ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - রণি ভাইকে মনে পড়ে ..

রণি ভাইকে মনে পড়ে ..

আসাদুজ্জামান রনি সম্ভাবনাময় এক তরুণ। নিয়তির নির্মমতায় সম্প্রতি রণি কুমিরের হামলায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। এই অনাকাংখিত মৃত্যুতে তরুণ রণির জন্য আমরা সকলেই ব্যথিত। এমন মৃত্যু যেন আর কোন তরুণের না হয়। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তানের এমন হৃদয় বিদারক অকাল মৃত্যুর শোক কখনও শেষ হওয়ার নয়। প্রয়াত রণির জন্য মাগফিরাত কামনা করছি । গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি।

আসাদুজ্জামান রনি, (পিতা- মোঃ গোলাম মোস্তফা, পেশায় একজন সরকারী চাকুরীজিবি। মঠবাড়িয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর হিসাব রক্ষক পদে দীর্ঘদিন কর্মরত আছেন।) তাদের সাথে আমার এবং আমাদের পরিবারের পরিচয় খুব কাছে থেকেই। আর ব্যাক্তিগতভাবে তার সাথে আমার জানাশোনা অনেক আগে থেকেই। সালটা ঠিক মনে নেই তবে ১৯৯৯/ ২০০০ সালের দিকে মঠবাড়িয়া পৌরসভার ৮নম্বর ওয়ার্ড সবুজনগরস্থ আমাদের বাড়ির পাশেই একখন্ড জমিতে বাড়ী করেন। আর সেই থেকেই তার সাথে আমার এবং আমাদের পরিবারের সাথে একটা সখ্যতা হয়ে যায়। “রনি ভাই” বয়সে আমার বড় হলেও সে ছিলো আমার ছোট বেলার খেলার সাথী। সদা হাস্যোজ্জ্বল সদালাপী একজন। গত ২৫ মার্চ এক অনাকাংক্ষিত ঘটনায় আমরা হারালাম এই প্রিয় মুখটিকে। তার সাথে জড়িয়ে আছে বা ছিলো কত স্মৃতি। একসাথে ক্রিকেট, ফুটবল, ক্যারাম আর কতো কি খেলা……।

