ব্রেকিং নিউজ

সাবলেট

ম্যারিনা নাসরীন >>

বিয়ের ঘটনাটি আচমকাই ঘটলো বা এমন হতে পারে ঘটবার অবশ্যম্ভাবিতাই ঘটনাটি ঘটাতে সাহায্য করেছিল। আমি অবশ্য কবুল পড়তে খুব বেশি সময় ব্যয় করিনি। হাড়িকাঠে গলা যখন দিতেই হবে দেরী কিসের? কনে পক্ষের সাক্ষী ছিল আমার খালাতো ভাই আজরাফ। ঘটকও সে। আমার প্রেমিক, আমার সখা। একসময় বাংলা সিনেমার পোকা ছিলাম। শাবানার ‘স্বামী কেন আসামি’ রাজ্জাকের ‘বাবা কেন চাকর’ সিনেমা দেখতে দেখতে নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলেছি। ‘প্রেমিক কেন ঘটক’ এই নামে কোন সিনেমা আছে? থাকলেও জানা নেই। কারণ, এখন আমি সিনেমা দেখি না। জী বাংলা, স্টার জলসার সিরিয়াল দেখি। সিরিয়ালের নায়িকাদের মত সাজগোজ করি। মাঝে মধ্যে ঘরের ভেতর শাড়ি পড়ে লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। একবার বাবার সাথে জিদ করে ঈদে পাখির জামাও কিনে এনেছিলাম। যাই হোক, কথায় বলে জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিনে কারো হাত নেই। কিন্তু আমার বিয়েতে যে আমার প্রেমিকের হাত ছিল সে ষোল আনাই সত্য। পাত্রের নাম খান মোহাম্মদ শফিক। আজরাফ ভাইয়ের বন্ধু মানুষ। পাশের গ্রামের খানদানী বংশের উত্তরাধিকারী। তবে বংশসূত্রে শধু পরিচয়টাই যা পেয়েছে আর সব ঠনঠন। তলাবিহীন ঝুড়ি। ভিটেটুকু ছাড়া চাষ যোগ্য এক কানি জমিও নেই। কাঁধের উপর মা, ছোট দুই ভাইবোন। সন্ধ্যায় এক বাস বরযাত্রী সহযোগে শফিক যাচ্ছিল বিয়ে করতে। কনের বাড়ি চুকনগর। বাড়ির কাছাকাছি যাবার পর খবর এল পাত্রী পলাতকা। আজরাফ ভাই বন্ধুবৎসল। প্রায় মধ্যরাতে বাস ঘুরিয়ে বর নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের বাড়িতে। তার আগে অবশ্য বাবার সাথে ফোনে ফোনে ঘটনা বহুদূর এগিয়েছিল। গোয়ালের গরু জবাই হয়েছে। মিল্লাত কাকার বাড়ি থেকে খাসিও একটা কিনে আনা হলো। রান্নাবাড়া শেষদিকে। অন্যদিন শেষ রাতে বিদ্যুৎ থাকে না। কি মনে করে আজ তিনিও আমার বিয়েতে উপস্থিত। আজরাফ ভাই এ কাজ কেন করল সে চিন্তা আমি অনেকবার করেও কূল পাইনি। বিয়েতে সবথেকে বেশি খুশি বাবা। ভেতরে ভেতরে এই খানদানী পাত্রের প্রতি তাঁর নাকি অনেক দিনের লোভ। গভীর রাতে বাবা সারা পাঞ্জাবীতে তিব্বত আতর মেখে খুসবন্ত চেহারা নিয়ে ঘুরে ঘুরে অতিথি আপ্যায়নের তদারকি করছেন। মায়ের মুখের সামনে এক হাত ঘোমটা। বোনের ছেলের অমর কীর্তিতে তিনি যার পর নাই গর্বিত। তার কারণও রয়েছে। ছেলে বিসিএস ক্যাডার। কলেজে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম ক্যাডার মানেই চাইনিজ কুড়োল, বোমা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ক্যাডারে ক্যাডারেও যে এত ফারাক কে জানত? মা কিছুসময় পরপর বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, নিজের মুরোদে তো বিসিএস (বিসিএস কি মা জানেন না তবে বাবার কাছে শুনে বুঝেছিলেন টাকা ওয়ালা কোন চাকরি হবে) ছেলে যোগাড় করতে পারলে না। শেষ পর্যন্ত আমার বোনপোই