ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - কী লিখি তোমায়….

কী লিখি তোমায়….

হারুন উর রশীদ >
দেবদাস মজুমদারকে আমি খুব পছন্দ করি। তিনি প্রধানত গ্রাম সাংবাদিক আর আলোকচিত্রী । সে আমার কাছে সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা একজন মানুষ। তাকে যখন দেখি তখনই আরেকবার যেন জীবন ফিরে পাই। তাকে দেখে মনে হয় এইতো জীবন। মানুষের কাছাকাছি থাকা। জীবনের সাথে থাকা। কথা বলা প্রকৃতির সাথে।
আমার বাবা তখন বেঁচে আছেন। মঠবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। সেদিন কথা হয় সামান্যই। কিন্তু তারপরও আমার মানুষটাকে কেন যেন ভালো লেগে যায়। তবে আগে বাবা দেবদাস মজুমদারের কথা বলেছেন। তখন তিনি প্রথম আলো’তে চাকরি করতেন। দেবদাস দাদা নাকি বাবার কাছ থেকে আমার কথা শুনেছেন।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শেষ দিকেই সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ি। আর মাস্টার্স পাশ করার পর ফুল টাইম সাংবাদিকতা সংবাদ-এ। তখন সংবাদ-এ মঠবাড়িয়ায় কাজ করতেন সংস্কৃতিজন শিবু সা্ওজাল দাদা । এখন কে কাজ করেন ঠিক জানিনা। সেই সময়ে মঠবাড়িয়ায় সংবাদ হয়তো ৮/১০ কপি চলতো। তবে সংবাদের প্রভাব তখনো ছিল ব্যাপক। আমি ১৮ বছর আগের কথা বলছি। সংবাদ এখনো বের হয়। তবে তা এখন ম্রীয়মান।
আমার বাবা তাঁর সন্তানদের নিয়ে গর্ব করতেন। এটা হয়তো সব বাবাই করেন। শুনেছি সংবাদ পত্রিকা তিনি বাজারে চায়ের দোকানে বসেই পড়তেন। আর আমার কোন প্রতিবেদন থাকলে সেটা তিনি সবাইকে পড়ে শোনাতেন। এরপর যুগান্তর, সমকাল, একুশে টিভি। এখন বাংলা ট্রিবিউন-এ হেড অব নিউজ। আর জার্মান টেলিভিশন ও রেডিও ডয়চে ভেলেতে (ডিডাব্লিউ) কাজ করছি প্রায় ১৫ বছর ধরে। দেবদাস দার কাছে শুনেছি, বাবা নাকি তাঁকেই খবর দিতেন,‘ আজ স্বপনের(আমার ডাক নাম) টিভিতে প্রোগ্রাম আছে, সবাইকে একটু দেখতে বলো।’ বাবাও যেন দেবদাস দাকে কী কারণে একটু বেশিই পছন্দ করতেন।
দেবদাস দার হাত ধরেই মঠবাড়িয়াকে আমার চেনা। বাবার চাকরির সুবাদে তার সঙ্গেই দেশের বিভিন্ন উপজেলায় থেকেছি। মঠবাড়িয়ায় আমার শৈশবের কিছু স্মৃতি ছাড়া পড়াশুনার কোন স্মৃতি নাই। আমি এইচএসসি পর্যন্ত বাবা যেখানে চাকরি করতেন সেখানেই পড়েছি। তারপর এইচএসসি থেকে ঢাকায়। তাই মঠবাড়িয়াকে আমার তখন তেমন করে চেনা হয়ে ওঠেনি।
বাবা মারা যাওয়ার পর মঠবাড়িয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেড়ে যায়। বিশেষ করে মা সেখানেই থাকায় এই যোগাযোগটা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু মঠবাড়িয়া গিয়ে আমার প্রধান সঙ্গি হয়ে দাড়ায় দেবদাস দা। তার সঙ্গে নানা আলোচনায় আমি মঠবাড়িয়াকে চিনতে পারি। জানতে পারি এর অনেক কিছু।
আমার একটি হ্যান্ডি ক্যাম আছে। আমি যখনই বাড়ি যাই তখন সেই ক্যামেরাটাও আমার সঙ্গি হয়। আমি দেবদাস দা’র কাছে জানতে চাই ফসলের মাঠে নাকি লবন পানি উঠেছে? বাধ ভেঙ্গে নাকি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে? পানীয় জলের নাকি ব্যাপক সংকট?
