ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূল - বলেশ্বর নদের বড়মাছুয়া-শরণখোলা ফেরি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন কাল

বলেশ্বর নদের বড়মাছুয়া-শরণখোলা ফেরি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন কাল

দেবদাস মজুমদার, মঠবাড়িয়া ও মহিদুল ইসলাম, শরণখোলা 🔴
খুশির জোয়ার বইছে বলেশ্বর নদের দুই পারে। স্বাধীনতার ৫০বছর পর স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে দুই উপজেলার মানুষের। ফেরি চলে এসেছে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মাছুয়া এবং বাগেরহাটের শরণখোলার রায়েন্দা ঘাটে সম্পন্ন হয়েছে পন্টুন স্থাপনের কাজ। আগামীকাল বুধবার ( ১০ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ফেরি চলাচল। বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন ও পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. রুস্তুম আলী ফরাজি দুই তীরে সকাল ১১টায় যৌথভাবে ফেরিচলাচল উদ্বোধন করবেন। পরে সাংসদ দ্বয় একই ফেরিতে পারাপার হবেন। এদিকে ফেরি চালু নিয়ে বলেশ্বর নদীর দুই তীরের মানুষের মনে এখন খুশীর বন্যা বইছে। ফেরি চালু হলে মোংলা ও পায়রা বন্দরের মধ্যে ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে।
ইতোমধ্যে মাছুয়া ঘাটের সংযোগ সড়কের কাজ ও রায়েন্দা ঘাটের সংযোগ সড়কের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। । বাগেরহাট এবং পিরোজপুর জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এই কাজ বাস্তবায়ন করছে।

স্থানীয়রা জানান, বলেশ্বরের দুই পারের মাছুয়া এবং রায়েন্দা খেয়াঘাট যুগযুগ ধরে জুলুুমের ঘাট হিসেবে পরিচিত। আড়াই কিলোমিটার এই নদটি পার হতে একজন যাত্রীকে ৫০০টাকাও দিতে হয়েছে কোনো এক সময়। হাতে বহনযোগ্য ব্যাগ এমনকি হাঁস-মুরগিরও টোল দিতে হয়েছে ঘাটে। পান থেকে চুন খসলেই ইজারাদারদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বহু মানুষ। নিয়মিত যাত্রীভাড়া ছিল দেড় শ থেকে দুই শ টাকা। তবে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বর্তমানে সেই খেয়া ভাড়া জনপ্রতি ৫০টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার শেষ খেয়ার পর আর পারাপারের সুযোগ নেই। ফেরি চরাচল শুরু হলে যুগ-যুগান্তরের সেই দুর্ভোগ আর জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাবে দুই পারের যাত্রীরা। বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই খেয়া চলছে বলেশ্বর নদে। তখন ইজারা পদ্ধতি চালু ছিল না। দু-চারআনা খেয়া ভাড়া দিয়েই পারাপার হতো দুই পারের মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই পারের ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করতো এই ঘাট। এক-দুই হাজার টাকা ইজারামূল্য ছিল তখন। পরবর্তীতে বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলার আওতায় চলে যায় ইজারা। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগের অধীনে ছিল বরিশাল জেলা এবং এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ। তখন নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেওয়া হতো। ১৯৯৩ সালে বরিশাল জেলা বিভাগে উন্নীত হয়। প্রথমদিকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে ঘাটের ইজারা দেওয়া হতো। বর্তমানে দুই বিভাগ যৌথভাবে ইজারা নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেশ স্বাধীনের পর ২০-২৫বছর পর্যন্ত শান্তি বিরাজ করছিল দুই পারের ঘাটে। কিন্তু পরবর্তীতে ইজারা নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হলে বাড়তে থাকে জুুলুমও। এর পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতিযোগীতার কোপানলে পড়ে এক-দুই হাজার টাকা থেকে শুরু হওয়া সেই ঘাটের ইজারামূল্য বর্তামানে দাড়িয়েছে ৬৫ লাখ টাকায়। আর এর সমস্ত প্রভাব পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ওপর। শরণখোলাবাসীর পুর্ব পুরুষের বাড়ি বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলায়। বলেশ্বর দুই পারের মানুষের নাড়ির টান শত বছরের। যে কারণে ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে ঝুকি নিয়ে পার হয় খেয়ার নৌকা। সেই জুলুমের ঘাটে ফেরি আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মঠবাড়িয়া ও শরণখোলাবাসী।

সম্ভাবনাময় বলেশ্বরের ফেরিঃ বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হলে উপকূলীয় এই অঞ্চলে সূচনা হবে এক নতুন দিগন্তের। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে অবহেলিত এই জনপদে। ফেরি চলাচলের ফলে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে খুলনার সঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ পরিবহনের তৈরী হবে নতুন ট্রানজিট। যশোর-খুলনা হয়ে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত। পর্যটন শিল্পের আরো উন্নয়ন ঘটবে। মোংলা বন্দরের সঙ্গে পায়রা বন্দরের সহজ যোগসূত্র গড়ে উঠবে। কমে আসবে ৯০ কিলোমিটার পথ। সময় সাশ্রয় হবে প্রায় দুই ঘন্টা। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, পটুয়াখারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে অবহেলিত শরণখোলার শিক্ষার্থীরা।