তোমার কালো মেয়ের আইবুড়ো নাম ঘুচাল। আমি একবার আই এ ফেল্টুস মেরে কোনমতে গতবছর পাশ করেছি। সদর কলেজে নামে বিএ পড়ি। দুমাসে একবার কলেজে যাই কি, যাই না। সারাদিন সিরিয়াল দেখা আর বিছানায় উপুড় হয়ে উপন্যাস পড়া ছাড়া কাজ নেই। ঘরে বাইরে চার চারজন কাজের লোক। প্লেট ধুতে গেলেও এক জন না একজন দৌড়ে আসে। চেহারা আমার খারাপ নয় তবে রঙটা চাপা। সবাই বলে দাদির রঙ পেয়েছি। দাদীর মত রঙ পেয়েছি বলেই কিনা জানি না, মা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে আমাকে কালনিমে ডাকেন। আড়ালে আবডালে দাদিকে বলেন কালনিমে বুড়ি। কালো ধলা যাই হই না কেন, বাবা আমার টাকার গদিতে বসে থাকেন। ইচ্ছে করলে আমাকে সোনার মাদুলি বানিয়ে যে কোন ব্যবসায়ীর গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মনের একটাই শখ, আর যাই হোক, ছেলে হতে হবে বিসিএস ক্যাডার। বড় গলা করে যেন বলতে পারেন জামাই তাঁর মস্ত অফিসার। তবে তাঁর পছন্দের এক নম্বর তালিকায় ছিল পুলিশ। মাছের রাজা ইলিশ জামাইর রাজা পুলিশ। সে চেষ্টা যে বাবা একদম করেননি তা নয়। কিন্তু কে নাকি তাঁকে বলেছে পুলিশেরা বৌ মারে। বৌ মারা জামাইয়ের কাছে কোন বাবাই মেয়ে দিতে চান না তিনিও পুলিশ জামাই খোঁজা বন্ধ করলেন। বিয়ের রাতে আমি ঘুমাইনি। বরের চেহারা কেমন তখনো জানি না। জানতে ইচ্ছেও করেনি। আজরাফ ভাইয়ের সাথে তিন বছর চিঠি চালাচালি করেছি। সম্প্রতি মোবাইলে মেসেজ আদানপ্রদান শুরু হয়েছিল। তবে সে ভদ্র গোছের পুরুষ। আজ কোন রঙের নাইটি পরেছ? ব্রার রঙ কি পিঙ্কি? এই জাতীয় এসএমএস কখনো পাঠায়নি। ফারুক যেমন গভীর রাতে নীতাকে এমন মেসেজ লেখে। নীতা পরদিন পুরো কনভারসেশন আমাকে দেখিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। এত অশ্লীল সব মেসেজ পড়ে আমার কান মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। সে বিচারে আজরাফ ভাই খুবই সংযমী। আমাকে একলা পেয়েও কখনো অসভ্যতা করেনি। মুরুব্বীদের মত কপালে চুমু খেয়েছে কয়েকবার। আমি হেসে লুটোপুটি। সুর করে বলেছিলাম, হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা লাগে না। তিন মাস যাবত আজরাফ ভাই আমার সাথে সাপলুডু খেলছে। কবে নাকি মা তাকে মাথা ছুঁয়ে কড়াল করে নিয়েছে। আমার সাথে যদি কোন সম্পর্ক রাখে তাহলে সে আত্মাহুতি দেবে। আজরাফ ভাই বিসিএস ক্যাডার নয়। ঢাকা থেকে কিসব খেলনাপাতি ছাইপাশ এনে দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেয়। স্থানীয় ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি, বাজারে গানবাজনা হইহুল্লোড় করে রাত দুপুর করে। চাঁদা তুলে তার গাঁয়ে একটা লাইব্রেরী দিয়েছে। আমার পড়া সব উপন্যাসের যোগানদাতা সেই। ভোর থেকেই মেয়ে বিদায়ের তোড়জোড় চলছিল। খান বংশের হবু বৌ পালিয়েছে। আসল পাত্রীর বদলে তাঁদের অফিসার ছেলে কালো এক পাত্রীকে বিয়ে করেছে এ খবর তখন এ গাঁ সে গাঁ। পাত্র তাই আপাতত বৌ নিয়ে ঢাকায় গা ঢাকা দিতে চায়। পরিস্থিতি একটু থিতু হয়ে এলে বৌ বাড়িতে এনে লোক ডেকে খাওয়াবে। আমি এসব মুখে মুখে শুনেছি কিন্তু কোনকিছুর গভীরে যাবার কথা ভাবছিলাম না। কেন ভাবিনি সেটা একটা বিস্ময়। কারণ আমি এমনও গেঁয়ো নই যে নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবব না। মনে হয় ভাবতে ইচ্ছে করছিল না বা আমার মন হয়ত খুব উদাসীন ছিল ।

