ব্রেকিং নিউজ
Home - জাতীয় - মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটি গঠন কার্যক্রম ও রাজাকার নিয়োগের ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটি গঠন কার্যক্রম ও রাজাকার নিয়োগের ইতিহাস

১৯৭১ সালের ৪ মে পূর্বাহ্নে কর্নেল অাতিক মালিক, ক্যাপ্টেন এজাজ অাহমেদ ও ক্যাপ্টেন অাব্দুল মালেক এর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল পিরোজপুর শহর দখল করে।মঠবাড়িয়ার মুসলিম লীগ নেতা এবং সাবেক এম.পি.এ. মোঃ অাব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার এর পরামর্শে মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা কন্ট্রোলরুমের অধিনায়ক এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য সূর্যমনি গ্রামের ফখরুদ্দিন মুন্সী বিশ্বাস ঘাতকতা করে ৫ মে পূর্বাহ্নে কন্ট্রোলরুমের অস্ত্র শস্ত্র মঠবাড়িয়া পুলিশ সার্কেল প্রধান কাজী জালাল উদ্দিনের কাছে জমা দিলে মঠবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সওগাতুল অালম সগীর এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে অাত্মগোপন পরে ভারতে চলে যান।

১৯৭১ সালের ৭ মে পিরোজপুরের মুসলিম লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ মোহম্মদ অাফজাল এর নেতৃত্বে ৪১ সদস্য বিশিষ্ট পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয় (দৈনিক অাজাদ,৮ মে ১৯৭১)।মঠবাড়িয়ার মুসলিম লীগ নেতা এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ১৯৭১ সালের ৮ মে ৯৪ বছর বয়স্ক খান সাহেব হাতেম অালী জমাদ্দারকে সভাপতি করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটি গঠন করেন।কমিটির বিবরণ নিম্নে দেয়া হলোঃ
১।খান সাহেব হাতেম অালী জমাদ্দার-সভাপতি।
২।এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ার -সিনিয়র সহ-সভাপতি।
৩।অাজাহার উদ্দিন মৃধা(টিকিকাটা ইউনিয়ন)-সহ সভাপতি।
৪।ডাঃ অানিসুর রহমান (মঠবাড়িয়া থানা জামায়াত ই ইসলামীর অামির)- সহ সভাপতি।
৫।অাব্দুল কাদের মুন্সী(অামড়াগাছিয়া ইউনিয়ন) -সহ সভাপতি।
৬।অাব্দুল জব্বার কাঞ্চন মিয়া(বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়ন)- সহ সভাপতি।
৭।অাব্দুল মজিদ মুন্সী (ধানীসাফা ইউনিয়ন)-সহ সভাপতি।
৮।মোজাম্মেল হক কেদার মিয়া(মঠবাড়িয়া ইউনিয়ন) -সাধারণ সম্পাদক।
৯।নাসির উদ্দিন মঞ্জু (মঠবাড়িয়া ইউনিয়ন)-যুগ্ম সম্পাদক।
১০।মোঃ শাহাদাত হোসেন(সাপলেজা ইউনিয়ন) -সাংগঠনিক সম্পাদক।
১১।মোশারেফ হোসেন(মঠবাড়িয়া ইউনিয়ন) -কোষাধ্যক্ষ।
১২।অাব্দুল লতিফ অডিটর(টিকিকাটা ইউনিয়ন) -অফিস সম্পাদক।

