ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক মহীয়সী বেগম রোকেয়া

নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক মহীয়সী বেগম রোকেয়া

রঞ্জন বকসী নুপু >

মানব মুক্তির সঙ্গে নারী মুক্তির ব্যাপারটি যেমন জড়িত, তেমনি নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে বেগম রোকেয়ার নাম। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রামী, দার্শনিক ও মাঠকর্মী। এক কথায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মানব মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে নারী মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে রোকেয়ার জীবন দর্শন থেকে শিক্ষা নেয়ার কোন বিকল্প নেই। নারী মুক্তি তথা মানব মুক্তির এই আকাশে ধ্রুবতারার মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছে বেগম রোকেয়ার নাম। বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে ১৮৮০ সালে রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জহিরউদ্দিন মোঃ আবু আলী সাহেবের সংসারে জন্ম গ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। দুই ভাই ও তিন বোনের সংসারে জন্ম নিয়ে বেগম রোকেয়া বড় দুই ভাই যথাক্রমে আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবের এবং খলিল সাবেরের মাধ্যমে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হন। বিহারের ভাগলপুরের অধিবাসী তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসাইনের সাথে বেগম রোকেয়ার বৈবাহিক জীবন শুরু হয়। তাঁর শ্বশুর বাড়ি ছিল তুলনামূলক উদার প্রকৃতির। তাঁর শিক্ষার প্রসারের জন্য ইংরেজীতে বড় ভাইয়ের সাথে চিঠি পত্রের আদান প্রদান চলতো। ১৯০৯ সালে কলকাতায় তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসাইন মৃত্যুবরণ করেন। আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হওয়া বেগম রোকেয়া মাত্র আঠাশ বছর বয়সে বিধবা হন। বেগম রোকেয়াই এই উপমহাদেশের প্রথম নারী ব্যাক্তিত্ব যিনি জীবনের সর্ব পর্যায়ে নারী-পুরুষের সম অধিকার দাবি করেছেন। আর এ কারনেই বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন, তাঁর দুরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তা চেতনা আজও এই একবিংশ শতাব্দির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এদেশের নারীদের জীবন চলার শ্বাশত পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়নের আহবান
মহীয়সী রমনী বেগম রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়নের আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন; “আমরা সমাজের অর্ধঅঙ্গ। আমরা নিচে পড়িয়া থাকিলে সমাজ উপরে উঠিবে কীভাবে ? কোন ব্যাক্তির এক পা বাঁধা রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে ? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই ! তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। আমরা অকর্মন্য পুতুল-জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীন ভাবে জীবীকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় আমরা তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার, লেডী জজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর ধরে লেডী ভাইসরয় হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে ‘রানী’ করিয়া ফেলিব। উপার্জন করিব না কেন ? আমাদের কি হাত নাই, পা নাই, বুদ্ধি নাই ? কি নাই ? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামীর’ গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না ?”
অন্তপুরে বন্দি নারী
বেগম রোকেয়া বলতেন; “হজ্বের সময় নর-নারী তুল্য অধিকার। উভয়ের পরিধেয় একই প্রকার সেলাই বিহীন দুই খন্ড বস্ত্র মাত্র। এখানে জরির লেসে ঢাকা নতুন ফ্যাসানের বোরকা নাই, ঘেরা-টোপ ঢাকা পাল্কিও নাই। শরীফজাদী বিবিদিগকে পদব্রজেই সাফা এবং মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপত্যকায় দৌড়াইতে হইবে, কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করিতে হইবে। এ সময় পুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলি অনিবার্য। ভারতীয় সম্ভ্রান্ত মহাশয়েরা হজ্বের জন্য আলাদা ‘পর্দানশীল’ দিবস প্রচলন করেন না কেন ? কলিকাতায় যেমন প্রদর্শনী ইত্যাদিতে অবরোধ-বন্দিনীদের জন্য একটি বিশেষ দিন ধার্য করা হয়, ভারতীয় শরীফ গণ সেইরূপ নারীর জন্য হজ্বের স্বতন্ত্র দিন ধার্য করিতে পারিলে বুঝিব, তাহার মরদ বটে।” তিনি অবরোধ প্রথাকে ঠিক এইভাবে ব্যাক্ত করেছেন; “অবরোধ প্রথাকে প্রাণঘাতক কার্বনিক এসিডের সহিত তুলনা করা