তার সাথে সখ্যতার অন্যতম কারন ছিলো ছোটবেলায় তাদের বাসায় লুকিয়ে টেলিভিশন দেখতে যাওয়া। তখনকার দিনে ডিস লাইন ছিলো না, মিডিয়ার বিনোদনের একমাত্র ভরসা ছিলো একটা মাত্র চ্যানেল “বিটিভি” যা আবার এলুমিনিয়ামের তৈরী এন্টেনা ঘুড়িয়ে ভালো ছবি আনতে হতো, “রনি ভাই” আবার সেই কাজটি খুব ভালোভাবে করতেন, আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে এন্টেনা বানিয়ে স্বচ্ছ ছবি দেখার ব্যাবস্থা করতেন। ছোটবেলা থেকেই রনি ভাই ছিলেন দুরন্ত আর সাহসী প্রকৃতির মানুষ। আমাদের খুব পাশাপাশি বাসা বিধায় স্কুল বন্ধের সময়টা কাটতো শুধু খেলাধুলা নিয়ে। আর মৌসুমী কোন খেলাই আমাদের বাদ যেতো না, বর্ষাকালে মাঠে ফুটবল, শুকনোর সময় ক্রিকেট আর শীত কালে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। শুকনো মৌসুম এলে আর আমাদের সামনের মাঠের ধান উঠে গেলে রনি ভাই, আলামিন, রুবেল, মিরাজ ভাই, সিরাজ ভাই, সুমন ভাইয়া, টুটুল ভাই, জাকির ভাইয়া সহ মহল্লার সবাই মিলে ক্রিকেট খেলার জন্য পিস বানাতাম। আর আমাদের মধ্যে একটা একাত্বতা ছিলো অন্য রকম। ধানী জমিতে ক্রিকেটের জন্য পিস বানানোর কাজটা একটু কঠিনই ছিলো তাও আমরা সবাই মিলে করে ফেলতাম। রনি ভাইয়ের আবার ক্রিকেটের প্রতি ছিলো অন্যরকম নেশা। খুব ভালো এবং গতিসম্পন্ন বল করতেন, বয়সে তাদের থেকে ছোট হলেও খুব কাছে থেকে মিশতাম। স্মৃতিচারনায় মনে পড়ে গেলো রিনি ভাইয়ের সাথে দুপুরে আমাদের বাসার সামনের পুকুরে গোসল করার দৃশ্যগুলি। আমি তার থেকে ছোট ছিলাম বলে গোসলের সময় আমাকে নিয়ে দুস্টমি করতো, ডুব সাতারেও রনি ভাই ছিলেন দুরন্ত, ডুব দিয়ে খুব দ্রুত পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে চলে যেতেন। আর আমি সাঁতার কাটতে গেলে রনি ভাই আমাকে ডুব দিয়ে ঠ্যাং (পা) টেনে পুকুরের তলদেশে নিয়ে আবার ছেড়ে দিত। মাঝে মাঝে অসম্ভব রকম ভয় পেলেও সময় গুলো ছিলো খুব উপভোগ্য। সপ্তাহের শুক্রবার বা শনিবার আসলেই রনি ভাই মনে করিয়ে দিতেন রুবেল আজ কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আলিফ লায়লা বা সিন্দাবাদ আছে, জাইগীর মাস্টারের কাছে পড়া ফাকি দিয়ে চলে যেতাম তাদের বাসায়, রনি ভাইয়ের আম্মা খুব ভালো মানুষ, আমরা তাদের বাসায় টিভি দেখতে গেলে কখনোই বিরক্ত হতেন না বরং অনুষ্ঠান সূচী আমাদের মনে করিয়ে দিতেন। পশু-পাখিকে খুবই ভালোবাসতেন রনি ভাই, পারিবারিক ছাড়াও ব্যাক্তিগত ভাবে হাঁস মুরগি পালতেন, মাঝে মাঝে দুড়ন্তপনা দেখিয়ে বিভিন্ন পাখি ধরে খাবার খাইয়ে আবার ছেড়ে দিতেন। আবার তার বাড়ী পাহাড়ার জন্য কুকুর কে স্থান দিতেন বাড়ীর সীমানায় এবং খুব সহজে বস করে ফেলতেন। যা অপরিচিত কাউকে দেখলেই সংকেত দিতো। রনি ভাই চলে গেলেন আর তার পোষ্য প্রানি গুলোও নির্জীব হয়ে গেলো। পড়ালেখায় যেমন ভালো ছিলেন তেমনি ছিল তার অসাধারন হাতের লেখা, শুধু পেন্সিল বা কলম দিয়ে যেকোনো কিছুর ছবি একে ফেলতেন, মাঝে মঝে তাদের বাসায় গেলে দেখাতেন আজকে এটা একেছি ওটা একেছি কেমন হলো তা আবার জিজ্ঞাস করতেন, তো একদিন তিনি বাংলাদেশের মানচিত্র বইয়ের মতো হুবাহু একে ফেললেন আমার সামনেই, যা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে, আসলে একটা মানুষের অনুপস্থিতি তার কৃতকর্মগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। আসলে এভাবে বলতে গেলে অনেক কথাই আছে আর এমনি করে অকালে এভাবে প্রস্থান আসলে সবাইকেই কাঁদিয়েছে। যা আসলেই কল্পনাতীত। রনি ভাই ২০০৫ সালে এস, এস, সি এবং ২০০৭ সালে এইচ, এস, সি পাশের পর ঢাকায় চলে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য, তখন আমি মাত্র দশম শ্রেনীর ছাত্র। ঢাকা থেকে যখন বাড়িতে আসতেন তখন আবার আগের মতোই দেখা বা কথা হতো, বানিজ্য বিভাগ নিয়ে পড়ার কারনে তার কাছ থেকে নানান সময়ে টিপস পেতাম, আবার আগের মতো করে সব কিছু চলতো। তবে সময়ের পরিক্রমায় আর সীমাবদ্ধতার কারনে ২০০৮ সালের পর আর তার সাথে তেমন করে মেশা হতো না, তবে বাৎসরিক নানা অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাত হতো আর কি।

