ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - স্বাগত বাংলা নববর্ষ

স্বাগত বাংলা নববর্ষ

হে নতুন, এসো তুমি সম্পূর্ন গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে ব্যাপ্ত করি,
লুপ্ত করি স্তরে স্তরে,
স্তবকে স্তবকে ঘনঘোর স্তুপে।

কবিতাটি দিয়ে ১৪২৪ সালকে স্বাগত জানাচ্ছি। ১ বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম দিন। এ দিন আমাদের সর্বজনীন উৎসব। এদিনটি আমরা বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে পালন করি। এ দিনে আমরা প্রিয়জনের শুভেচ্ছা কামনা করি। কামনা করি নতুন শান্তিময় দিনের। আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনে বাংলা সাল ছাড়া আরও দু’টি সালের অস্তিত্ব আছে। একটি হিজরী অপরটি খৃষ্টীয় সাল। আমাদের জাতীয় জীবনে তিনটি সালেরই কার্যকরিতা আছে। তবে খৃষ্টীয় সাল আমাদের জীবন ব্যবস্থায় বিশেষভাবে ক্রীয়াশীল। তবে বাংলা ও হিজরী সাল আমাদের অফিস আদালতে এখনো ব্যবহৃত না হলেও জীবনের নানা পর্যায়ে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। হিজরী সাল চন্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে হিজরী সাল ও চন্দ্র মাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

প্রায় ২০০ বছর বৃটিশ শাসনের ফলে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কারণে খৃষ্টীয় সালের গুরুত্ব আমাদের জীবনে অধিক প্রভাব বিস্তার করে আছে। দেশের প্রায় সকল কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বানিজ্য খৃষ্টীয় তারিখ অনুযায়ীই সম্পাদিত হয়। সে কারণে খৃষ্টীয় সালের শুরু অর্থাৎ নববর্ষ আমাদের কর্ম জগতে বিস্তারিত। তাই এদেশে ঘটা করে খৃষ্টীয় নববর্ষ পালিত হয়। এতৎসত্ত্বেও বাংলা সালের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসস্ত আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যে প্রভাব বিস্তার করে আসছে, তার শাশ্বত প্রেরণা আমাদের জীবনের অনুপরমানুতে প্রবাহিত। আমাদের সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা ও হাসি-কান্না জড়িত বাংলা বার মাসের তের ফসলে।
১২০৪ খৃষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে মুসলমান শাসকগন এদেশে হিজরী সাল প্রচলন করেন। এ সালের ওপর ভিত্তি করেই শাসকগন প্রজাদের নিকট থেকে ভূমি রাজস্ব আদায় করতেন। আর রাজস্ব আদায় হতো উৎপাদিত ফসল থেকে। আবাদি ভূমির রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে রাজস্ব কর্মচারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতো। কারণ হিজরী সাল তথা চন্দ্র মাস কোন মৌসুম মেনে চলে না। স¤্রাট আকবর ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করে দেখতে পেলেন যে, তাঁর অধীনস্থ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সাল চালু রয়েছে। তার মধ্যে জালালী সাল,সিকান্দার সাল, শকাব্দ,গুপ্তাব্দ, বিক্রমাব্দ প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে কোনটিই সর্ব ভারতীয় সাল হিসাবে প্রচলিত ছিল না। তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্যে স¤্রাট আকবর তাঁর রাজত্বের ২৯ বছরের সময়ে ফসল তোলার মৌসুমের সাথে মিল রেখে ফসলী সাল প্রবর্তনের আদেশ দেন। তাঁর নির্দেশে তাঁর অর্থ বিভাগের সহকারী সচিব এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ পন্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী হিজরী সালের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ৯০৯৩ জিরী সাল মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১১ মাস সৌর মাস ভিত্তিক একটি নতুন ফসলী সাল চালু করেন। পরববর্তীতে এ ফসলী সাল নামান্তরিত হয় বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ। সৌর বছর এবং চন্দ্র মাসের মধ্যে ১১ দিন (৩৬৫-৩৫৪ দিন) পার্থক্য থাকায় পরবর্তীতে বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে জ্ঞান তাপস ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক বঙ্গাব্দ বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে।