কবুল পড়ার আগে আমি আজরাফ ভাইকে কিছুক্ষণের জন্য একা পেতে চাচ্ছিলাম। সম্ভবত ইচ্ছে করেই আমাকে সে সুযোগ দিচ্ছিল না। কয়েকবার ফোনও করেছি। একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোবাইল ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে। অবশেষে মেসেজ করেছি, জীবনে যদি একদিনের জন্য আমাকে ভালবেসে থাক, একবার আমার ঘরে এস। আজরাফ ভাই এসেছিল। ওর দুপা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তোমার পায়ে পড়ি, যেখানে খুশি আমাকে নিয়ে চল তবুও অন্যের হাতে তুলে দিও না। মুহূর্তের জন্য আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরল। ওর বুকে তখন সমুদ্রের গর্জন। আমাকে ভাসিয়ে নেবার জলোচ্ছ্বাস। আশান্বিত হয়ে আমি ওর বুকের আরও গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরক্ষণে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। খালার সাথে বেঈমানি করতে পারবে না। দুহাতে সজোরে কলার চেপে আঁচড়ে কামড়ে ওকে রক্তাক্ত করেছিলাম, আমার সাথে কি করছ? এটা বেঈমানি না? ওর দুটো ঠোঁট কঠিন ভাবে নিবদ্ধ। আমি জানি যখন খুব কষ্ট হয় তখন সে নিজেকে এভাবে সামলায়। আমাকে জোর করে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দরজার শেকল তুলে চলে গেল। আত্মহত্যা আমি করতাম না। অত সাহস নেই। কোথাও পালিয়েও যেতাম না। কিন্তু ওকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে গিয়ে এক গভীর শূন্যতার মাঝে ডুবে গেলাম। জানালার গরাদে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। ভোরের আলো ছাইরঙা বালিকার গায়ের রঙের মত ম্লান। দৃষ্টি অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরছিল। দেউড়িতে পড়ে থাকা নানা রঙের গুটি কয় খালি চেয়ার। বরযাত্রী বসার জন্য রাতে এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল। মুরগীর খোপের সামনে মাচানে মাধবীলতা থোকা থোকা হয়ে ঝুলছে। সাদা আর গোলাপি। ওপাশে আর একটু দূরে গরুর গোয়াল। আমাদের লাল রঙের ষাঁড়টির নাম লালু। ওকে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে। ভাড়া করা সাদা রঙের মাইক্রোবাসটি উঠোনে। এটিতে কনে বিদায় হবে। রংবেরঙের গোলাপ, রজনিগন্ধা, কাঠমল্লিকা ফুলে তাকে সাজানো হচ্ছে। এই ভোরে এত ফুল কোথায় পেল আজরাফ ভাই? সকাল থেকেই সকলে মেহমানদের তদারকিতে ব্যস্ত। আমার কোন কাজ ছিল না। শরীরে বরের দেওয়া কড়কড়ে নতুন শাড়িতে খসখসে শব্দ। আমার শাশুড়ি আসেন নাই তবে নারী বরযাত্রীরা আমাকে দেখে বেশ হতাশ হয়েছে মনে হল। একজন আরেকজনের গা টিপে