দেবদাস মজুমদার > গাজীপুরে গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত কারারক্ষী সুবেদার রুস্তম আলী জমাদ্দারের (৬৫) গ্রামের বাড়িতে এখন সুনশান নীরবতা। পাকা বসতঘরটিও এখন তালাবদ্ধ। গত ৫ বছর পূর্বে বসতঘরটি নির্মাণ করে দেখাশোনার জন্য মাহ্ফুজা বেগম (২৫) নামে এক দিনমজুর নারীকে নিয়োগ করে যান। এখন সেই বাড়িতে পরিবারের স্বজনরা কেউ নেই। গতকাল সোমবার গাজীপুরে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন কারা রক্ষী রুস্তুম আলী। দুপুর ১২টার দিকে এ খবর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী চড়কগাছিয়া গ্রামবাসি জানতে পারেস। একই গ্রামে বসবাস করেন তার বোন লতিফুন বেগম (৫৫) তিনি ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তাৎক্ষনিক ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে যান। এখন পরিবারের স্বজন বলতে আর কেউ গ্রামে নেই।
সোমবার (২৫ এপ্রিল) বিকাল ৪টার দিকে মঠবাড়িয়া শহর হতে ১৪ কি: মি: দূরে চড়কগাছিয়া গ্রামে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,নিহত রুস্তুম আলীর বসত ঘরটি তালাবদ্ধ। তবে তার হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে শোকার্ত গ্রামবাসি বাড়িতে ভিড় করেন। এসময় সত্তোরোর্ধ বয়সী প্রতিবেশী চাচী আমেনা বেগম কাঁদছিলেন। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমাগো রুস্তুম অনেক ভালমানুষ আছিল। গ্রামে কারো লগে হ্যার কোন শত্রুতা আছিলনা। আহারে এই ভাল মানুষটারে এইভাবে মারলো !
নিহত রুস্তুমের চাচাত ভাই রুহুল আমিন জানান, রুস্তুম আলী চড়কগাছিয়া গ্রামের মৃত মন্নান জমাদ্দার ও মা মৃত শাফিয়া বেগমের ৭ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। ২৫ বছর আগে তার বাবা মা মারা যান। ভাই বোনের মধ্যে কেবল বোন লতিফুন বেগমই ঐ একই গ্রামে বসবাস করেন। তিনি ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে যান। পরিবারের স্বজন বলতে এখানে আর কেউ নেই। রুস্তুমের এমন মৃত্যুতে চড়কগাছিয়া গ্রামবাসি শোকার্ত।
তিনি আরও জানান রুস্তুমের বড় বোন খাদিজা বেগম গত ৫ মাস আগে মারা গেলে তখন বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। এ সময় তিনি বোনের কুলখানীতে গ্রামবাসিকে দাওয়াত করে জিয়াফতের আয়োজন করেন। এ সময় তিনি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরুকরেন। মসজিদটি নির্মানের আগেই তাকে নিহত হতে হল। এমন মৃত্যুতে পুরো গ্রামবাসি ব্যাথিত।
স্থানীয় বৃদ্ধ হাফিজুর রহমান (৬০) বলেন, রুস্তুম অনেক ভাল মানুষছিল। গ্রামে পাকা মসজিদ নাই। আমরা রুস্তুমকে অনুরোধ করছিলাম একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য। তিন দিনের মধ্যেই মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরুকরে দেন রুস্তুম। গ্রামের অনেক অসহায় মানুষকে সাহায্য করত রুস্তুম। রুস্তুমের লাশ যেন গ্রামের বাড়িতেই দাফন কর াহয় এই দাবী শোকার্ত গ্রামবাসীর।
সাপলেজা ইউনিয়নের ইউ.পি. সদস্য মো. মাহবুব আলম জানান, নিহত রুস্তুমের পরিবার একসময় খুব অভাবে ছিল। অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে তিন ভাই চাকুরীতে প্রবেশকরে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনেন। তবে কর্মের কারনে গ্রামের বাড়িতে কেউ বসবাস করেননা। আমরা দুপুর বেলা লোক মূখে শুনেছি গাজিপুরে সে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছে। এখন তার লাশ গ্রামের বাড়িতে আসার প্রতীক্ষায় গ্রামবাসী।
চড়কগাছিয়া গ্রামে নিহত রুস্তুমের বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা দিনমজুর গৃহবধূ মাহফুজা বেগম তার স্বামী ও তাদের ৪ বছরের শিশুকন্যা মরিয়মকে নিয়ে ৫ বছর ধরে বসবাস করছেন।
মাহফুজা বেগম বলেন, দুপুর বেলা আমার মাইয়া খবর দিছে, আম্মা লতিফুনবু কান্দে (নিহত রুস্তুমের বোন)। দৌড় দিয়া হ্যার বাড়ি গেছি। যাইয়া হুনি রুস্তুম চাচারে কারা যেন গুলি দিয়া মারছে।
গত তিন মাস আগে হে আমারে মোবাইলে কল দিয়া খোঁজ খবর লইছে। মসজিদের কামে একবার বাড়িতে আসার কথা আছিল। তয় জীবিত আর আইবোনা। অহন হ্যার লাশ যেন নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে।
> যেভাবে রুস্তম আলীি নিহত হলেন <
সোমবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগারের সামনের জেলখানা সড়কের পাশের আহমেদ মেডিসিন কর্নার থেকে ওষুধ কিনে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন রুস্তম আলী। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে করে ৩০-৩৫ বছর বয়সী তিন যুবক ঘটনাস্থলের কাছে এসে থামে। তাদের মধ্যে দুজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে একজন অস্ত্র উঁচিয়ে রুস্তম আলীর পেছনে অবস্থান নেয়। অন্যজন খুব কাছ থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে পাঁচ-ছয় রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়ে রুস্তম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওই দুই যুবক মোটরসাইকেলে উঠে কারাগার সড়ক দিয়ে কোনাবাড়ীর দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়।
নিহত রুস্তম আলীর বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার চকরগাছিয়া গ্রামে। তিনি ২০১৩ সালের জুনে কাশিমপুর কারাগারে যোগ দেন। গত ৪ নভেম্বর তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে যান। ছুটিতে যাওয়ার আট দিন আগে তিনি কারা সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর পদে পদোন্নতি পান। পরিবার নিয়ে তিনি গাজীপুরের কোনাবাড়ীর কাশিমপুর কারাগার কমপ্লেক্সের কারা কোয়ার্টারে থাকতেন। তাঁর এক ভাই শাহ জামাল পুলিশের চাকরি করেন। আরেক ভাই শাহ আলম গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ঝুট ব্যবসা করেন।
অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার চার দিন আগে রুস্তম আলী কাশিমপুর মহিলা কারাগারে যোগ দিয়েছিলেন।
সূত্র > দৈনিক কালের কণ্ঠ