ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য রাতে ঢাকা সেনানিবাসে কি ঘটেছিল?

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য রাতে ঢাকা সেনানিবাসে কি ঘটেছিল?


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য রাতে ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। এর আগে দুই দিন যাবত জাসদ সেনানিবাসে খালেদ মোশাররফ বিরোধী লিফলেট বিতরণ করে। লিফলেটে তাঁকে ভারতের দালাল ও দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয় যে, তিনি বাকশাল কায়েম করতে চায়। এ সময়ে জাসদের গণ বাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্হা বেশ তৎপর হয়। জাসদ নেতা লেঃ কর্ণেল ( অবঃ) আবু তাহের বার দফা প্রণয়ন করে সৈনিকদেরকে বিদ্রোহ করতে আহবান জানান। দফাগুলো নিন্মে বর্নিত হলোঃ
১/ আমাদের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্যে,শুধুমাএ নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্যে নয়।আপনাকে আমরা আমাদের বিপ্লবের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছি। সেজন্যে আপনাকে স্পষ্ট ঘোষণা করতে হবে ,আপনি সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তন করে দরিদ্র শ্রেণির নেতৃত্ব দিবেন।বহু বছর ধরে আমরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্যে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছি। ধনিক শ্রেণী তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আমাদেরকে ব্যবহার করেছে। ১৫ আগস্টের ঘটনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের এবারের সংগ্রাম ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্যে নয়। আমরা জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে বিদ্রোহ করছি। এখন থেকে সশস্ত্র বাহিনীর আপামর জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার জন্যে নিজেদেরকে গড়ে তুলবে।
২/ সব রাজবন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
৩/ দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশী ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা ফেরত আনার ব্যবস্হা করতে হবে এবং তা উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করতে হবে।
৪/ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সকল পার্থক্য দূর করে নিজ নিজ কাজ ও ক্ষমতা অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৫/ সিপাহীদের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের অফিসার হিসেবে কমিশন দিতে হবে। ক্যাডেট কলেজ ও পাবলিক স্কুল থেকে পাশ করা ব্যক্তিদের অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না।
৬/ প্রতিরক্ষা সার্ভিসে ঔপনিবেশিক আমলের প্রচলিত রীতি – নীতি বর্জন করে অবিলম্বে অমানবিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
৭/ সিপাহীদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে এবং অবিলম্বে বাসস্থানের ভাড়া কর্তন বন্ধ করতে হবে।
৮/ বিলম্বে অফিসারদের ব্যক্তিগত চাকর হিসেবে ব্যবহ্নত ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করতে হবে।
৯/ ঢাকা সেনানিবাসে বিপ্লবী সেনা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
১০/ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সশস্ত্র বাহিনীর কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণী সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কিত যে কোন সিদ্ধান্ত এ সংস্হার সাথে আলোচনাক্রমে গ্রহণ করবেন।।
১১/ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা অন্যান্য সেনা নিবাসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং বিপ্লবী ছাএ,কৃষক,শ্রমিক ও জনসাধারণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করবে।
১২/ এ বিপ্লবী সেনাবাহিনী প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ছাএ,কৃষক ও শ্রমিকদের সাথে একযোগে কাজ করে সকল সামাজিক বিপ্লব তরান্বিত করার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেঃ কর্ণেল আবু তাহের প্রনীত বার দফায় এ দেশের মানুষের আশা আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়নি। বার দফা ছিল সেনানিবাস কেন্দ্রিক। এতে ছিল শুধু ঘৃনা,হিংসা আর বিদ্বেষ।

জাসদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে জাসদের কারণে একদিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন নি। তারা আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা, কর্মী সাধারণ মানুষ খুন,ডাকাতি, থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি , ব্যাংক লুটসহ এমন কোন কাজ নেই যা তারা করেনি। জাসদ গণ বাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে বঙ্গবন্ধু বিরোধী তৎপরতা শুরু করে।
৭ নভেম্বর মধ্য রাতে সৈনিকরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। এরপর তারা সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই, সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর কোন অফিসার নাই, এ স্লোগান দিয়ে সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে পড়ে এবং অফিসারদের হত্যা করতে শুরু করে। সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল নুরুল হুদা,লেঃ কর্ণেল এ,টি,এম,হায়দার, মেজর ডাঃ করিম, মেজর আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, ক্যাপ্টেন ডাঃ সিতারা বেগম, ডাঃ চেরী ,ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, লেঃ মোস্তাফিজুররহমান লেঃ সেকান্দার সহ অন্তত বার জন অফিসার কে হত্যা করে।
এ হত্যাকান্ডে সেনানিবাসে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অফিসাররা তাদের পরিবার সহ সেনানিবাস ত্যাগ করে নিরাপদ স্হানে আশ্রয় নিতে থাকে। বিদ্রোহ দ্রুত সেনানিবাস ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী সৈনিকরা যত্র তত্র আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ ও মুহুর্মুহু স্লোগানে সেনানিবাস এলাকা কম্পমান করে তুলে। সুবেদার আনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে একদল সৈনিক রাত একটার পর চারদিন গৃহবন্দী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে বিজয় উল্লাস করতে করতে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি সদর দফতরে নিয়ে আসেন।তিনি উপস্থিত সৈনিকদের সাথে গভীর আনন্দের সাথে আলিঙ্গন করেন এবং সৈনিকদের উদ্দেশ্য বলেন যে, আমি রক্তপাত চাই না। তিনি সবাইকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করেন এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
সৈনিকদের একটি দল ঢাকা বেতার ভবন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারা বলে যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব শুরু হয়েছে। বেতার ভবনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের সাথে যোগ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে।
৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে পাঁচটায় কর্ণেল আবু তাহের ২য় ফিল্ড আর্টিলারি সদর দফতর আসেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান আবেগ আপ্লুতভাবে কর্ণেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে বলেন যে, Thank you, Taher, you have saved the nation. কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াকে ঢাকা বেতার ভবনে গিয়ে ভাষণ দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু নিরাপত্তার জন্যে তিনি বেতার ভবনে যাননি। কর্ণেল তাহের এতে মনঃক্ষুণ্ন হন। উপস্থিত কেউই তাঁকে আমল দেননি। তখন জেনারেল জিয়ার একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ রেকর্ড করা হয় এবং তা ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তিনি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন এবং নিজ নিজ কাজে যোগদান করতে বলেন।
এরপর কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াকে শহীদ মিনারে গিয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশ্য ভাষণ দিতে অনুরোধ জানান। তাহের এর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রণীত বার দফা দাবী স্বীকার করিয়ে নেয়া। জেনারেল জিয়া তাঁর অনুরোধ আমলে নেননি। কর্ণেল তাহের হাল ছাড়েন নি।দুপুরের দিকে জেনারেল জিয়াকে বেতার ভবনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।সেখানে উপস্থিত সৈনিকদের সামনে বার দফা সম্বলিত কাগজটি অনুমোদনের জন্যে জেনারেল জিয়া এর সামনে এগিয়ে দেন।জেনারেল জিয়া অনেকটা বাধ্য হয়ে তাতে স্বাক্ষর করেন এবং তাদের চাপে বেতারে ভাষণ দেন। তবে তিনি সুকৌশলে বার দফা দাবীর বিষয়টি এড়িয়ে যান।ভাষণে তিনি জনগণকে ধন্যবাদ জানান। উল্লেখ্য,মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জিয়া ও তাহের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কর্ণেল তাহের ১১ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আহত হলে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ এ সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। আবু তাহের অবসর গ্রহণের পরও জেনারেল জিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখতেন।কর্ণেল তাহের এবং জাসদ নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে সুচতুরভাবে ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু জাসদের নেতারা ব্যর্থ হন। এরপর জাসদ তার বিপ্লবী বাহিনী দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উৎখাতের চেষ্টা করেন। জেনারেল জিয়া তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাহেরকে ফাসি দেয়া হয়। জাসদ নেতা মেজর এম,এ,জলিল, আবদুর রব, কর্ণেল তাহের এর দুই ভাই- আবু ইউসুফ খান ও আনোয়ার হোসেন খান, হাসানুল হক ইনু, মেজর জিয়া উদ্দিন সহ তের জন জাসদ নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
১৯৭৫ সাল আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রক্তক্ষরণের বছর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে,কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ,কর্ণেল নুরুল হুদা, লেঃকর্ণেল এ,টি এম,হায়দার সহ অনেক নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে দেশের মাটি। জাসদ একটি হঠকারী রাজনৈতিক দল। হঠকারী কর্মকাণ্ডের জন্যে ফাঁসি দেয়া হয় জাসদ নেতা বীর উত্তম লেঃ কর্ণেল আবু তাহের খান কে।৭ নভেম্বর ছিল জাসদ এর তথাকথিত শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের আবরণে ক্ষমতা দখলের এক হীন চক্রান্ত।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...