ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - উপকূলের অর্ধশত বধ্যভূমি অবহেলায় অরক্ষিত !

উপকূলের অর্ধশত বধ্যভূমি অবহেলায় অরক্ষিত !

 

দেবদাস মজুমদার >

অমর্যাদা, অবহেলায় একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের সমাধি ও বধ্যভূমি গুলো অনেকটাই অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। এমনকি এসব বধ্যভূমিতে দৃশ্যমান কোন কোন স্মৃতিস্ত গড়ে না তোলার ফলে শহীদ বেদীগুলো সুরক্ষার বিষয়টি এখনও উপেক্ষিত হয়ে আছে।
উপকূলীয় পিরোজপুরের হাজারো শহীদদের স্মৃতিবহনকারী অর্ধশত বধ্যভূমি অযতেœ আর অবহেলায় যেন বিস্মৃত হয়ে আছে। কিছু বধ্যভূমিতে দায়সারাভাবে ক্ষর্বাকায় কিছু স্মৃতি ফলক স্থাপন করা হলেও তাও এখন বিবর্ণময়। আবার বেশ কিছু বধ্যভূমি নদী ভাঙনের কবে নদীর পেটে চলে গেছে।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সাক্ষ্য বহনকারী ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি অনেক বধ্যভূমি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতও করা হয়নি। নানা কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় বধ্যভূমি চিহ্নিতসহ সংরক্ষেনর উদ্যোগ নেয়া হলেও মাঝপথেই তা থেমে এ ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।baddhobhmi-0000

জানাগেছে ,২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও পাকহানাদার বাহিনী ক্যাপটেন এজাজের নেতৃত্বে ৪ মে পিরোজপুরের প্রবেশদ্বার হুলারহাট বন্দর থেকে শহরে প্রবেশ করে। পথে কৃষ্ণনগর গ্রামের মন্ডল পাড়ায় ২৮ জন নিরীহ মানুষকে গুলিকরে ও বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। ৫ মে শহরের বলেশ্বর নদী সংলগ্ন খেয়াঘাটের সিড়িতে হত্যা করে মহাকুমা প্রশাসক আঃ রাজ্জাক, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান, মহাকুমা পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমান আহম্মেদকে (সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের পিতা)। দখলদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ নিজ হাতে এদের গুলীকরে হত্যা করে। এরপর এই বধ্যভূমির অদূরে চানমারীতে আরও একটি বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা গণপতি হালদার, ফজলুল হক খোকন, বিধান, মন্টু, পুর্নেন্দু, বাচ্চু, সেলিম আখন্দ, মোস্তফা এবং নারী মুক্তিযোদ্ধা ভাগিরথীকে। হুলারহাটের কঁচা নদীর তীরের বধ্যভূমি, কদমতলার পোরগোলা বধ্যভূমি, টোনা ইউনিয়নের তেজদাসকাঠীর খেজুরতলার বধ্যভূমি, জুজখোলার বধ্যভূমি, পাড়েরহাটের বধ্যভূমিতে সদর থানার পাঁচ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হন। মঠবাড়িয়া উপজেলার সূর্যমনির বেরিবাঁধের বধ্যভূমি, ধানী সাফা ইউনিয়নের ফুলঝুড়ি বধ্যভূমি, মিরুখালীর বধ্যভূমি, সাপলেজার বাড়ৈ বাড়ি বধ্যভূমি, বড় মাছুয়ার স্টীমার ঘাটের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় সাড়ে তিন সহাস্রাধিক বাঙ্গালীকে। স্বরূপকাঠীর শুধুমাত্র অটঘর কুড়িয়ানা গ্রামের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় সহস্রাধিক সংখ্যালঘুকে। এছাড়া অলংকারকাঠীর বধ্যভূমিতে শতাধিক, স্বরূপকাঠীর পাইলট বিদ্যালয়ের পিছনের জলাশয়ের বধ্যভূমি, মাদ্রাসার বধ্যভূমি, ভীমকাঠীর বধ্যভূমি, ছৈলাবুনিয়ার বধ্যভূমি, বাশঁতলার বধ্যভূমি, দৈহারীর চিলতলা বধ্য ভূমি, বরচাকাঠীর দুটি বধ্যভূমি, গুয়ারেখার বধ্যভূমিতে হাজার হাজার নরনারীর প্রাণ প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হয়।
নাজিরপুরের শ্রীরামকাঠী বধ্যভূমি, গাবতলার বধ্যভূমি, চৌঠাইমহল বধ্যভূমি, কালিকাঠী বধ্যভূমি, চালিতা বাড়ির বধ্যভূমি, ষোষকাঠী বধ্যভূমি, দীর্ঘা বধ্যভূমি, গোবর্ধন বধ্যভূমি, বলিবাবলা বধ্যভূমি, শাখারীকাঠীর বধ্যভূমি এবং রঘুনাথপুরের বধ্যভূমি রঞ্জিত হয় সহস্রাধিক স্বাধীনতা প্রিয় নাজিরপুর বাসীর রক্তে।devdas-pic-freedom-2

