মেহেদী হাসান বাবু ফরাজী🔴🟢
পছন্দের কলেজে (বরিশাল অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়) ভর্তি হতে না পেরে মিরুখালী স্কুল এন্ড কলেজের এক ছাত্রী সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যা করেছে।বিষয়টি সবাইকে বেশ কষ্ট দিয়েছে।বিশেষ করে তার মা বাবার কথা ভেবে আমরা সকলেই কষ্ট পাচ্ছি।আসলে প্রতিটি আত্মহত্যাই জীবনের অপচয়। আত্মহত্যা কোনো ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়।জীবনে যত বড় বিপর্যয়-ই আসুক- আত্মহত্যা কোনো মতেই সমাধান নয়। মানুষ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আত্মহত্যা করে বসে বা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে, অথচ অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় এক সপ্তাহ বা একমাস পরে এই সমস্যাগুলো আর ততটা বড় সমস্যা হিসেবে থাকে না।হয় সমস্যা সমাধানে নতুন কোনো উপায় বের হয়ে আসে, না হয় সমস্যাটা সহ্যসীমায় চলে আসে।যারাই আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে এসেছেন তারা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছেন এমনকি নিজের ‘বোকামির’ জন্য মনে মনে লজ্জিতও হয়েছেন।
এই যে তথাকথিত ভালো রেজাল্ট কিংবা ভালো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে তরুণ তরুণীরা আত্মহত্যা করে বসে- এর দায় আমরাও এড়াতে পারিনা।’ভালো রেজাল্টের’ জন্য শুধু পরিবারই নয়, সামগ্রিক ভাবে আমাদের সো কল সমাজও এই কোমল শিক্ষার্থীদের উপরে এক ধরনের চাপ তৈরি করে যাচ্ছে অনবরত।বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। ভাবছেন কি ভাবে? একটি পরিসংখ্যান দেই।এ বছর এইচ,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছে ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন, আর পাশ করেছে ১৩ লক্ষ ৬ হাজার ৭১৮ জন।অর্থাৎ প্রায় ৯৬% পরীক্ষার্থীই সফল হয়েছে।আর এর মধ্যে এ প্লাস পেয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার শিক্ষার্থী।কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৯৯% স্ট্যাটাস ছিলো এই এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ছবি ও সাফল্য নিয়ে।বাকি ১১ লক্ষাধীক শিক্ষার্থী যারা পাশ করেছে কিন্তু এ প্লাস পায়নি- তাদের নিয়ে কারো উচ্ছাস নেই।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো খালাতো বোনের চাচাতো ভাইয়ের শালীর বান্ধবীর মেয়েও যদি এ প্লাস পেয়ে থাকে তাকে নিয়েও ঠিকই স্ট্যাটাস দেই আমরা, কিন্তু আপন বোন- ভাইজি যদি এ প্লাস না পেয়ে মোটামুটি রেজাল্ট করে সেটা নিয়ে আমরা উচ্ছাস করিনা।বরং কেনো এ প্লাস পায়নি সেটা নিয়ে আমরা আক্রমণাত্মক কথা বলি, লজ্জা দেই, অন্যদের সাথে তাদেরকে তুলনা করি।এ প্লাস না পেলেই যেনো জীবন বিফল হয়ে গেলো! আমি বলছিনা এ প্লাস পেলে কাউকে ধন্যবাদ দেওয়া যাবেনা, কিংবা সন্তানকে এ প্লাস অর্জনের জন্য আগ্রহী করা যাবেনা।অবশ্যই সবাইকে ভালো রেজাল্টের জন্য উৎসাহ দিতে হবে।কিন্তু সারা বছর বোনের বা ভাইয়ের খবর নেবেননা, শুধু রেজাল্টের দিন তার সাফল্যের খবর দিয়ে ফেইজবুকে কিছু লাইক কমেন্টস কামিয়ে নেওয়ার ধান্দা করবেন- এটা সমর্থন যোগ্য নয়।পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে পৃথিবীতে সবাই এ প্লাস পাবেনা।সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবেনা।এমনকি আপনি নিজেও হননি!
আমার ফ্রেন্ড লিস্টের কাউকেই দেখিনি জিপিএ ৩ পাওয়া কোনো শিক্ষার্থীকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে।সবাই যখন জিপিএ ৫ নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করে তখন যারা কম জিপিএ পায় তারা হীনমন্যতায় ভোগে।আমরা সবাই শুধু বুয়েট, মেডিকেল আর ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়াটা নিয়েই উচ্ছাসিত হই, বাকিদের যেনো উপহাস করি।আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।মনে রাখতে হবে সবাই একই রকম মেধাবী নয়, আবার কেউ মেধাবী হবার পরেও ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা বা অসুস্থতার কারনে একবার একটু কম জিপিএ পেতেই পারে।আমরা যারা অপরের খারাপ রেজাল্ট বা ভালো কোথাও চান্স না পাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করি- তারা নিজের অতীতের রেজাল্ট এবং ক্যারিয়ারের দিকটাও মনে মনে হিসেব করবেন!
মা বাবা এবং ফেইজবুকের পাশাপাশি স্কুল কলেজের শিক্ষকরাও আত্মহত্যার দায় এড়াতে পারেননা।তাদের উচিৎ প্রতিটি শিক্ষার্থীদের এই সব বিষয়ে মোটিভেটেট করা।যে কোনো উপায়ে শুধু ভালো রেজাল্ট আর প্রচুর টাকা উপার্জনই যে জীবনের একমাত্র লক্ষ হওয়া উচিৎ নয় এই শিক্ষাটা শিক্ষকদেরই তরুণদের মনের ভেতর রোপন করে দিতে হবে। একজন মানুষ কতটা মানবিক, কতটা সৎ এবং কতটা পরোপকারী – সেটাই যেনো তাকে মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়। শুধু তথাকথিত জিপিএ 5 এবং টাকা দিয়েই যেনো মানুষকে মূল্যায়ন করা নয়- এই শিক্ষাটাও তরুণদের দেওয়া উচিৎ।
আসুন আমরা এরপর থেকে সন্তানের সকল ছোটো ছোটো সাফল্যকেই মূল্যায়ন করা শিখি।এমনকি ব্যার্থতা থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় সেটাও তাদের হাসি মুখে শেখাই।অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ তাদের কোমল মনকে যেনো ক্ষতবিক্ষত করে না দেয় সেটার দিকে খেয়াল রাখুন।নাহলে এই আত্মহত্যার মিছিল একদিন আপনার পরিবারেও ঢুকে যেতে পারে!
🌳
মেহেদী হাসান বাবু ফরাজী
প্রকাশক, আজকের মঠবাড়িয়া।