১৩।জুলফিকার অালী শরীফ,চেয়ারম্যান, তুষখালী ইউনিয়ন -সদস্য।
১৪।ফখরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, মিরুখালী ইউনিয়ন -সদস্য।
১৫।নূরুল ইসলাম তালুকদার,চেয়ারম্যান, দাউদখালী ইউনিয়ন – সদস্য।উল্লেখ্য,তিনি মে মাসের শেষ দিকে তাঁর ইউনিয়নের প্রবীণ মেম্বর ফজলে অালী খানের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে বরিশাল শহরে বসবাস করেন।
১৬।অাব্দুল মজিদ বয়াতী,চেয়ারম্যান, টিকিকাটা ইউনিয়ন -সদস্য।
১৭।অাবুল হাসেম ধলু মিয়া,চেয়ারম্যান, অামড়াগাছিয়া ইউনিয়ন -সদস্য।
১৮।নুরুল হোসেন মৃধা,প্রাক্তন চেয়ারম্যান, সাপলেজা ইউনিয়ন -সদস্য।উল্লেখ্য, সাপলেজা ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ডাঃ গোপাল কৃষ্ণ গুহরায়ের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান লুটপাট হওয়ায় কয়েকদিন আত্মগোপনে থেকে ভারতে চলে যান।ইতোমধ্যে এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের চাচাতো ভাই অাব্দুল বারী কবিরকে চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়।
১৯।বাহার অালী হাওলাদার, প্রাক্তন চেয়ারম্যান, হলতা গুলিসাখালী ইউনিয়ন – সদস্য।উল্লেখ্য,হলতা গুলিসাখালী ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান,ডাঃ শামসুল অালম (সওগাতুল অালম সগীরের জেষ্ঠ্য ভ্রাতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় বাহার অালী হাওলাদার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
২০।অামীর হোসেন মৃধা,বড়মাছুয়া ইউনিয়ন -সদস্য।
২১।ইসাহাক অালী হাওলাদার,( মঠবাড়িয়া ইউনিয়ন) -সদস্য।উল্লেখ্য,খান সাহেব হাতেম অালী ছাড়া শান্তি কমিটির সদস্যরা মুসলিম লীগ তথা এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের সমর্থক ছিলেন।
অতপর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির অধিকাংশ সদস্যের উসকানি এবং নেতৃত্বে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, লুটতরাজ,অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি হতে থাকে।এহেন অবস্থায় ১২ মে অপরাহ্নে খান সাহেব হাতেম অালী জোমাদ্দারের সভাপতিত্বে মঠবাড়িয়ায় থানা শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।সভায় এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ার পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন।বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি হিন্দুদের বিপক্ষে বলেন।হিন্দুরা মুসলমান না হলে তাদের নিরাপত্তা দিতে তিনি অপারগ।মুসলমান না হলে তারা ভারতে চলে যেতে পারেন।সভায় ডাঃ অানিসুর রহমান,মোজাম্মেল হক কেদার মিয়া,শাহাদাত হোসেন প্রমূখ পাকিস্তান রক্ষার জন্যে বক্তৃতা করেন।সভাপতির ভাষণে খান সাহেব হাতেম অালী জোমাদ্দার বলেন,হিন্দুরা হিন্দুই থাকবে।তাদেরকে জোর করে মুসলমান করা যাবেনা।তারা এদেশের নাগরিক এদেশেই থাকবে।হিন্দুদের ঘর-বাড়ি,দোকানপাট, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি না করার জন্য শান্তি কমিটির সদস্য ও মুসলমানদেরকে অনুরোধ জানান।

এদিন সন্ধ্যায় এম.এ.জব্বার ইঞ্জনিয়ারের সভাপতিত্বে থানা শান্তি কমিটির এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা খান সাহেব হাতেম অালী জোমাদ্দারের পরিবর্তে এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে সভাপতি এবং মোজাম্মেল হক কেদার মিয়ার পরিবর্তে খান সাহেবের কনিষ্ঠ পূত্র অাজিজুল হক বাবু মিয়াকে সম্পাদক মনোনীত করেন।অাজিজুল হক বাবু মিয়ার দায়িত্ব ছিল নাগরিকত্ব ও চারিত্রিক সনদপত্রে স্বাক্ষর করা।

থানা শান্তি কমিটির সভাপতি এম.এ. জব্বার ইন্জিনিয়ার এবং মঠবাড়িয়া পুলিশ সার্কেল প্রধান কাজী জালাল উদ্দিনের নির্দেশে এ.এস.আই. মাহবুবুর রহমান এর নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ ১৩মে রোজ বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে ধানিশাফা ইউনিয়নের ফুলঝুড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য হাবিলদার আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস এবং নায়েক আব্দুল মোতালেব শরীফ এর নিকট থেকে অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে তাদের সাথে সংঘর্ষ হয় এবং সংঘর্ষে এ.এস.আই মাহবুব সহ ৩ জন পুলিশ, স্থানীয় চৌকিদার জবেদ আলি এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব শরীফ নিহত ও আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস গুরুতর আহত হন। উল্লেখ্য, আব্দুর রাজ্জাককে চিকিৎসার জন্যে তার স্ত্রী নূরজাহান বেগমের বোনের বাড়িতে (তুষখালী ইউনিয়নের জানখালী গ্রাম) গোপনে নেয়া হয়। চিকিৎসার অভাবে কয়েক দিন পর তিনি মৃত্যু বরণ করেন। থানা শান্তি কমিটির সভাপতি এম.এ. জব্বার ইন্জিনিয়ার বিষয়টি পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতিকে অবহিত করলে ১৫ মে রোজ শনিবার ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ এর নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জন পাক সৈনিক শান্তি কমিটির লোকের সহায়তায় ফুলঝুড়ি গ্রামে এসে শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মাঝের পুলের ইয়াছিন শরীফের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মঠবাড়িয়া বাজারের হিন্দুদের দোকান লুটপাট, দক্ষিণ মিঠাখালির সিকদার বাড়ি,বড় মাছুয়ার মোল্লা বাড়ি ও ফকির বাড়ি এবং গুলিসাখালির মিয়া বাড়ি এবং উত্তর কবুতরখালীর হিন্দুদের ঘর বাড়ি ও দক্ষিণ গুলিসাখালির মমিন উদ্দিন ও তছিল উদ্দিন হাওলাদারের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। খান সাহেব হতেম আলী ঘর বাড়ি লুটপাট ও না পোড়ানোর জন্যে ক্যাপ্টেন এজাজকে অনুরোধ জানান। কিন্তু ক্যাপ্টেন এজাজ তার অনুরোধ আমলে নেয়নি। মিঠাখালি, মঠবাড়িয়া, আংগুলকাটা
ও পাতাকাটা গ্রামের অনেক হিন্দু খান সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।

