ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - যেভাবে মঠবাড়িয়া বিজয় হয়

যেভাবে মঠবাড়িয়া বিজয় হয়

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ৮টি শহরে বোমা বর্ষন করলে ভারত ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলে পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারতের সাথে যুদ্ধের প্রয়োজনে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃজেনারেল অামির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি থানা, মহকুমা ও জেলা থেকে সেনা বাহিনী প্রত্যাহার করলে ক্যাপ্টেন এজাজ অাহমেদ তার বাহিনী নিয়ে ৭ ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া ত্যাগ করে পিরোজপুর চলে যায়। ক্ষমতা থাকে পুলিশ ও রাজাকারদের হাতে। ৮ ডিসেম্বর কর্নেল অাতীক মালিক এবং ক্যাপ্টেন এজাজ তাদের বাহিনী নিয়ে পিরোজপুর ছেড়ে বরিশাল চলে যায়।

সুন্দরবন সাব সেক্টরের সহ অধিনায়ক শামসুল আলম তালুকদার দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শরণখোলা থানার সদর দপ্তর রায়েন্দা আক্রমন করেন। অভিযান ব্যর্থ হয়। এ অভিযানে শহিদ হন গুরুপদ বালা, টিপু সুলতান, শেখ আবুল আসাদ, আলতাফ হোসেন সিকদার ও আলাউদ্দিন। শামসুল আলম তালুকদার বিষয়টি সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়া উদ্দিন কে অবহিত করলে তিনি অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও রায়েন্দা পুনঃ আক্রমনের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। তাঁর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্পের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি রাজাকার ক্যাম্পের ওপর ৬/৭টি ৩ ইঞ্চি মর্টার নিক্ষেপ করলে ভবনটি ভেঙ্গে যায়। অনেকে মরা যায় এবং অনেকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে ৮০ জন রাজাকার মারা যায়।

মঠবাড়িয়া থানা ছিল রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি।এখানে প্রায় ৫০০ রাজাকার ছিল।রায়েন্দায় রাজাকারদের পতনের পর মঠবাড়িয়ার রাজাকার বাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ৭ ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া থেকে চলে গেলে রাজাকার বাহিনীর গতিবিধি সীমিত হয়ে পড়ে।সুন্দরবন পূর্বাঞ্চল তথা মঠবাড়িয়ার কমান্ডার অালতাফ হোসেন অাকনের নেতৃত্বে বিনা রক্তপাতে মঠবাড়িয়া থানা দখলের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। তিনি মঠবাড়িয়ার রাজাকার বাহিনীকে অাত্মসমর্পন করার অাহবান জানান এবং বলেন, অাত্মসমর্পন করলে তাদের নিরাপত্তা বিধান করা হবে,না করলে তাদেরকে চরম শাস্তি ভোগ করতে হবে।কিন্তু রাজাকাররা তাঁর অাহবানে সাড়া না দিয়ে গড়িমসি করতে থাকে। এরুপ অবস্থায়, খান সাহেব হাতেম অালী জমাদ্দারও রাজাকার বাহিনীকে অাত্মসমর্পনের পরামর্শ দেন। কিন্তু তারা তাঁর পরামর্শ কর্ণপাত করেনি।

ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অাক্রমনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর ডাঃ অাব্দুল মোতালিব মালিক ও তাঁর মন্ত্রী সভার সদস্যগণ ১৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ ও নিরাপদ স্থান হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অাশ্রয় গ্রহণ করেন।ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল এস.এইচ.এফ.মানেকশ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে.জেনারেল অামির অাব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে অাত্মসমর্পন করার জন্যে ঘনঘন বার্তা প্রেরণ করতে থাকেন।অবস্থা বেগতিক দেখে জেনারেল নিয়াজী ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল এম.স্পিভ্যাককে অনুরোধ করেন এব্যাপারে মধ্যস্থতা করার জন্যে। তিনি জেনারেল নিয়াজীকে জানান যে,তিনি মধ্যস্থতা করতে পারেন না।তবে অাত্মসমর্পনের বার্তাটি যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। মিঃ এম. স্পিভ্যাক অাত্মসমর্পনের বিষয়টি সরাসরি জেনারেল মানেকশ এর নিকট বা দিল্লিতে না পাঠিয়ে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে প্রেরণ করেন। জেনারেল নিয়াজীর নিকট থেকে কোন বার্তা না পেয়ে জেনারেল মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর বেতার মারফত নিয়াজীকে অাত্মসমর্পনের অাহবান জানিয়ে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তায় বলা হয় যে,এর পরও যদি অাপনি পুরো বাহিনীসহ অাত্মসমর্পন না করেন, তাহলে ১৬ ডিসেম্বর ৯ ঘটিকার পর ব্যাপকভাবে অাঘাত হানার জন্যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হবে।

