ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - সুলতানের স্বপ্ন সাইকেল

সুলতানের স্বপ্ন সাইকেল

 

দেবদাস মজুমদার >

টানা ৩০ বছর ধরে তাঁর সকাল দুপুর সন্ধ্যা কাটে পত্রিকা বিক্রি করে। সেই সাঝ সকালে বাড়ি থেকে বের হন। তারপর ৩০ কিলো মিটার পথ কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো বাস- রিক্সায় চড়ে উপজেলা সদরে আসেন। সংবাদপত্র এজেন্সী থেকে পত্রিকা কিনে নেন। সেই পত্রিকা দিনভর উপকূলের হাট, জনপদের মানুষের কাছে ফেরী করেন তিনি। উপকূলে যারা সংবাদপত্রে কাজ করেন তাদের অতি আপন সংবাদপত্র বিক্রেতা একজন সুলতান আহম্মদ । পঞ্চাশোর্ধ বয়সী সুলতান আহম্মদ হাওলাদার শত অভাব ও কষ্টেও সংবাদপত্রের হকার পেশাটা ছাড়েননি। আগলে আছেন পরম মমতায়। প্রতিদিন চলাচল ও পত্রিকা বহনের জন্য একটা বাই সাইকেলের স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু পত্রিকা বিক্রি করে তিন সদস্যের পরিবারের আহার যুগিয়ে এই স্বপ্ন তাঁর ফিঁকে হয়ে ছিল। সুলতানের ফিঁকে স্বপ্নটা আজ শুক্রবার পূরণ হয়ে যায়। সেই সাথে পত্রিকা পরিবহনের ব্যাগ আর রোদের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতার ব্যবস্থাও হয়।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আজ শুক্রবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম ফরিদ উদ্দিন সংবাদপত্র বিক্রেতা সুলতানের হাতে একটি নতুন বাইসাইকেল ও সংবাদপত্র বহনের উপকরণ তুলে দেন। এসময় তাকে কিছু নগদ অর্থও দেওয়া হয়।
মঠবাড়িয়ার এক তরুণ শিবাজী মজুমদার শিবু তাঁর সামাজিক সাইট ফেসবুকের টাইম লাইনে সংবাদপত্র হকার সুলতানের ছবিসহ একটি স্টাটাস দেন। এরপর সোশাল জার্নালিস্ট গ্রুপ নামে স্থানীয় সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে মঠবাড়িয়ার দুই প্রবাসি মো. সাইদুল হক খান ও মেহেদী হাসান বাবুর আর্থিক সহায়তায় অভাবী সুলতানের জন্য সাইকেল ও পত্রিকা বহনের উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়।
আজ শুক্রবার সোশাল জার্নালিস্ট গ্রুপ এর আহ্বায়ক মোস্তাফিজ বাদলের সভাপতিত্বে মঠবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে আয়োজিত বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম ফরিদ উদ্দিন,প্রেস ক্লাব সভাপতি আবদুস সালাম আজাদী, সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমান, সামাজিক উদ্যোক্তা এম.আর.কে আল আমিন, প্রভাষক এটিএম কাওছার, সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন, সামাজিক উদ্যোক্তা মো. সোহেল রানা ও সংবাদপত্র বিক্রেতা মো. সুলতান আহম্মদ।

স্থানীয়দের সূত্রে জানাগেছে, উপকূলীয় বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের গোলবুনীয়া গ্রামের অতি দরিদ্র সুলতান আহম্মদ হাওলাদার দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে উপকূলীয় পাথরঘাটা ও মঠবাড়িয়া জনপদে সংবাদপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। অভাবী মানুষের মুখ একজন সুলতান। তবু সে দিনভর উচ্ছল আর কর্মমুখর। উপকূলে সংবাদপত্র বিক্রয় করে তার ঘর সংসার চলে। প্রতিদিন পত্রিকা বিক্রি করেন মঠবাড়িয়া শহর থেকে পাথরঘাটার শতকর, লেমুয়া, কাকচিড়া ও মানিকখালী, গুলিসাখালী,বান্ধবপাড়া গ্রাম্যহাট বাজার জনপদে। এই পেশা তাঁর ৩০ বছর ধরে। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয় তার। কখনও বা তারও কম। এতে ভরপেট ভাত না জুটুক তবু সুলতানের প্রতিদন সকাল আসে খবরের কাগজে। সেই সাঁঝ সকালে উপকূলীয় বরগুনার পাথরঘাটার লেমুয়া বাজার থেকে সড়ক পথে মঠবাড়িয়া শহরে আসেন তিনি । তারপর মঠবাড়িয়ার এজেন্টদের নিকট হতে নানা সংবাদপত্র সংগ্রহ করে শুর করেন পত্রিকা ফেরী। পত্রিকা ফেরী করে দিন কাটে উপকূলের পথে পথে । বেশীরভাগ সময়ই তার দুপুরে খাওয়া হয়না। আর বাড়ি ফিরতে রাত নামে তখন হয়ত পরিবারের স্বজনারও ঘুমে। এই হচ্ছে উপকূলের সুলতান।

