ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। এ হত্যাকান্ড বিশ্বের বিবেকবান ব্যক্তিগণের অনুভূতিতে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছে। হত্যাকারীরা এ দিন বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং তাঁর নিকটতম আত্মীয় ১৫ জনসহ মোট ২০জনকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর গঠিত সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় বিপথগামী জুনিয়র অফিসার এবং চাকুরীচ্যূত মেজর –সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আবদুর রশিদ, বজলুল হুদা, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম এর নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এ হত্যাকান্ড মূলত সেনা বিদ্রোহ ছিল না। এটা ছিল দেশী ও বিদেশীদের ষড়যন্ত্র। এ হত্যাকান্ড জাতির ইতিহাসে কলংক ও বেদনাময়।সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক। আমরা ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করছি।
আমি অবাক হই যে, চাকরিচ্যূত এবং অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন জুনিয়র অফিসার ঢাকায় এত বড় একটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড কিভাবে ঘটাতে সক্ষম হল। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড না থাকায়, খন্দকার মোস্তাক ও কতিপয় বাকশাল নেতার সমর্থন এবং প্রশাসনে স্বাধীনতা বিরোধী লোক থাকায় এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সেনা প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বিষয়টি জেনেও বিদ্রোহ দমনের কোন চেষ্টা করেন নি।
১৫ আগষ্ট এ নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের কারণ সম্পর্কে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বলেনঃ
১. সে সময়ে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সেনাবাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ে।
২. কোনরূপ পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই বাছাই না করে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দান।
৩. সেনাবাহিনীতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অযোগ্য অধিনায়কত্ব।ফলে হত্যাকারীরা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্যে সাধারণ সৈনিকদের বিপথগামী করতে সক্ষম হয়।
৪. এ পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটানোর পূর্বে নৈশ প্রশিক্ষণের নামে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছয় শতাধিক সৈন্য কুর্মিটোলা নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হল।স্বভাবতই এ নৈশ প্যারেডের সময়ে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের অফিসারগণ এ প্রশিক্ষণে উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু কোন অফিসার উপস্থিত ছিলেন না।
৫. রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার ব্যবস্হা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সামরিক সচিব এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার। কিন্তু নিরাপত্তার ব্যবস্হা ছিল না।
৬. সেনানিবাস এবং রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশেপাশে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাদের নজর রাখার কথা।কিন্তু কেউই নজর রাখে নি।
৭. কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে প্রথম ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্হা করা ঠিক হয় নি। ঐ প্রথম আর্টিলারির ঐ ইউনিটের অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন হত্যাকারী মেজর বজলুল হুদা। ফলে প্রহরারত সৈনিকদের সে ধোঁকা দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে অনায়াসে রাষ্ট্রপতির বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সেনাপ্রধান খবর পাওয়ার পরপরই বিদ্রোহীদের দমন করার ব্যবস্হা গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান ব্যবস্হা করেন নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তননের পর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রষ্টের সাথে বঙ্গবন্ধুর এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২সালের ১৮জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনে “ডেভিড ফ্রষ্টঃ প্রগ্রাম ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ ঐতিহাসিক ও মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকারটি পরিবেশিত হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহনের শুরুতেই ডেভিড ফ্রষ্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮টায় আপনি জেনেছিলেন, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু আপনি বাড়ি ত্যাগ করেননি।আপনি গ্রেফতার বরণ করেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ত্যাগ না করে অন্য কোথাও গেলেন না? কেন এ সিদ্ধান্ত?