দেবদাস দার এগুলো যেন নখ দর্পনে। আমাকে মোটরসাইকলের পিছনে বসিয়ে তিনি নিয়ে যান প্রত্যন্ত অঞ্চলে। লবন পানিতে নষ্ট হওয়া মুগডালের ক্ষেতে আমরা নামি। দেখি কী ভয়ঙ্কর আক্রমণ লবন পানির। বাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় বাধের ভেতরের মানুষ কতটা আতঙ্কে আছেন।
মঠবাড়িয়ার খালটির পানি কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। স্রোত যেন নেই। মাঝে মাঝে খালের প্রস্থ কমে গেছে। আমি দেবদাস দা’র কাছে জানতে চাই এমন কেন হচ্ছে? এটা তো প্রাণ প্রবাহ। দাদা জবাব দেননা চুপ করে থাকেন। আমি বুঝতে পারি। আমাদের মত ছাপোষা সাংবাদিকের কখনো কখনো চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।
একবার আমরা গিয়েছিলাম বন্যার পর সরকারী আর বিদেশী অর্থায়ণে ভূমিহীন এবং দুস্থদের জন্য তৈরি করা টিনের ঘর দেখতে। গিয়ে দেখি কোনটা নদীর ধারে পানিতে ডুবে যায়। আবার কোনটা জনমানবহীন। গরুর খোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। দৈনিক কালের কন্ঠে দেবদাস এনিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছিলেন। শিরোনামটি আমার এখনো মনে আছে-‘ অনেক আশার ঘর নিরাশার জলে।’
বাংলাদেশের গ্রামগুলো এখন আর সেই অর্থে গ্রাম নেই। বিদ্যুৎ গেছে। কলের যানবাহন চলে। আছে মোটর সাইকেলের দাপিয়ে বেড়ান। মঠবাড়িয়াও তার বাইরে নয়।
আমি ছোটবেলা আমাদের গ্রামে থাকতাম( নাগ্রাভাঙ্গা, মিরুখালি), তখনো স্কুলে পড়িনা। মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াই আর কাদাপানিতে মাছ ধরি। তবে বুধবার ছিল আমার কাছে উৎসবের মত। সেই দিন মঠবাড়িয়ায় হাটবার। বড়দের সাথে প্রায়ই হাটে যেতাম, নৌকায় করে। বাজারে দুপুরে হোটেলে ভাত খাওয়া ছিল আমার প্রধান চাওয়া। আর ফিরে আসার সময় জিলাপি নিয়ে আসতাম।
এখন আর সেই শৈশবের মত সব কিছু নেই। থাকেও না। সময় বদলায়, দিন বদলায়। কিন্তু দেবদাসের তোলা ছবি দেখে মনে হয়, না এখনো আছে। এখনো আছে সবুজ সতেজ গ্রাম, ফুল , পাখি আমাদের মঠবাড়িয়া। দেবদাস জানেন, কেথায় চাষী নতুন জাতের বীজ আবিস্কার করেছেন, কোথায় তৈরি হয়েছে বীজ ব্যাংক। আর কেথায় গ্রামবাসী নিজেরাই নদীর স্রোতকে আটকে দিয়ে জনপদ রক্ষা করছেন। দেবদাস জানেন-সবাইকে জানান.. তিনিতো তাদেরই লোক।
দেবদাস দাদাকে যখন হেঁটে যেতে দেখি। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। একজন মানুষ যেন সব কষ্ট লুকিয়ে হাসছেন। সটান হাটছেন কোনও খবরের জন্য, ছবির জন্য। তার পৃথিবীতে যেন কোন হতাশা নেই। নেই কোন চাওয়া পওয়া। যেন শুধুই মানুষের জন্য জীবন।
দেবদাস দাদা মাঝে মাঝে বলেন,‘ আমি ভাই মূর্খ সাংবাদিক। লেখা-পড়া জানি না। আপনাদের ঢাকায় কি আমাদের নেবেন? আমরাতো সেখানে অচল।’
আমি বলি, আপনারা আছেন বলেই আমার মঠবাড়িয়া এখনো তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। তার জীবনটা মরে যায়নি। আমার গ্রাম আমার আছে। আমার প্রাণতো এটাই খোঁজে।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল:[email protected]

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...