২০০৮ এ আমার মাধ্যমিক পাশের পর ঢাকা চলে যাই, এই থেকে তার সাথে দেখা সাক্ষাতের পরিমানও কমতে থাকে, আসলে সময়ের দীর্ঘতায় বা বিবর্তনে মানুষের সাথে সম্পর্কেও বৈচিত্রতা বিরাজ করে। তো একটা সময় শুনলাম সে বিবিএ শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমান এবং পড়াশুনা শেষ করে আবার আপন মাটিতে ফিরেও আসেন। স্বপ্নবাজ তরুন হিসেবে দেশের মাটীতেই ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে। আমার দেখা মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন নম্র ও সদালাপী একজন। এলাকার কারো সাথে কখনো কোনদিন বৈষম্যমূলক আচরন দেখিনি। আসলে খুব কাছে থেকে দেখা মানুষের এমন অকাল প্রয়ান অন্য দশজনের মতো আমাকে পীড়া দিচ্ছে তাই এই স্মৃতিচারনা টুকু না করে আর পারলাম না। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড় আর পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্বটুকু পালন করতেন ঠিক তেমনি করেই। রনি ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা হয় গত ১৯ মার্চ সকাল বেলা, আমি বাড়ী থেকে বাজারে যাচ্ছিলাম আর উনি বাজার থেকে আসছিলেন পথিমধ্যে দেখা হলে আমি কুশল জিজ্ঞাস করতেই বললেন রুবেল ভালো আছো? ব্যাস এটুকুই ছিলো তার আর আমার শেষ কথা, তারপর গত ২২ মার্চ ব্যাক্তিগত কাজে ঢাকা যাই এবং ভাবছিলাম ফিরে এসে ভালোভাবে কথা বলবো, কিন্তু তা আর হলো না আর কোনদিন ভাবিনি ফিরে এসে তার এমন অকাল প্রস্থান দেখতে হবে, আসলে সৃষ্টিকর্তা কার ভাগ্যে কি রেখেছেন তা আমরা সবাই অজ্ঞাত! গত ২৫ মার্চ দুপুর ১২:৪৫ মিঃ এর সময় বাসা থেকে মা ফোন করে বললেন রনি ভাইয়ের এমন অকাল প্রস্থানের কথা, যা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে খবর নিয়ে জানলাম খালাতো ভাই এবং বন্ধুদের সাথে তালতলীর টেংরাগিরি ইকোপার্কে বেড়াতে গিয়ে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের বেষ্টনীর ভিতর প্রবেশ করে কাছে থেকে কুমির দেখতে গিয়ে পানিতে হাত দিয়ে নাড়া দিতেই পুকুরের ঝোপের আড়ালে থাকা কুমিরের আক্রমনে প্রান হারালো রনি ভাই। খুব কাছের এই ভাইটির এমন অনাকাংক্ষিত ভাবে অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। এমন একটি দূর্ঘটনা খালি করে দিবে মায়ের কোল আর পিতার বুক যা যে কারো কাছে স্বাভাবিক নয়। রনি ভাইয়ের বাসা আর আমার বাসার মধ্যে দুরত্বের ব্যাবধান মাত্র একটি নালা-খাল, প্রতিদিন রাতে বাসায় ঢোকার সময় তার পোষ্য প্রানীটার আওয়াজ পেতাম । আজ দুই তিন দিন হয়ে গেলো রণির পোষা প্রাণিরও কোন সাড়া পাচ্ছি না । হয়তো তার মনিবের এমন অকাল প্রস্থানে সেও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, বাসার বেলকুনিতে খাঁচার পোষ্য পাখিটাও বসে আছে চুপচাপ। বাবা মায়ের কতই না স্বপ্ন ছিলো একমাত্র ছেলে সন্তান কে ঘিরে, সব আজ হয়ে গেলো দুঃস্বপ্ন…! শতশত মানুষ খবর পেয়ে আসছে আর যাচ্ছে বাবা-মা কে সান্তনার বানী দিতে কিন্তু তাতে কি আর ফিরে আসবে প্রিয় রনি ভাই কখনো… ? আসবে না, জানি আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে একদিন তারপরেও কিছু কিছু মানুষের এমন অকাল প্রয়াণ মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই, কিন্তু তারপরেও মেনে নিতে হবে। কার ভাগ্যে কেমন প্রস্থান লেখা আছে জানি না, তবে বিধাতার কাছে প্রার্থনা এমন নিষ্ঠুর বিচার করো না আর কাউকে নিয়ে! “আসদুজ্জামান রনি” ভাই যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন… প্রিয় রণি ভাইয়ের জন্য পরম করুণাময়ের কাছে জানাচ্ছি প্রার্থনা।

লেখক : মোঃ তরিকুল ইসলাম রুবেল। এল,এল,বি/এল,এল,এম, সবুজ নগর, মঠবাড়িয়া পৌরসভা ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...