ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভুমি

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভুমি

নূর হোসাইন মোল্লা >

(২য় পর্ব)

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে চীনের ভুমিকা স্পষ্ট নয়। তবে চীন বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতে পিকিংপন্থি দল গুলোকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। উল্লেখ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চীন আমাদের বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র ও সেনাবাহিনীকে গেরিলা ট্রেনিং দিয়েছে। চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বহুবার ভেটো প্রয়োগ করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নেই। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

বিদেশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমেদের আগাম হুশিয়ারী ঃ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করবে সে বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন। সপ্তাহিক “জয়বাংলা” পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সম্পাদক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে এক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে তাঁর মতামত প্রদান করেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষ্যে

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীঃ বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হবে বলে আপনি মনে করেন?

তাজউদ্দিন আহমেদ ঃ তৃতীয় বিশ্বে ফরেণ এইড এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদেরই কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি। এ লেখা পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি শংকিত। এদের অপারেশন হবে অনেকটা এধরনের ঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এরা বিপুল পরিমানে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং নিজেদের তত্ত্বাবধানে সাহায্য বিতরণ করতে চাইবে। সাহায্য যা পাওয়া যাবে, তার ৭৫% ব্যয় হবে তাদের তদারকিতে, সাহায্য প্রেরণের জাহাজ ভাড়ায় এবং তাদের লোকদের খরচ মেটাতে। কিন্তু বাইরে প্রচার হবে, বাংলাদেশে সাহায্যের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে। এ সাহায্য প্রকৃত অভাবী লোকদের হাতে পৌঁছাবে না। সাহায্যের টাকার বদৌলতে সরকারি প্রশাসনে তাদের সমর্থক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করা হবে। দেশপ্রেমিক অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দুর্নীতিপরায়ণ করার চেষ্টা হবে। সরকার বিরোধী এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশীদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাকে টাকা দেওয়া হবে। সরকারি দলের মধ্যে নিজেদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ও দেশাত্মবোধ নষ্ট করা হবে। তারপর বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি এ বিদেশীদের কথামত না চলেন, তাহলে সকল দূনীতি ও খারাপ কাজের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপানো হবে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলা হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণীকে হাত করে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হবে এবং এভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করার পর সিভিল অথবা মিলিটারী ক্যূ ঘটিয়ে পছন্দমত তাঁবেদার সরকার বসানো হবে। শেখ মুজিব দেশে ফিরে কি করতে চাইবেন আমি তা জানিনা। যদি তিনি আমার কথা শোনেন, তাহলে এ বিপদ মোকাবিলা করা যাবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকন্ডে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ভূমিকা ঃ

১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বাইরে সবচেয়ে সংগঠিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল মস্কো পন্থি ন্যাপ এবং কমিউনিষ্ট পার্টি। স্বাধীনতার পর এ দল দুটো প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন না করায় দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে দেশে একটা শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। এরুপ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন, মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম. আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, আগরতলা মামলার আসামী সুলতান উদ্দিন আহমেদ, বিধান কৃষ্ণ সেন প্রমুখ ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন কল্পে মুক্তিযুদ্ধকালিন ৯নং সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম.এ. জলিল এবং আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটা আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য ৫ জন সদস্য ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম জিকু, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, বিধান কৃষ্ণ সেন এবং রহমত আলী। দলের লক্ষ ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং কৃষক-শ্রমিকের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করার মাধ্যমে একটা শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। উল্লেখ্য, ২৩ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক বিভক্তির মধ্য দিয়ে জাসদের উৎপত্তি হয়। জন্মলগ্ন থেকে এ দলটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগ সরকারের প্রবল বিরোধিতা করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের জন্য তাঁরা একটা বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করেন। জনগনের বিপ্লবী সেনাবাহিনীর নামের অন্তরালে সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁদের নিজস্ব কিছু সেল গঠন করেন। গণবাহিণী নাশকতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে টালমাটাল করে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস অভ্যাথ্থান এবং সাত নভেম্বরের পাল্টা অভ্যূথ্থানের লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবু তাহেরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল । লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবু তাহের জাসদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

গোপালগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং জন প্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশ্রাফুল ইসলামসহ অনেকের মতে জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। আমিও তাদের সাথে একমত পোষণ করি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জে.এস.ডি.) সভাপতি আ.স.ম. আব্দুর রব এটা অস্বীকার করে বলেন, খন্দকার মোস্তাক এবং আওয়ামী লীগের কতিপয় লোকেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার ক্ষেত্র প্রস্তুতে জাসদ দায়ী কিনা তা বিচারের দায়িত্ব পাঠকের উপর রেখে দিলাম। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের কর্মকান্ড সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

শিক্ষা দিবস উপলক্ষে সিরাজ-রব পন্থি ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় আ.স.ম. আব্দুর রব স্বাধীনতার পূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার জন্য প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তীব্র সমালোচনা করেন। জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর একটা লোকও না খেয়ে মরতে দেয়া হবেনা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কথা দিয়েছিলেন। আজ না খেয়ে অসংখ্য লোক মারা গিয়েছে। জনতার পক্ষে আ. রব অভিযোগ আনেন যে, খাদ্য দ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম জনগনের ধরাছোঁয়া বাইরে, বাজার সুবিধাভোগীদের হাতে, স্বজনপ্রীতি, সরকারি কর্মচারিদের দুর্নীতি, বেকারত্ব, খুন গূুম, অপহরণ, ধর-পাকড়, পুলিশের অত্যাচার, সরকারের দায়িত্বহীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি। তিনি ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগের লোকেরা পাকিস্তানিদের চাইতে বেশি জঘন্য এবং দূর্নীতিবাজ। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে আ. রব বলেন, আপনি আমাদেরকে বেপরোয়াভাবে ধর-পাকড় করছেন আর উৎপীড়নের সকল কৌশল আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। আপনি আপনার বক্তৃতায় অস্ত্রের কথা বলেছেন। আপনি কি কোন দিন বন্দুক চালিয়েছেন? আমরা জানি অস্ত্র কিভাবে চালাতে হয়। দূর্নীতিবাজ মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে জাতীয় সরকার গঠন করুন। আ. রব বঙ্গবন্ধুর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। কিন্ত আপনি যদি তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন, তাহলে তাঁরা আপনার এবং আপনার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ওই সভায় তিনি ইংগিত দেন যে, শোষিত জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হতে পারে যে কোনদিন । বিধি বাম, বাস্তবতার চাকা উল্টো দিকে ঘুরে গেল। যে বঙ্গবন্ধু ১৮ মাস আগে পাকিস্তান সরকারের শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে অভিযোগের বাণ ছোড়েনে, সেই অভিযোগের বাণ আজ তাঁর বিরুদ্ধে বুমেরাং এর মতো ফিরে এল। এবার জনতার হয়ে সেই আওয়াজ তোলেন আ.স.ম. আব্দুর বর।

(চলমান )
লেখকঃ অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
মোবাঃ ০১৭৩০-৯৩৫৮৮৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...