আমাদের দেশে মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় লোক যুগ যুগ ধরে একই পরিবেশে বসবাস করছে। ধর্মীয় ব্যবধান ব্যতিত আমাদের মধ্যে পারস্পারিক সৌহার্দ্য বিদ্যমান। তাই বঙ্গাব্দকে মনে-প্রাণে আমাদের ঐতিহ্যের এক অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আগে ১ বৈশাখ তথা নববর্ষের উৎসব ছিল পল্লী কেন্দ্রিক। কিন্তু তা এখন শহর কেন্দ্রিক হয়ে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নববর্ষের নতুন চেতনা ও উপলদ্ধি নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। নববর্ষে আমাদের ব্যবসায়ীরা সাড়ম্বরে শুভ হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে আনন্দের ঢল। মিষ্টি মুখের মাধ্যমে খোলা হয় নতুন বছরের হালখাতা। গ্রাম-গঞ্জে,হাটে-বাজারে, খেলার মাঠ ও দর্শনীয় স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। মৌসুমী ফলমূল,নানা রকম হস্তশিল্পজাত সামগ্রী, পোড়া মাটি, কাঠ,বাঁশ ও বেতের তৈরী প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ও খেলনা যথা-হাতি, ঘোড়া, হরিণ, গাড়ি, বাঁশি, ভেঁপু, চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা ইত্যাদি কেনার ধুম পড়ে যায়। নাগর দোলা, সার্কাস, ঘুড়ি উড়ানো ও পুতুল নাচের আসরে কেউ কেউ আনন্দ উপভোগ করে। এ দিন আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নামে জনতার ঢল। চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালীরা আপন ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। শহরে বিভিন্ন সংগঠন র‌্যালি, সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়। গ্রাম-গঞ্জে আয়োজন করা হয় জারী, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মারফতি, পালাগান, নাটক ও দেশাত্ববোধক গানের আসর। গ্রাম-গঞ্জে শহর বন্দরে ধুম পরে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্ত ভাত খাওয়ার। এ দিন সকল শ্রেণির মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালীর পোষাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা পরিধান করে লাল পেড়ে সাদা শাড়ী, হাতে পরে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা ও কপালে পড়ে টিপ। আর তরুণরা পরিধান করে পাজামা ও পাঞ্জাবী। কেউ কেউ ধুতি ও পাঞ্জাবী পরিধান করে। উপজাতিরা আয়োজন করে খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী মেলা।

১৪২৩ সালে আমাদের সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই আছে। ব্যর্থতা দুর করার শপথ নিয়ে ১৪২৪ সালকে অভিনন্দন জানাতে হবে। ১৪২৪ সালের আগমন আমাদের জীবনে সফল হোক,সার্থক হোক আমাদের সকল কর্ম। আমাদের জীবন ভোগ -বিলাস, অন্যায়-অত্যাচার, অশ্লীলতা, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হোক। ১ বৈশাখে আমাদের ঐকান্তিক কামনা হোক, দেশের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি, নির্মূল হোক জঙ্গীবাদ, মুক্ত হোক মাদকাসক্তি। ত্যাগ ও তিতিক্ষায়, কর্মে ও ভালবাসায় নিয়োজিত হোক আমাদের জীবন। মানব সেবায় অনুপ্রাণিত হোক সকল মানুষ। আন্তরিক হোক সকল প্রচেষ্টা। পূর্ণ হোক সকল প্রত্যাশা এবং গঠন করি সোনার বাংলা।

লেখকঃ নূর হোসাইন মোল্লা, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং সম্পাদক, মঠবাড়িয়া উপজেলা নাগরিক কমিটি।
মোবাঃ ০১৭৩০৯ ৩৫৮৮৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...