাই। এত্তগুলা হরিণ কেমনে সুন্দরবন দিয়া মঠবাড়িয়ার লোকালয়ে আসলো ? বলেশ্বর নদী সাঁতরেতো এই হরিণ আসার কোনও সুযোগ সম্ভাবনা নাই। চোরচক্রই তারে ফাঁদে আটকে নিয়ে আসে। তবু হরিণ শিকারীগুলো ধরা পড়েনা। ঘটনাগুলো সব এক সময় মানুষের স্মৃতিভ্রস্টও হয়ে যায়।
৩.
মঠবাড়িয়ার সোনাখালীতে আজ সকালে একটা হরিণ বীর গ্রামবাসি ধাওয়া করে আটক করছে। গত কয়েকদিন ওই সব এলাকায় নাকি বাঘের আতংক চলছিলো। তখনই বলছি এসব বাঘ তো গুজব। সুন্দরবন থেকে বাঘ সাঁতরে মঠবাড়িয়ায় আসার কোন সম্ভাবনা অতীতেও ছিলোনা আজ অবধি নেই।
পরে শুনি গ্রামবাসি লকডাউন ভেঙে বাঘ আটকের অভিযানে নামছে। কস্ট বিফলে যায়নি । তারা একটা বাঘঢাস আটক করছে। গৃহস্থের হাস মুরগী খাওয়া খাটাশ। কিন্তু সোনাখালী গ্রামের হরিণটা কিভাবে লোকালয়ে আসলো ? এটা কিন্তু একটা প্রশ্ন । রহস্য অজানা থাকে কত শত । এটাও হয়তো চাপা পড়ে যাবে। আমাদের প্রাণ বৈচিত্র্য একদল মানুষ চক্র নিয়ত বিপন্ন করে তুলছে।
৪.
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা শরণখোলা উপজেলা। ওইখানের লোকালয়ে একবার ছোট ভোলা নদী পার হয়ে একটা বিপন্ন বাঘ গ্রামে ঢুকছিলো। তারপর গ্রামবাসি তারে প্রাণভয়ে সাইজ করছে। মাঝে মাঝে হরিণও ওইসব এলাকায় আসে । ভোলা নদী সাঁতরে না চোরা শিকারীরা ধরে আনে। একটা দুইটা না অনেকগুলোই আনে। লোকালয়ে ধরে আনা হরিণ মাঝে সাজে শিকারীর কব্জা থেকে দুই একটা ফসকে যায়। তবে ফসকে যাওয়া হরিণের লোকালয়ে নিস্তার নেই। গ্রামবাসি তারে আটক করে আবার চার পা বেঁধে কৃষিজমির মাঠে চিৎ করে ফেলে রাখে। সাংবাদিক আর প্রশাসন যায় । বিপন্ন হরিণ তারপর আবার সুন্দরবনে অবমুক্তও হয়। উপকূলের সাংবাদিক বলেই এই কাহিনী জীবনে বহুবার লিখেছি ।

৫.
শরণখোলার বন্ধু সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী। ইত্তেফাকে তার একটা খবর বেরিয়েছে। ওখানে তিনদিন আগে একটা বিরল প্রজাতির হরিণ লোকালয়ে আটক হইছে। উদ্ধার হইছে পরে বনে ফিরছে হরিণ। এটুকুই খবর । কিন্তু হরিণ চোরগুলো আর ধরা পড়েনা।
আজ সকালে সাংবাদিক মোহম্মদ আলী ফোন করেছেন আমায় , দাদা মঠবাড়িয়ার সোনাখালীতে যে হরিণ আটক হইছে সেটা গ্রামে আইলো কেমনে ?
বলি ভাই, এই করোনাকালে চোরা শিকারীর তৎপরতা বাড়ছে। হরিণ বলেশ্বর নদীর উপর দিয়া তো হেটে আসে নাই ।
মোহাম্মদ আলী বলতে থাকেন, লকডাউনের ভেতর চোরা শিকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে।

পুনশ্চ <>
মঠবাড়িয়ার লোকালয়ে আটক হরিণটি অবশেষে ফিরে যাচ্ছে সুন্দরবনে । যান্ত্রিক ট্রলারে উঠেছে বিপন্ন হরিণ। তার গন্তব্য সুন্দরবনে নিজের অভয়ারণ্যে। ঘরহারা হরিণ আপন ঘরে ফিরছে , এ বিপন্ন সময়ে এর চেয়ে আর ভালো খবর আমার কাছে এ মূহুর্তে নেই
জেনে রাখুন মানুষ, বিধাতার এই সুন্দর পৃথিবীটা কেবল মানুষের একার না। প্রকৃতির কাছে কান পেতে শুনুন তারাও মানুষের কারনে রাতের পর রাত কাঁদছে।
🌿
বন্দীর বয়ান
২৩ এপ্রিল-২০২০

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...