যায়। সেহেতু বিনা যন্ত্রনায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোকে কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিবার অবসর পায় না। অন্তঃপুরবাসিনী এই অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া নিরবে মরিতেছে। আমি আজ ২২ বছর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা-জানেন? সে জীব ভারত নারী। এ জীবগুলোর জন্য কাহারো প্রাণ কাঁদে নাই। মহাত্মা গান্ধী অস্পৃস্য জাতির দুঃখে বিচলিত হইয়াছে, স্বয়ং থার্ড ক্লাশে ভ্রমন করিয়া দরিদ্র রেল পথিকদের কষ্ট হৃদয়াঙ্গম করিয়াছেন। পশুর জন্য চিন্তা করিবার লোক আছে, তাই যত্রতত্র পশু ক্লেশ নিবারনী সমিতি দেখিতে পাই। পথে কুকুরটা মোটর চাপা পড়িলে, তার জন্য এ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলোতে ক্রন্দনের রোল দেখিতে পাই, কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ বন্দিনী নারী জাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই।”
নারী শিক্ষা ও আত্ম শক্তি জাগ্রত করা
নারী শিক্ষা প্রসার করতে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টার কোনই ঘাটতি ছিল না। তাইতো তিনি ভাগলপুরে প্রথমেই মাত্র ৫টি ছাত্রী নিয়ে স্বামীর নামে তৈরি করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল’। কিন্তু পারিবারিক কারণে ভাগলপুরে টিকতে না পেরে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় মাত্র আটটি ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন; “অন্ততঃ পক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি, গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা- যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিনী, আদর্শ মাতা রূপে গঠিত করিবে। শিক্ষা মানসিক ও শারিরীক উভয়বিদ হওয়া চাই। তাহাদের জানা উচিত যে, তাহারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ী, ক্লিপ ও বহুমূল্য রতœালঙ্কার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আইসে নাই, বরং তাদের বিশেষ কর্তব্য সাধন নিমিত্ত নারী রূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতিদেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে। তাহার অন্ন, বস্ত্রের জন্য কাহারো গলগ্রহ না হয়। গভার্নমেন্ট এখন শিশু রক্ষার দিকে মনোযোগ দিয়াছেন, ভাল কথা, কিন্তু প্রথমে শিশুর মাতাকে রক্ষা করা চাই।”
অসাম্প্রদায়িকতা
বেগম রোকেয়া আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক একজন মহীয়সী ছিলেন। আর তাইতো তিনি বলেছিলেন; যে দেশে এক ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্রণালিতে হয়, একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লোকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলেই ইহাই মনে করে যে আমরা সকলে একই গন্তব্য স্থলে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি। প্রেমিক হও, ধার্মিক হও, নাস্তিক হও, যাই হইতে চাও তাহাতেই মানসিক উন্নতির প্রয়োজন। নির্বোধ বন্ধু হইলে কাহারও উপকার করিতে পারিবে না। ধর্ম সাধনের নিমিত্ত শিক্ষা দীক্ষার প্রয়োজন, জ্ঞান না হইলে ঈশ্বরকে চেনা যায় না।”
নর-নারীর সমতা প্রসঙ্গে
নর-নারীর সমতা প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বলেছেন; “আমাদের উচিত যে, তাহাদের সংসারের এক গুরুতর বোঝা বিশেষ না হইয়া আমরা নারীরা সহচরী, সহকর্মিনী, সহধর্মিনী ইত্যাদি হইয়া সহায়তা করি। আমরা অকর্মন্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্টি হই নাই, এ কথা নিশ্চিত। তিনি বলেছেন, “সভ্যতা ও সমাজ বন্ধনের সৃষ্টি হইলে সামাজিক নিয়মগুলি অবশ্য সমাজপতিদের মনোমত হইত। ইহাও স্বাভাবিক। ‘জোর যার, মুল¬ুক তার’ এখন জিজ্ঞাসা করি, আমাদের অবনতির জন্য কে দোষী ? প্রথমে যখন কতিপয় ভদ্রলোক তাঁহাদের স্ত্রীদের পর্দার বাহির করিয়াছিলেন, তখন চারিদিকে ভীষণ কলরব উঠিয়াছিল। ধবলকেশ বুদ্ধিমানগণ বলিয়া ছিলেন, ‘পৃথিবীর ধ্বংসকাল উপস্থিত হইল।’ এক্ষেত্রে তিনি আরও বলেছেন, ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জন করুক। কার্যক্ষেত্রেও পুরুষের পরিশ্রমের মূল্য বেশী, নারীর কাজ সস্তায় বিক্রয় হয়।”
পরিশেষে
সারা জীবনই বেগম রোকেয়া অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। আমৃত্যু তিনি নারীকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর শ্রম, মেধা ব্যবহার করেছেন। নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক এই মহীয়সী রমনী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

– লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...