সম্প্রতি সংবাদপত্র বিক্রেতা সুলতানকে নিয়ে মঠবাড়িয়ার তরুণ শিবাজী মজুমদার শিবু তার ফেসবুক টাইম লাইনে সুলতানকে নিয়ে একটা স্টাটাস দেন । তিনি লেখেন, সুলতানের পত্রিকা বহন ও চলাচলের জন্য একটা জীর্ণ শীর্ণ একটি বাই সাইকেল ছিল। এখন তা নষ্ট হয়ে গেছে। অভাবের সংসার। কলেজ কলেজ পড়–য়া একমাত্র মেয়ে এখন বিবাহযোগ্য। দিনশেষে আয় হয় মাত্র ২০০ -২৫০ টাকা। প্রতিদিনকার তাকে চলতে হয় ৬০/৭০ কিলোমিটার পথ। বাস, রিকসা ভাড়া দেওয়ার পরে কি ইবা থাকে! ৩০ বছরের পেশা। ছাড়তে পারছেন না বয়সের ভার ও মায়ার কারণে। পুরাতন একটি সাইকেল থাকলেও সুলতানের গাড়ি ভাড়া বেঁচে যেত। সংসারের ঘানি টানতেই তো কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি ,সাইকেল কিনবেন কেমন করে! ওই স্টাটাসে সুলতানের সাইকেল স্বপ্নটা ধরা দেয় । সুলতানের জন্য সবকিছু কেনা হয়ে যায়। অত:পর সংবাদপত্র বিক্রেতা সুলতানের স্বপ্ন সাইকেল আজ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয় স্থানীয় সোশাল জার্নালিস্ট গ্রুপ।

সাইকেল ও সংবাদপত্র বহনের উপকরণ হাতে পেয়ে হকার সুলতান আনন্দে কেঁদে ফেলে বলেন, ৩০ বছর ধইরা মায়া পত্রিকার ওপর। ছাড়তে পারিনা। বহু মানুষ কয় সুলতান পত্রিকা বিক্রিতে আর কয় টাকা পাও । অন্যকাজ করো। আমি কারও কথা শুনিনা , ভাবি এই পত্রিকার হকারী আমারে বহু সুখ দিছে। কত সরকারী অফিসার, শিক্ষক সাংবাদিক আর ব্যবসায়ী আমায় চেনেন । ভালবেসে ডাকেন পত্রিকা সুলতান। এই সুখ, এই আনন্দ। নতুন সাইকেলের স্বপ্নটা আমার পুরণ হয়ে গেছে। যারা আমারে সহায়তা দিলেন তাদের মঙ্গল হোক।

সোশাল জার্নালিস্ট গ্রুপ এর আহ্বায়ক মোস্তাফিজ বাদল বলেন, আমাদের উপকূলে সুলতানের পরিচিতি পত্রিকা সুলতান নামে। একটা সাইকেলের অভাবে তার সংবাদপত্র পরিবহন ও চলাচলে দারুণ কষ্ট যাচ্ছিল। আজ সে কষ্ট তার দূর হয়ে গেল।

সংবাদপত্র বিক্রেতার স্বপ্ন সাইকেল পূরণের মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মো. খায়রুল আলম সেখ এ মহতী উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এমন সামাজিক উদ্যোগ সত্যিই একটি প্রশংসনীয় কাজ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...