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের সব মানুষকে হত্যা করবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি মরি তাও ভালো, তবুও আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক। বলা আবশ্যক যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১ঃ৩০ মিনিটে “অপারেশন সার্চ লাইট” শুরু হওয়ার আগে সন্ধ্যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনা অফিসারদেরকে বলেন,”দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্যে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে হলেও এটা একটা খুব বড় বিষয় নয়। লেঃজেনারেল টিক্কা খান বলেন, আমি বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়। নিষ্ঠুর জেনারেল টিক্কা খান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেননি। হত্যা করেছে তাঁর গঠিত সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী জুনিয়র অফিসার ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান লন্ডনের সানডে টাইমস পএিকায় ১৯৭৬ সালের ৩০ মে ” I helped to kill Mujib, dare you put me on trial” শিরোনামে একটি প্রবন্ধে লেখেন যে, পাঁচটি কারণে আমি (সৈয়দ ফারুক রহমান) শেখ মুজিবকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিঃ
১/ শেখ মুজিব তাঁর কিছু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন। তাঁর দলের একজন তরুণী নববধূকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে। সেই অপরাধীকে শেখ মুজিব রক্ষা করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিকট সুবিচার চাওয়া হলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
২/৷ শেখ মুজিব জাতিকে দাসে পরিনত করার জন্যে ক্ষমতা গ্রহণ করে অনাবশ্যকভাবে সংবাদ পএ ধ্বংস, জাতীয় সংসদের ক্ষমতা হ্রাস করে রাবার স্ট্যাম্পে পরিনত এবং হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও কারাবন্দী করেছেন।
৩/ শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবার, তাঁর দল ও দুর্নীতিপরায়ন সরকারি কর্মকর্তারা দেশকে লুন্ঠন করেছেন।
৪/ শেখ মুজিবের দুর্নীতি এবং ব্যর্থ প্রশাসন দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিনত করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে ঘৃণার পাএে পরিনত করেছেন।
৫/ শেখ মুজিব তাঁর ধর্ম ইসলামকে বর্জন করে ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।এ জন্যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যাকারী মেজর সৈয়দ ফারুক রহমানের এ অভিযোগ সঠিক নয়। সে বিদেশী চর হিসেবে কাজ করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। নিজে বাঁচার জন্যে এ নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের সমর্থনে সে এসব বাজে যুক্তি দেখিয়েছে।লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ” বাংলার ডাক ” পএিকার সম্পাদকের কাছে ১৯৭৮ সালের ১৮ জুলাই মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান বলেন যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করার জন্যে সে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছে।
এ হত্যাকান্ডের যাতে বিচার না হয় সেজন্যে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারী করেন এবং ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে অনুমোদন দিয়ে এটির নব জীবন দান করেন। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের অভিযোগ দায়ের করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রহিত হলে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ গোলাম রসুলের আদালতে ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচার শুরু হয় এবং ১৫০ দিন শুনানির পর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপীল হলে ২০০১ সালে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ১২ জন অফিসারের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে বেসামরিক আসামীদেরকে বেকসুর মুক্তি দিয়ে হাই কোর্ট রায় প্রদান করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল হলে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপীল খারিজ হলে ১২ জন আসামীর মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে।
আদালতের বিচারে সৈয়দ ফারুক রহমান সহ বারো জনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে এবং এ পর্যন্ত নিন্মোক্ত ছয় জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে – মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমেদ , এ,কে,এম, মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা ও ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ। মেজর আবদুল আজিজ পাশা জিম্বাবুয়ে পালাতক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে। অবশিষ্ট পাঁচজন মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, নুর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
এ হত্যাকান্ডের পেছনে দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্র ছিলো। মেজর ডালিম ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে কলকাতায় গিয়ে সি, আই, এ, এর কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনের সাথে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে কামনা করেন। বিদেশীদের মধ্যে ছিলো পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়া ও চীন। দেশের মধ্যে ছিলো বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সিনিয়র সদস্য খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, প্রবাসী মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী এবং বাকশালের কতিপয় নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে,এম, ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জু প্রমুখ। দেশের