পেছনে যাদের অবদানঃ স্বাধীনতার পর থেকেই প্রমত্তা বলেশ্বর নদে ফেরির দাবি জানিয়ে আসছে দুই পারের মানুষ। দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বাগেরহাট-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন (প্রয়াত) ২০১৮ সালের ১৭ জুন ফেরির দাবিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ে ডিও লেটার (চাহিদা পত্র) প্রদান করেন। একই সময়ে মঠবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে আরো একটি ডিও লেটার দেন। এই দুই সাংসদের ডিও লেটারের আলোকে মঠবাড়িয়ার আরেক কৃতি সন্তান রেলপথ মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বউদ্যোগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বরাবরে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। তার তৎপরতায় ফেরি বাস্তবায়নের বিষয়টি আরো দ্রুত তরান্বিত হয়। সর্বশেষ বাগেরহাট-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলনের প্রচেষ্টায় আলোর মুখ দেখে দুই উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।

উচ্ছসিত বলেশ্বরের দুই পারের মানুষঃ শিগগিরই ফেরি চালু হবে এই প্রত্যাশায় উচ্ছাস প্রকাশ করছে সবাই। প্রতিদিন ফেরিঘাটে ভিড় করছে শত শত উৎসুক মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু সববয়সী মানুষের আগমনে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি হয়েছে ফেরিঘাটকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন বিকেল হলেই শত শত লোক আসেন ফেরিঘাট দর্শনে। ঘাটের দুই পাশে নতুন নতুন ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করেছে। রায়েন্দা ঘাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম মীর জানান, ফেরি ঘাট হওয়ায় লোকজনরে সমাগম বেড়েছে। বেচাবিক্রিও এখন অনেক বেশি হচ্ছে। আবুল হোসেন রায়েন্দা বাজারের ঝাড়ুদার ছিলেন। ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কের পাশেই তার ছোট্ট বসত ঘর। তিনি ঝাড়ুদারি বাদ দিয়ে তার সেই বসত ঘরের সামনে চা-পান-সিগারেটের দোকান দিয়েছেন। ফেরিঘাট সংলগ্ন বলেশ্বর পারের বাসিন্দা যুদ্ধকালীন স্টুডেন্ট ক্যাম্প কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বাদশা বলেন, আমাদের দুই উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে। ফেরিটি চালু হলে সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের একটা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।

রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতাওঃ বলেশ্বর নদ থেকে একসময় বড় বড় জাহার চলাচল করতো। রায়েন্দা ঘাটে ভিড়তো ঢাকা,খুলনাগামী যাত্রীবাহী দুইতলাবিশিষ্ট লঞ্চ। এখনো মাছুয়া ঘাটে ভেড়ে স্টীমার। তবে, নদের মাঝখানসহ বিভিন্ন অংশে রয়েছে অসংখ্য ডুবোচর। ভাটির সময় আড়াআড়ি কোনো ভারী নৌযান চলতে পারে না। ডুবোচরে আটকে যায়। জোয়ারের অপেক্ষায় থাকতে হয় তখন। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত বলেশ্বর নদের নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং হয়নি। ড্রেজিং করে ডুবোচর অপসারণ করা হলে আবার যৌবন ফিরে পাবে বলেশ্বর।
মঠবাড়িয়ার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন বলেন, মাছুয়া ফেরিঘাট থেকে মঠবাড়িয়া উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। সংযোগ সড়কের ১০০মিটার পর থেকে বাকি সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। অপ্রস্বস্ত এবং ভাঙাচোরা। তিন-চারটি গার্ডার ব্রিজের অবস্থাও খুবই দুর্বল। ফেরি চলাচল শুরু হলে এই সড়ক থেকে ভারী যানবাহন চলতে গিয়ে পড়তে হবে দুর্ভোগে। তাই এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানাচ্ছি।
বাগেরহাটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ১০নভেম্বর ফেরি উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রায়েন্দা অংশের সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষে পথে। বলেশ্বরের এই ফেরির কারণে পায়রা থেকে মোংরা সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার কমে আসবে। ফেরির সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে পিরোজপুর সড়ক বিভাগ।

বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে যোগাযোগ উন্নয়ণে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এক রোল মডেল। তারই ধারবাহিকতায় এই বলেশ্বর নদের ফেরি সড়ক যোগাযোগে আরেক এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হওয়ায় খুলনার সঙ্গে বরিশাল বিভাগ এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের মধ্যে তৈরী হবে এক সেতুবন্ধন। এই ফেরি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্ননেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ ব্যাপারে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. রুস্তুম আলী ফরাজি বলেন, যুগ যুগ ধরে যোগযোগ ব্যবস্থায় উপকূলীয় অঞ্চল অবহেলিত ছিলো। বর্তমান সরকার এ অবস্থার পরিবর্তনে নানা উদ্যোগের ফলে বদলে যাচ্ছে বিপর্যস্ত উপকূল। বলেশ্বর নদীতে ফেরি চালুর মাধ্যমে পিরোজপুর,বরগুনা,বাগেরহাট, মংলা ও খুলনার সাথে সেতুবন্ধন তৈরী হবে। এই ফেরি উপকূলে অর্থনীতি ও যোগাযোগে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বড়মাছুয়া ঘাট থেকে মঠবাড়িয়া সদরের রাস্ত প্রশস্তকরণসহ ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি ব্রীজ নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...