কাউখালী উপজেলা সদরের সন্ধ্যা নদী তীরের (বর্তমান লঞ্চঘাট) বধ্যভূমিতে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কালু মহাজন সহ আওয়ামীলীগের ৫ জনকে। সেখানে পাকবাহিনী টর্চার সেল গঠন করে শতশত নিিরহ মানুষকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তারেদর হত্যৗার পর সন্ধ্যা নদী তীরে ফেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখানে সহস্রাধিক নর-নারীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
কাউখালীর সন্ধ্যা নদী তীরের সেদিনের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী তখনকার লঞ্চঘাটের শ্রমিক আলী হোসেন (৭৫) জানান, বর্তমান লঞ্চঘাটের পাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী একটি ভবনে স্থায়ী ক্যাম্প গতে তোলে। এখানে টর্চার সেল করে সহস্রাধিক মানুষকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ সন্ধ্যা তীরে ফেওলে দেয়া হয়। এ গণ হত্যার স্থানটি সন্ধ্যা নদী গর্ভে চলে গেছে। স্বাধীনতার পর গণহত্যার স্থানটি সুরক্ষার অভাবে তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। তবে নদী তী দায়সারা ভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির একটি ফলক সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে । যা এখন বিবর্ণ আর নদী ভাঙনের কবলে রয়েছে।devdas-pic-freedom-01
মঠবাড়িয়া উপজেলণার সূর্যমণি বেড়িবাঁধের পাড়ে ১৯৭১ সালে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী ২৫ হিন্দু বাঙালীকে এক দড়িতে েেবঁধে গুলি করে হত্যা করে। এ বধ্যভূমিতে ক্ষুদ্রাকার একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করলে পড়ে আছে অযতেœ অবহেলায়। অরক্ষিত এ বধ্যভূমি এখন গোচারণভূমি।surja-moni-badda-bhumi-01

এছাড়া মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের নলী গ্রামের রাজাকার বাহিনীর সাথে স্মূখ যুদ্ধে ১৫ শহীদের আজও স্বীকৃতিই মেলেনি। সেখানের ১৫ শহীদের বধ্যভূমিতে মাটির ভিত্তি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। অরক্ষিত আর উপেক্ষার নলী বধ্যভূমিতে আজও গড়ে ওঠেনি কোন স্মৃতি ফলকও।
এছাড়া মঠবাড়িয়ার ধানীসাফা ইউনিয়নের ফুলঝুড়ি বধ্যভূমি, মিরুখালীর বধ্যভূমি, মিরুখালীর বধ্যভূমি, বড় মাছুয়ার স্টীমার ঘাটের বধ্যভূমিতে শত বাঙ্গালীকে হত্যা করা হলেও আজও এ বধ্যভূমিতে স্মৃতি স্তম্ভ তো দুরে থাক একটা স্মৃতিফলকও স্থাপন করা হয়নি।
এ বিষয়ে মঠবাড়িয়ার সংস্কৃতিজন শিবু সাওজাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর কেটে গেল। যুদ্ধ দিনের নির্মমতা আর বাঙালীর জীবনদানের অবদানগুলো খাটো করে যদি না দেখতে চাই তাহলে অচিরেই বধ্যভূমিগুলো সুরক্ষা করে সেখানে দৃশ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ জরুরী। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের দায় ।

ভান্ডারিয়া থানার পশারীবুনিয়া বধ্যভূমি, কাপালিরহাটের বধ্যভূমি, খেয়াঘাটের বধ্যভূমিতে জবাই করে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে আবার গুলি করে হত্যা করা হয় নিরীহ বাঙালীকে।
এ বিষয়ে ভান্ডারিয়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার সুবেদার আব্দুল আজিজ সিকদার জানান, সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে হানাদার বাহিনী ক্যাম্প গঠন করে। হানাদার বাহিনী শহরের ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করে। ভান্ডারিয়া বন্দর পুড়িয়ে দেয় । হানাদার বাহিনী ব্যাপক ধড়পাকার চালিয়ে কচা নদী তীরের বর্তমান হাসপাতাল সংলগ্ন নদী তীরে শত শত মানুষেকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া পশারিয়া বুনিয়া গ্রামে একটি পরিত্যাক্ত বাগানে স্থানীয় ২৫জন হিন্দু বাঙালীতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য আজও ভান্ডারিয়ার দুটি বধ্যভূমিতে স্তৃতিস্তম্ভ নির্মাণ তো দুরের কথা একটি স্মৃতি ফলকও নির্মাণ করা হয়নি। এসব বধ্যভূমি এখন প্রায় বিলীনের দিকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অকাতরে প্রাণ বিসর্জনের এ জেলার অর্ধশতাধিক বধ্যভূমির মধ্যে শহরের খেয়াঘাটের বধ্যভূমিতে পিরোজপুর পৌরসভা এবং স্বরূপকাঠীর বরছাকাঠী বধ্যভূমিতে গণপুর্ত মন্ত্রনালয় দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। স্বরূপকাঠির বরছাকাঠীর ‘সাত শহীদের এক কবর’টি আত্মীয়-স্বজনরা পাকা করলেও উপকূলীয় পিরোজপুরের অন্যান্য অর্ধশত বধ্যভূমি সংরণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন অঞ্চলের আসাদ নগরের কমান্ডিং অফিসার মুজিবুল হক খান মজনু বলেন, আমাদের অসংখ্য বধ্যভূমি যথাযথভাবে সুর্দিষ্ট করা হয়নি। এমনকি যে গুলো নির্ধরণ করা গেছে সেখানে কোন দৃশ্যমান স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তোলা যায়নি। এটা আমাদের গৌরবের ইতহাসকে খর্ব করে বলে মনে করি। রাষ্ট্র ও সমাজের উচিত কেবল উপকূলের নয় গোটা দেশের বধ্যভূমি সুরক্ষা করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা।

এ বিষয়ে পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মো. খায়রুল আলম সেখ বলেন, পিরোজপুর উপকূলে কয়েকটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। তবে বেশ কিছু বধ্যভূমিতে এখনও তা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আমাদের বধ্যভূমিগুলো আসরে সুরক্ষা করা দরকার। তবে সকারের একার পক্ষেই কেবল নয় স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় সামাজিক উদ্যোক্তা মানুষের সম্মিলিত একটা উদ্যোগে আমাদের বধ্যভূমি সুরক্ষা করা সম্ভব।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...