সামরিক,ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের জ্ঞাতসারে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যেমূলক প্রতিশোধ এবং রাষ্টীয় আাদর্শ বিলীন করার গভীর ষড়যন্ত্র। তবে ভারত ও রাশিয়া সহ দেশের গোয়েন্দা বিভাগের ৩/৪ জন অফিসার হত্যার ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিলেন। এমনকি তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন ছেড়ে গণবভনে এসে থাকার অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা সম্মত হলেও বেগম মুজিব ৩২ নম্বর রোড়ের বাড়ি ত্যাগ করতে চাননি। তাছাড়া, তিনি বিষয়টি হালকাভাবে গ্রহন করেছিলেন। মুহুর্তের জন্যেও তিনি মনে করেননি কোন বাঙ্গালি তাঁকে খুন করতে পারে। কারন তাঁর ভাষায়, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তারাও আামায় ভালোবাসে। ১৫ আগষ্টের পূর্বে ২ মাস ধরে ঢাকায় একটি গুঞ্জন ছিলো অচিরেই সেনা অভ্যুত্থান হতে যাচ্ছে। গোয়েন্দা বিভাগ জেনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটি প্রশাসন ও সেনাবাহিনীও অবহিত ছিলো। তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল কে.এম. শফিউল্লাহ বলেন, তিনি ছাড়া সব সেনা অফিসারই বিষয়টি অবগত ছিলেন। তিনি যখন জানলেন তখন কি করলেন ? বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাকে ফোন করে বলেছেন যে, সফিউল্লাহ তোমার সেনা বাহিনী আমার বাড়ি অাক্রমণ করেছে, তুমি সৈন্য পাঠাও। তিনি বলেন, Sir,can you get out ? I am doing something.But he did nothing. জেনারেল এম, এ, জি, ওসমানীর সুপারিশে বংগবন্ধু কে,এম, সফিউল্লাহকে সেনা প্রধান করেন,কিন্তু তাঁর চরম বিপদের সময়ে তিনি পাশে দাড়াতে পারেন নি।এ হত্যাকান্ড জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্যে চিরস্থায়ী কলঙ্ক।
ভারত, রাশিয়া, সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক সরকার বিষয়টি জেনে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। কিন্তু তিনি আমলে নেননি।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বাঙালীর মুক্তির জন্যে তিনি পাকিস্তান আমলে ৪৬৬৮দিন কারাবাস করেছেন। তাই বাঙালীরা তাঁকে হত্যা করবে না। তাঁর এ আত্মবিশ্বাসের সুড়ঙ্গ দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারলো।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কে সেনা উপ প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পূর্ব থেকেই জানতেন। তিনি বিপথগামী মেজরদেরকে বারিত না করে হত্যাকান্ডে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করলে তিনি তাকে বলেন যে, এতে আমাকে জড়িত করবে না।তোমরা যা খুশী কর গিয়ে । বঙ্গবন্ধুর প্রতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষোভ ছিলো। কারণ,সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল এম, এ,জি, ওসমানীর সুপারিশে বঙ্গবন্ধু মেজর জেনারেল কে,এম, সফি উল্লাহকে সেনাপ্রধান এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনা উপ প্রধান নিয়োগ করেন। এ কারণে, জেনারেল সফিউল্লাহ এর সাথে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক ভালো ছিলো না। জাসদ এর পছন্দ ছিলো জেনারেল জিয়াউর রহমান । বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৭৭সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি এ,এস,এম, সায়েম রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করলে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন এবং সামরিক শাসনকে বেসামরিককরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বি এন পি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ৩১ মার্চ সরকার গঠন করেন। তার দল ৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদে মরহুম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাবে বলা হয় যে,”বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অত্যন্ত দুঃখ -ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রস্তাব করছে যে,বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে রাজনীতি জগতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে। এই সংসদ তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে এবং তার শোক সন্তাপ্ত পরিবারের নিকট গভীর সমবেদনা ঞ্জাপন করছে। ”
৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বিল উত্থাপিত হয় এবং এদিনই তা গৃহীত হয়। এ সংশোধনী অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোস্তাকের জারীকৃত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সহ সামরিক সরকারের চার বছরের ফরমান, আদেশ ও সামরিক আইন জাতীয় সংসদে বৈধভাবে গৃহীত হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সুবহে সাদিকে( ভোর ৫ টার পর) হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যা করে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়।বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর পা রেখে খন্দকার মোস্তাক এ দিন সকালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন।বেলা সোয়া এগারোটায় জাতির উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বেতার ভাষণ দেন। তিনি বলেন , এ হত্যাকান্ড ও অভ্যূত্থান ঐতিহাসিক প্রয়োজনে হয়েছে। তিনি অারো বলেন, সবাই দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলো। কিন্তুু প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব ছিলো না। তাই পরিবর্তনে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। এ দিন বিকালে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৬ জন সদস্য খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জাতীয় সংসদের স্পীকার অাঃ মালেক উকিল লন্ডনে সাংবাদিকদের নিকট বলেন, দেশ ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। এ আঃ মালেক উকিল পরবর্তীতে অাওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। ধিক তাদেরকে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এ হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ছিলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। জাসদের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করার জন্যে জনগণকে আহবান জানিয়ে গঠন করে বিপ্লবী গণবাহিনী। জাসদ নেতা লেঃ কর্ণেল অাবু তাহের সেনাবাহিনীর মধ্যে গঠন করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। গণবাহিনী পুলিশ ফাঁড়ি, থানা, ব্যাংক, হাটবাজার লুট সহ আওয়ামী লীগের এম.