ভারতের ১০১ কমিউনিকেশন জোনের শিখ অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা ও তঁর বাহিনী অাব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীকে সাথে নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সকালে মিরপুর ব্রিজের উত্তর সীমান্তে পৌঁছেন এবং সাড়ে ৮ ঘটিকায় জেনারেল নাগরা চিঠি প্রেরণ করেন জেনারেল নিয়াজীকে অাত্মসমর্পন করার জন্যে। উল্লেখ্য,জেনারেল নাগরা ও জেনারেল নিয়াজী কলেজ ও দেরাদূন মিলিটারী একাডেমী জীবনে বন্ধু ছিলেন। চিঠিতে জেনারেল নাগরা লিখেনঃ
প্রিয় অাব্দুল্লাহ,
অামি এখন মিরপুর ব্রিজে। ঘটনার পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।পরামর্শ হচ্ছে, তোমরা অামার নিকট অাত্মসমর্পন করো।সেক্ষেত্রে অামরা তোমাদের দেখা শুনার দায়িত্ব গ্রহণ করবো।সত্বর তোমার প্রতিনিধি পাঠাও

।ইতি——
তোমার নাগরা
সকাল ৮:৩০ মিনিট
তাং-১৬/১২/১৯৭১

জেনারেল নিয়াজী অাত্মসমর্পনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ঢাকার জি.ও.সি. মেজর জেনারেল মোঃ জামসেদকে প্রেরণ করেন। অাত্মসমর্পনের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চুড়ান্ত করার জন্যে দুপুরে একটি বিশেষ বিমানে ঢাকায় অাসেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জে.এফ.অার.জ্যাকব।বিকাল ৪ ঘটিকার অাগে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর প্রধান লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন অাব্দুল করিম খন্দকার ও ভারতের অপরাপর সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকায় অাসেন।বিকাল ৪:৩১ মিনিটে রেস কোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষাধিক জনতার উপস্থিতিতে লে.জেনারেল অামির অাব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বাংলাদেশে অবস্থিত ৯১,৪৯৮ জন সৈন্য ও অফিসারসহ বিনা শর্তে লে.জেনরেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট অাত্মসমর্পন দলিলে স্বাক্ষর করেন।অাত্মসমর্পন দলিলে জেনারেল নিয়াজীর স্বাক্ষরের সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে মানব ইতিহাসের এক করুনতম ও বেদনাদায়ক ঘটনা। অামরা অর্জন করি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনা বাহিনী অাত্মসমর্পন করলেও মঠবাড়িয়ার রাজাকার বাহিনী অাত্মসমর্পন করেনি।মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্যে মঠবাড়িয়ার কমান্ডিং অফিসার অালতাফ হোসেন অাকনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল থানা ভবন থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে কালিরহাটে অবস্থান করেন। এ দলে ছিলেন,শহীদুল অালম বাদল,কামাল উদ্দিন অাহমেদ (ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের ভাই),মাহতাব উদ্দিন অাকন,সুবেদার সোহরাব হোসেন, ফুল মিয়া গাজী প্রমূখ।অালতাফ হোসেন অাকন ১৭ ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া পুলিশ সার্কেল প্রধান কাজী জালাল উদ্দিনের নিকট একখানা চিঠি প্রেরণ করেন। চিঠিতে বলা হয়, ১৮ ডিসেম্বর সকালে অাত্মসমর্পন না করলে থানা দখল করা হবে। কাজী জালাল উদ্দিন এবং রাজাকার বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রক্তপাত এড়ানোর জন্যে অাত্মসমর্পনে মধ্যস্থতা করার জন্যে খান সাহেব হাতেম অালী জমাদ্দারের শরণাপন্ন হন।খান সাহেব হাতেম অালী জমাদ্দার ১৮ ডিসেম্বর রোজ শনিবার সকালে রিক্সায় কালিরহাট গিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করে রাজাকার বাহিনীর অাত্মসমর্পনে মধ্যস্থতা করেন। ফলে বিনা রক্তপাতে মুক্তিযোদ্ধারা মঠবাড়িয়া থানা দখল করেন। হাজার হাজার মানুষ জয় বাংলা স্লোগান সহকারে মঠবাড়িয়া শহরে অানন্দ মিছিল করেন।প্রায় ৯ মাস যাবত হানাদার পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও নিগৃহীত জনগণের রোষানলে পড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায় রাজাকার কমান্ডার অালগী পাতাকাটা গ্রামের হেমায়েত হোসেন সুফী এবং রাজাকার বাহিনীর জল্লাদ উত্তর মিঠাখালীর অাব্দুর রহমান।কুখ্যাত অনেক রাজাকার ১৬ ডিসেম্বর রাতে পালিয়ে যায়। (চলমান)

লেখক > নূর হোসাইন মোল্লা, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও পাঠাগার আন্দোলন সংগঠক।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...