ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - প্লেটোর মানুষের শ্রেণিবিভাগ এবং ন্যায়বিচার ও আমাদের সমাজ

প্লেটোর মানুষের শ্রেণিবিভাগ এবং ন্যায়বিচার ও আমাদের সমাজ

মোহসেনুল মান্না➡️
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে জন্মেছিলেন এই মহান দার্শনিক। আদর্শ রাষ্ট্র কিভাবে গঠন করা যায় সেটাই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। রাজনীতি বিষয়ক সুসংবদ্ধ কোন জ্ঞানও আমরা তার লিখিত “দ্যা রিপাবলিক” গ্রন্থের মাধ্যমেই প্রথম পাই। রিপাবলিকের মধ্যে প্লেটো ন্যায়বিচার, আদর্শ রাজা, আদর্শ রাষ্ট্র, সাম্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন।
কার্ল মার্ক্স তার সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব দেবার পূর্বেও মানুষের শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন। তার মতে রাষ্ট্রে দুই শ্রেণির মানুষ আছে: বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত। প্রলেতারিয়েত বা শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির পতন এবং শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের মূল বক্তব্য। যা হোক প্লেটো সমাজের মানুষকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তিনি সমাজের মানুষের তিন ধরণের গুণের কথা বলেছেন:
১. প্রজ্ঞা
২. বিক্রম
৩. প্রবৃত্তি
সব মানুষের মধ্যেই এই তিন ধরণের গুণ রয়েছে। প্রথম গুণ প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানেরও উপরের একটি স্তর। কিছু মানুষ আছে যারা জ্ঞানী কিন্তু জ্ঞান কোন জায়গায় কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা জানেনা। আবার কিছু মানুষ আছে জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে এবং জ্ঞানের দ্বারা ভবিষ্যৎও দেখতে পারে। যারা জ্ঞানকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে পারে তারাই প্রজ্ঞাবান। ইংরেজিতে প্রজ্ঞাকে বলা হয় wisdom। দ্বিতীয় গুন বিক্রম অর্থ সাহস। ইংরেজিতে একে বলা হয় courage। আর তৃতীয় গুণ প্রবৃত্তি বলতে বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তিকে বুঝানো হয়েছে যেমন : লোভ, হিংসা, ক্রোধ, চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি হচ্ছে প্রবৃত্তি। অনেক মানুষই আছে যারা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং শুধু প্রবৃত্তির দ্বারাই চালিত হয়। প্রবৃত্তি তাকে যা বলে তাই শোনে। মূর্খ এবং শিক্ষিত দুই শ্রেণির মানুষই প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হতে পারে তবে মূর্খরাই বেশী পরিমাণে প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয় এবং প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয় না। ঘুষ খাওয়া, চুরি করা, অন্যের প্রাপ্য আত্মসাৎ করা এগুলো মানুষ প্রবৃত্তির দ্বারা ত্বারিত হয়েই করে।
প্লেটো এই তিন শ্রেণির মানুষের গুণের ভিত্তিতে সমাজের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান দিয়েছেন। এই তিন শ্রেণির সমাজে অবস্থান হবে যথাক্রমে:
১. শাসক
২. যোদ্ধা
৩. উৎপাদক বা কৃষক
অর্থাৎ যার প্রজ্ঞা আছে তিনি হবেন শাসক শ্রেণির, যার বিক্রম আছে তিনি হবেন যোদ্ধা এবং একমাত্র প্রতিরক্ষাই তার কাজ আর যিনি প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হন তিনি হবেন উৎপাদক বা কৃষক। ছোট, বড় এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরাও উৎপাদক শ্রেণির। প্লেটোর মতে এই তিন শ্রেণির মানুষ যার যার জায়গায় সে সে থাকলে সেটাই হবে সর্বাধিক ন্যায়বিচার এবং এমন হলে রাষ্ট্রের সকল স্তরে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
এটা স্বাভাবিক যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক যারা যোদ্ধা শ্রেণির এবং তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক যারা উৎপাদক বা কৃষক শ্রেণির তাদেরও প্রথম শ্রেণি বা শাসক শ্রেণিতে আসার বাসনা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকরা প্রথম শ্রেণিতে এসে পড়লে রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হবে এবং প্রতিটি স্তরে এর প্রভাব পড়বে।
ছোট একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে অনেক টাকা খরচ করে পোলিও টিকা আমদানি করে সেটা বিনামূল্যে বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়। যে টাকা দিয়ে ইউরিয়া সার কেনা হয় তার থেকে কম মূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মূল্যবান পোলিও বিনামূল্যে বিতরণ এবং বেশী দামে ইউরিয়া আমদানী করে কম মূল্যে কৃষকের মধ্যে বিতরণের মাঝে রাষ্ট্রের লাভ কোথায় তা একমাত্র প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এবং প্রজ্ঞাবান শাসকই বুঝতে পারবেন। তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের (যিনি প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত) তা বোঝার কথা নয়।
বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সকল দেশ আর সমাজে যে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে তা হল তৃতীয় শ্রেণির মানুষরা (প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত) যারা প্লেটোর মতে উৎপাদক বা কৃষক শ্রেণির তারা শাসকের স্থান দখল করে বসেছে। অন্যদিকে যারা প্রজ্ঞাবান এবং যাদের ভিতরে দার্শনিক সত্ত্বা রয়েছে তাদের জীবনে কোন চাওয়া পাওয়া নেই। তারা শুধু চান সম্মানজনকভাবে বাঁচতে। আর এই সম্মানটুকু বাঁচানোর জন্য তারা দায়িত্ব কর্তব্য ছেড়ে মঞ্চ থেকে পালাচ্ছেন। আর সমাজে নেমে এসেছে অন্ধকারের অমানিশা। যেন কাক ময়ূরের পালক ধারণ করে আসল ময়ূরকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এক্ষেত্রে আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমাদের ভুলই দায়ী। আমরা একজন পিওন বা নাইটগার্ডের জন্যও এসএসসি পাশ বা এইচএসসি পাশ লোকজন খুজি, প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরীর জন্য ভালো ভালো ডিগ্রী খুঁজি। আজকাল তৃতীয় শ্রেণির চাকুরীর জন্যও বিএ বা এমএ পাশ খোঁজা হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র চেহারা দেখে বা নামেমাত্র ডিগ্রিধারীদের পাঠিয়ে দেই। এটাই আমাদের পতনের জন্য দায়ী। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জাতীয় এবং স্থানীয় নেতৃত্ব বাছাইয়ে এই চর্চা বেশী। সময় থাকতে ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়।
লেখক >> মোহসেনুল মান্না
বিসিএস(জেনারেল এডুকেশন)
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...