পি., নেতা ও হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়। এ বাহিনী কত মানুষ খুন ও গুম করেছে তার হিসাব কখনো পাওয়া যাবে না। যদি জাসদ বিপ্লবী গণবাহিনী এবং কর্নেল অাবু তাহের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন না করতেন, তাহলে কেউই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পেতনা। হঠকারী জাসদ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। আ,স, ম, আবদুর রব এর নেতৃত্বে এক গ্রুপ, হাসানুল হক ইনু সাহেবের গ্রুপ এবং শরিফ নুরুল অাম্বিয়া-মইনউদ্দিন খান বাদলের গ্রুপ। শেযের দুই গ্রুপ এখন আওয়ামী লীগ এর জোটে। যারা এক নেতা, এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্লোগান দিয়ে বাকশালে যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে ১৫ অাগস্টকে নাজাত দিবস ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ায় একমাত্র বঙ্গবীর আঃ কাদের সিদ্দিকী ছাড়া বাকশালের কোন নেতাই প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু বাকশাল তথা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা কি করলেন? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল তথা আওয়ামী লীগেরই প্রধান নেতা। তাঁর নির্মম মৃত্যুতে কোন নেতাই প্রতিবাদ করেননি। উল্টো তারা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় সুড়সুড় করে যোগ দিলেন। মোস্তাকের দলে যোগ না দেওয়ায় কারাগারে গেলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন,শেখ আব্দুল আজিজ, মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম প্রমুখ।

হত্যাকারীরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে পারলে স্বাধীনতারর ইতিহাস পাল্টে দিতে পারবে।কিন্তু তারা জানতো না স্বাধীনতার ইতিহাস পাল্টাতে হলে বাংলাদেশের সব মানুষকে শেষ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম দেশের মাটির পরতে পরতে মিশে আছে, তিনি আছেন জনগণের হৃদয়ের গভীরতম স্থানে। তাঁকে কি শেষ করা যায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ বেঁচে নেই। আমাদের কে শপথ নিতে হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবরূপ দান করার জন্যে। আমরা দেশের কাউকে কোন ষড়যন্ত্র করার কোন সুযোগ দেব না। দেশে অন্যায়-অবিচার হতে দেব না। আসুন, আমরা সবাই মিলে সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবতাবাদী। জাতি -ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সব মানুষকে ভালো বাসতেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক।তাঁর সারা জীবন কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রাম,ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে।তিনি ছিলেন নির্যাতিত মানুষের নেতা।যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক লরেন্স জারিং বলেন, “শেখ মুজিব ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন গরীব সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান।” তিনি সব সময়ে রাজনৈতিক কর্মীদের খোঁজ খবর নিতেন। শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতো তাঁর স্মরণ শক্তি ছিলো। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর হাজার হাজার কর্মীর নাম মনে রাখতে পারতেন।তিনি সৎ সাহস ও দুর্বার আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন উদার ও দয়ালু। তিনি একটি ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বাঙ্গালী। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিলো বিস্ময়কর। তিনি রাতারাতি নেতা হন নি।তিনি কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জাতীয় নেতা আর জাতীয় নেতা থেকে জাতিরজনক হয়েছেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। ১৫ আগষ্টে নিহত সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। কনক চৌধুরীর কবিতা উদ্ধৃতি দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি।
জন্মেও তুমি মহাকালে মহান
মরণেও তুমি কালজয়ী চির দিপ্তমান।
বাংলার মহানায়ক অমর স্মৃতিতে অম্লান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তথ্য সূত্রঃ
১. এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য,স্বাধীনতার এক দশক—-মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী।
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবঃ মুক্তিযুদ্ধের পর—আবদুল মতিন।
৩..কারা মুজিবের হত্যাকারী?— এ, এল, খতিব।
৪. পাঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ —- মেজর রফিকুল ইসলাম।
৫..মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র —- সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত।
৬. মুজিব হত্যার তদন্ত —- পরেশ সাহা।
৭. জাসদের উত্থান পতনঃঅস্হির সময়ের রাজনীতি — মহিউদ্দিন আহমদ।
৮. বাংলাদেশ রক্তের ঋণ—- অ্যান্হনী মাসকারেনহাস।
৯. মুজিব ভারতপন্থী ছিলেন না —- সাঈদ তারেক।
১০. অসমাপ্ত বিপ্লব —- লরেন্স লিফশুলৎস।
১১. বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় জাতির কলঙ্ক মোচন— আনু মাহমুদ।
১২.ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ——অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...