সাপলেজা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ও মঠবাড়িয়া শান্তি কমিটির সদস্য নূরুল হোসেন মৃধা এবং থানা শান্তি কমিটির অর্গনাইজিং সেক্রেটারি মোঃ শাহাদাত হোসেন এর নেতৃত্বে চার শতাধিক মানুষ ২২ মে রোজ শনিবার নলী গ্রামের বাড়ই বাড়ি লুটপাট করতে আসলে এলাকার হিন্দুদের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। এ সংঘর্ষে ১৪ জন হিন্দু ও এক জন শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়। অতঃপর শান্তি কমিটির সদস্যরা বাড়ই বাড়ি সহ ৭০ টি হিন্দু বাড়ি লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়। শান্তি কমিটি শান্তির নামে দেশে চরম অশান্তি সৃষ্টি করে। অনেক হিন্দু প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে চলে যায়।

কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অনুরোধে ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের ২ জুন পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করার পরপরই মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটি রাজাকার বাহিনীতে লোক ভর্তি শুরু করে।উত্তর মিঠাখালীর ডাক্তার হেমায়েত উদ্দিনকে রাজাকার বাহিনীতে লোক ভর্তি করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।মাদ্রাসার শিক্ষক,ছাত্র, মুসলিম লীগ তথা এম.এ.জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের কর্মী,জামায়াত ই ইসলামি ও ইসলামি ছাত্র সংঘের সদস্যরা,এলাকার টাউট,বাটপার,মাস্তান,সুবিধাভোগী ও গরীব যুবকরা এ বাহিনীতে ভর্তি হয়।মঠবাড়িয়ায় রাজাকার বাহিনীতে ৫ শতাধিক সদস্য ছিল।এমন কোনো অনৈতিক কাজ নেই যা রাজাকার বাহিনী করেনি।

মঠবাড়িয়ায় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলঃ
১।অাব্দুস সামাদ তালুকদার (বকসির ঘটিচোরা)।
২।এস্কান্দার অালী মৃধা(সেনের টিকিকাটা)।
৩।মাওলানা অাব্দুল হক মৃধা(সেনের টিকিকাটা)।
৪।মোসলেম অালী মুন্সী(ফুলঝুড়ি)।
৫।হেমায়েত উদ্দিন সুফী(অালগী)।
৬।শামসুল আলম মৃধা ( সেনের টিকিকাটা)
৬।অালী হোসেন(কুমিরমারা)।
উল্লেখ্য,১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর তুষখালী খাদ্য গুদাম অভিযানের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধাদের অাহবানে অালী হোসেন তার দল সহ অাত্মসমর্পন করেন।অতপর লেঃ জিয়া উদ্দিনের নির্দেশে অালী হোসেন সুন্দরবনে ষ্টুডেন্ট ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজাকার বাহিনীর জল্লাদ ছিলোঃ
১।অাব্দুল গণি জমাদ্দার (চরকগাছিয়া)।
২।অাব্দুর রহমান (দঃ মিঠাখালী)।
৩।রুহুল অামীন (পাতাকাটা)।
স্বাধীনতাকামী স্থানীয় জনগণের সাথে অালোচনায় জানা গেল, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে থানা শান্তি কমিটির সদস্য অাবুল হাশেম ধলু মিয়া ও অাব্দুল জব্বার কাঞ্চন মিয়া গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করেন এবং সুন্দরবনে মাঝে মাঝে খাদ্য সরবরাহ করতেন।থানা শান্তি কমিটির সদস্য অাব্দুল মজিদ বয়াতী ও এসাহাক অালী হাওলাদার নিস্ক্রিয় ছিলেন।অাব্দুল মজিদ মুন্সী কর্তৃক কারো ক্ষতি না হলেও তার সেক্রেটারী অামির হোসেন কেরানী কর্তৃক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নূর হোসাইন মোল্লা

প্রাক্তন শিক্ষক লেখক ও গবেষক।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...