ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - ভাষা আন্দোলনে মঠবাড়িয়া

ভাষা আন্দোলনে মঠবাড়িয়া

< নূর হোসাইন মোল্লা >

“মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে
আজিকে স্মরিও তাঁরে
কোথায় বরকত কোথায় সালাম
সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে”

মোশারেফ উদ্দিনের ভাষার গানটি দিয়ে শুরু করছি। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে তিনি ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এ গানটি রচনা করেন। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এটাই প্রথম গান। এ গানটির সুরারোপ করেন প্রখ্যাত সুরাকার আলতাফ মাহমুদ। এ গানটি ১৯৫৩ সালের অমর ২১ ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীতে পরিবেশিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এ সৈনিক বহু পূর্বে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু ও সহকর্মী মহিউদ্দিন আহমেদের অগ্রজ। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী। তিনি ১৯২০ সালে গুলিসাখালী গ্রামে একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আজাহার উদ্দিন আহমেদ বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন (১৯২০ থেকে ১৯২৬ সন পর্যন্ত)। তিনি কোলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি.এসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সার্ভেয়ার জেনারেল অব পাকিস্তান দপ্তরে চাকুরী করেন। তিনি ছিলেন গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের প্রথম পরিচালক। তিনি সরকারি চাকুরী করেও ভাষা আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি পানি ও সেচ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। মাতৃভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে তাঁকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
জাতীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে সবাই কম বেশী অবগত। তিনি ১৯২৫ সালে গুলিসাখালী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের মাধ্যমে। তিনি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশাল জেলার মুসলিম লীগের সেক্রেটারী ছিলেন। পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ নূরুল আমীন ও হামিদুল হক চৌধুরী দুই গ্রুপে বিভক্ত ছিল। মহিউদ্দিন আহমেদ হামিদুল হক চৌধুরীর গ্রুপে ছিলেন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারী মাসে পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে নুরুল আমীন ও হামিদুল হক চৌধুরী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হলে মহিউদ্দিন আহমেদ ও হামিদুল হক চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৫১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারী জননিরাপত্তা আইনে পুলিশ মহিউদ্দিন আহমেদকে বরিশাল থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা কালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। তাঁরা কারাগারে একই কক্ষে পাশাপাশি ছিলেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদ কারাগার থেকে এ আন্দোলনকে সমর্থন জানান এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে আমরণ অনশন শুরু করার হুমকি দিয়ে ১ ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে আই,জি, প্রিজনের মাধ্যমে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের নিকট দরখাস্ত করেন। দরখাস্তে বলা হয় যে, দীর্ঘদিন যাবৎ বিনা বিচারে কারাগারে আছি। ১৫ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে আমরণ অনশন শুরু করবেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার ভীত হয়ে তাঁদেরকে ১৬ ফেব্রুয়ারী সকালে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করার জন্যে নারায়নগঞ্জ স্টিমারঘাটে আনা হয়। ওই সময়ে ঢাকা-ফরিদপুরের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল স্টিমার। স্টিমারঘাটে পৌঁছার পূর্বেই স্টিমার গোয়ালন্দের উদ্দ্যেশে নারায়নগঞ্জ ছেড়ে যায়। স্টিমারঘাটে নারায়নগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শামসুজ্জোহা, বজলুর রহমান, আলমাস আলীসহ অনেকের সাথে তাঁদের সাক্ষাত হয়। তাঁরা তাদেরকে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন। এসময় মহিউদ্দিন আহমেদের অগ্রজ মোশারেফ উদ্দিন আহমেদ তাঁকে একশত টাকা দেন। বরিশালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনা করার জন্যে তিনি ওই ১০০/-টাকা পাঠিয়ে দেন। এসময় বরিশাল বি.এম. কলেজে ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মঠবাড়িয়ার উপজেলার কবুতরখালী গ্রামের মোঃ হাবিবুর রহমান খান। তিনি আই. এ. ক্লাশের ছাত্র ছিলেন। তাঁর উপরে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলে তিনি গ্রামের বাড়িতে আসেন। গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার হলে তিনি কলেজে যোগদান করেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তিনি গুলিশাখালী জি.কে. ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
স্টিমার নারায়নগঞ্জ ছেড়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদকে নারায়নগঞ্জ থানায় নেয়া হয় এবং রাত ১০টায় তাঁদেরকে স্টিমারে তোলা হয়। স্টিমার ভোরে গোয়ালন্দঘাটে পৌঁছলে ট্রেন যোগে তাঁদেরকে ফরিদপুর নেয়া হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারী সকালে তাঁদেরকে ফরিদপুর কারাগারে নেয়া হয়। কারাগারে পৌঁছে তাঁরা আমৃত্যু অনশন শুরু করেন। তাঁদের অনশনের বিষয়টি পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য মিসেস আনোয়ারা খাতুন ২০ ফেব্রুয়ারী আইন সভায় উত্থাপন করে সভা মূলতবী রাখার দাবী জানান। মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বিষয়টি নাকচ করে দেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ২১ ফেব্রুয়ারী সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে রফিকউদ্দিন, সালাউদ্দিন, আব্দুল জব্বার ও আবুল বরকত নিহত, অনেকে আহত এবং অনেকে গ্রেফতার হন। ফরিদপুরে হরতাল চলাকালে ছাত্র-জনতা স্লোগান দেয় যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই ইত্যাদি। অনশনে তাঁদের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ফরিদপুর কারাগারের রাজবন্দী ডাঃ মারুফ হোসেন, চুনীলাল চক্রবর্তী, সত্য মৈত্র, পুর্ণেন্দু দে কানুন গো, নেপাল নাথ প্রমুখ ২৫ ফেব্রুয়ারী অনশন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, বিনা বিচারে ২৬ মাস কারাগারে আছি। হয় জীবিত অবস্থায় জেলের বাইরে যাব, না হয় মৃত্যু অবস্থায় যাব। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার বিনা শর্তে ২৭ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারী মহিউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেন। মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টভূক্ত গণতন্ত্রী দল থেকে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তিনি ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালের ১ এবং ৩ এপ্রিল তিনিই সর্ব প্রথম পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের প্রস্তাব পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, আসহাব উদ্দিন, আশুতোষ সিংহ প্রমূখ এর সমর্থনে তাঁর প্রস্তাবটি গৃহিত হয়। পাকিস্তানের বৈদেশিক নীত এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন নিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে মাওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানি এবং আঃ ওয়ালি খানের সাথে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন এবং তিনি দলের যুগ্ম সম্পাদক হন।১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ন্যাপ ভাসানি ওয়ালি খান গ্রুপ বিভক্ত হয়। মহিউদ্দিন ওয়ালি খান ন্যাপের(মস্কো পন্থী) কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এ দল থেকে ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে তিনি পরাজিত হন। আওয়ামীলীগ দলীয় গণ পরিষদ সদস্য সওগাতুল আলম সগীর ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারী মঠবাড়িয়া সদরে ঘাতকের গুলিতে নিহত হলে মহিউদ্দিন আহম্মেদ আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।

১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় ঐক্যজোট বাকশাল থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই বাকশাল বিলুপ্ত ঘোষণা করে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তিনি ১৯৯৭ সনের ১২ এপ্রিল ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন এবং রাজনীতিতে তাঁর অবদানের জন্যে সরকার ২০০০ সালে তাঁকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সৃজন আলী তালুকদারের অবদান সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম অবগত নন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী মঠবাড়িয়া কে.এম.লতীফ ইনষ্টিটিউশন প্রাঙ্গনে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদদের স্মরণে এবং মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে ছাত্র-জনতার এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কে.এম.লতীফ ইনষ্টিটিউশনের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সৃজন আলী তালুকদার। সভায় যারা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে হাবিবুের রহমান খান ছাড়া আর কেউ জীবিত নেই।

শ্রোতাদের মধ্যে এখনও ২/৪ জন জীবিত আছেন। জীবিতদের মধ্যে উক্ত বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র বুকাবুনিয়া নিবাসী আঃ কাদির মোল্লা এবং নলী নিবাসী আব্দুল হামিদ খান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ঐ সময়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের পিরোজপুর দক্ষিণ আসনের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য উত্তর মিঠাখালী নিবাসী খান সাহেব হাতেম আলী জমাদ্দারের পরামর্শে তাঁরই আত্মীয় এবং ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সৃজন আলী তালুকদার সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “প্রিয় ভাইয়েরা, আপনারা আমার ছালাম নিবেন। আমি সাধারণ মানুষ। সামান্য লেখাপড়া করেছি। বক্তৃতা জানি না। ছাত্ররা যা চায়, আমি তা চাই। আপনারাও তা চাইবেন। আমার বক্তৃতা শেষ।’’ সৃজন আলী তালুকদার ১৮৮৫ সালে মঠবাড়িয়া উপজেলার বড় হারজী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যু বরণ করেন।

লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, মোবাইল -০১৭৩০-৯৩৫৮৮৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...