বলছিল, আরে এ দেখি মা কালি! আমি শুনে ফেলেছি। সে কারনে নয় কিন্তু জানিনা কেন চোখের কোণে ঘনঘন পানি জমছিল। টেবিল থেকে শরৎ সমগ্রের পাতা উল্টে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়িগুলো দেখে নিলাম। আজরাফ ভাই দিয়েছিল। দুপাতার মাঝে পাপড়িগুলো ঠিকঠাক সেঁটে ছিল। শধু আমরাই কবে যেন আলাদা হয়ে গিয়েছি। জ্যাম লাগানো দু পিস পাউরুটির মত। ও কিন্তু আমার দিকে একটুও খেয়াল করছিল না। বা করলেও আমার নজরে পড়েনি। শুধু দেখেছি দুই একবার কাছে এসে ভীষণ ব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। সূর্য উঠতে উঠতে পাড়ার বৌ মেয়েরা দলে দলে হাজির হল। নিজের ভাবি পাড়ার ভাবীরা মিলে আমার মুখে, সারা শরীরে খুব করে ফাউন্ডেশন, পাউডার ঘষল। আয়নায় দেখলাম মুখটা ওরা কুমড়োর জালির মত করে ফেলেছে। ঠোঁট টিয়ে পাখির ঠোঁটের মত লাল টুকটুকে। চোখ দুটো কাজলের ভারে বুজে আসছে। পানি দিয়ে খুব করে রগড়ে সব ধুয়ে ফেললাম। পাড়ার মুকুল ভাবি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, এত কিসের ঢংরে তন্দ্রা? শানজরের সময় বরকে কালো মুখ দেখাতে তোর ভাল লাগবে ? আমি কিছু বললাম না। তবে আয়নায় যখন আমাকে আর বরকে একসাথে দেখাল তখন খুব বেমানান লাগছিল। বরের মুখটা গোপাল মার্কা সাদা ধবধবে,গোলাপি রঙের ঠোঁট। মেয়েলি চেহারা। ফর্সা মুখ সরিয়ে আমি সেখানে আজরাফ ভাইয়ের মুখ বসিয়ে নিলাম । দুজনকে বেশ মানিয়ে গেল। শ্যামলা, বড়বড় চোখে টলটলে দীঘি । ওই চোখের দিকে চেয়ে আমি সাত জনম অপলক কাটাতে পারি। মাইক্রোবাসে তুলে দেবার সময় মেজ ভাবি সবার থেকে বেশি কাঁদল। সিরিয়াল দেখে সেও অভিনয় শিখে গিয়েছে। মা মুখে আঁচল চেপে বিনবিন করে কাঁদছে। মায়ের কান্না অভিনয় নয়। মনে মনে বললাম কালনিমে মেয়ের জন্য কাঁদছ কেন মা? বাবা দূরে হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইল। আমি স্পষ্ট দেখলাম তাঁর লম্বা দাঁড়ি বেয়ে ফোটায় ফোটায় পানি ঝরছে। আমি একদম কাঁদলাম না। কেউ কেউ টিপ্পনী কাটছে, তন্দ্রা বাপ মায়ের জন্য একটু কাঁদলে মেকআপ নস্ট হবে নারে। মেজ ভাবি কানে কানে বলল, তন্দ্রা জোর করে হলেও একটু কাঁদতে পারিস না? লোকে কিসব বলছে শুনেছিস? আমিও চুপিচুপি বললাম, ভাবি, চোখে একটু গ্লিসারিন লাগিয়ে দাও না।

আজরাফ ভাই আমাকে হাত ধরে গাড়ীতে বসিয়ে দিতে এলে আমি ওর কড়ে আঙ্গুলটিকে এমনভাবে চেপে ধরলাম যে ছাড়িয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। একসময় ওর আঙ্গুল আমার হাত ছাড়ল। আমি বুঝলাম, আমি ওকে চিরতরে হারালাম। নবদম্পতিকে নিয়ে মাইক্রোবাস আমাদের উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এল। আমি একবারের জন্য ফিরে তাকাইনি। আমার যা কিছু ছেড়ে যাচ্ছি সবই মায়া! সবই পেছন। যাত্রী মাত্র চারজন। সামনে ড্রাইভার আর তাঁর সহকারী। মাঝের সীটে আমার পাশে আমার স্বামী। সূতলির মত চিকন রাস্তা। এই রাস্তায় চারচাকার ইঞ্জিন গাড়ী এসেছে ক্বচিৎ। মোজাম চাচার লাশ নামাতে এ্যাম্বুলেন্স এসেছিল সেই দুবছর আগে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে অজানা কোন রোগে মরেছিলেন তিনি। হানিফ দাদার পুকুরের পাশে রাস্তাটি বিপদজনক ভাবে কোমর বাঁকিয়েছে। ওপাশে গর্ত। একটু এদিক ওদিক হলে মাইক্রোবাস হয় পুকুরে, নয় গর্তে পড়বে। আমার স্বামী নেমে ওটুকু হেঁটে পার হতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি নামতে রাজী হলাম না। সেও নামলো না। গাড়িটি খাঁদে পড়ে যাক। প্রেমিকার লাশ দেখে আজরাফ ভাইয়ের চেহারা কেমন হবে? কল্পনা করে মনে মনে বিজাতীয় উল্লাস বোধ করছিলাম। ড্রাইভার এক্সপার্ট। কিছুই হলো না। আমাদের গাড়ী বড় রাস্তা ধরে ঝড়ো বেগে দৌড়ুচ্ছে। আমার স্বামী গা ঘেঁষে এল। আমি জানালার কাছে আর একটু সরে মাঝখানে আজরাফ ভাইকে বসিয়ে দিলাম। লোকটি তাকে ডিঙিয়ে আরও কাছে চলে এল। এবার আর কিছু বললাম না। কেন জানি তার শার্টের স্পর্শ, মিষ্টি পারফিউমের সুবাস ভাল লাগছিল। শোন, আমার নাম শফিক। তুমি আমাকে শফিক নামে ডাকতে পার। ওগো হ্যাঁগো বলার দরকার নেই। বাহ, কণ্ঠ তো খাসা। শিমুল মুস্তফার মত ভরাট। শিমুল মুস্তফার আবৃত্তির ক্যাসেট আমাকে বড় ভাইয়া এনে দিয়েছিল বেশ আগে। কয়েকটা কবিতা মুখস্ত করে ফেলেছি। আমি ঘাড় এমন ভাবে নাড়লাম যাতে হ্যাঁ না কিছুই বুঝায় না। সারারাত না ঘুম, না খাওয়া শরীরের মধ্যে ঝিমঝিম করছিল। এই তন্দ্রা কি হলো কাঁদছ কেন? বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? লোকটির মুখে তন্দ্রা নামটি অন্যরকম শোনাল। আমি কি কাঁদছিলাম? ঘুমের মধ্যে হয়ত কেঁদে থাকতে পারি কারণ চোখ ভেজা। বাইরে তাকিয়ে মাথার মধ্যে একটা ঘূর্ণন বোধ করলাম। আমাদের গাড়ী পানিতে ভাসছে কেন? শোন, আমরা এখন ফেরীতে। চল কিছু খেয়ে নেবে। আমি কিছু খাব না। খেতে তো হবেই। আসার সময় আজরাফ আমাকে বলে দিয়েছে তুমি কিছু খাওনি। যেভাবেই হোক তোমাকে যেন খাওয়াই। লোকটি আমার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ফেরির দোতলায় উঠিয়ে নিয়ে এল। আমার সামনে টেবিলে ইলিশ মাছের ঝোল আর পানির মত ডাল। আমার চোখ থেকে দু-ফোঁটা পানি ডালের পরিমান বাড়িয়ে দিল। শফিক কিছু বলছে না। আমিও কিছু বলছি না। ডালের পানি বাড়তেই থাকে। সারা ঢাকা শহর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাদের গাড়ী যে রাস্তায় এসে থামলো তার দুপাশে ইমারতের মত বিশাল সব দালান। একটু নির্জন। আগে ঢাকায় অনেকবার এসেছি। বড় বোনের বাসায়, মিরপুরে। দুবছর হল আপা সংসার নিয়ে সিঙ্গাপুরে। তারপর থেকে আর ঢাকায় আসিনি। নিউমার্কেট, গাউছিয়া, মিরপুর, ধানমন্ডি, এসব কিছু জায়গার নাম ছাড়া ঢাকার কোনকিছু আমার চেনা নেই। এটা কোন এলাকা বুঝতে পারছি না। আমরা গাড়ী থেকে নেমে সেসব দালানে ঢুকলাম না। বরং পাশের এঁদো একটা গলিতে প্রবেশ করলাম। সম্ভবত নর্দমার উপরে স্লাব বসিয়ে রাস্তা করা। স্লাবের ফাঁক দিয়ে নর্দমার ময়লা উপচে পড়েছে। ঘিঞ্জি বাড়ি গুলো একটার গায়ে সেঁটে আরেকটি দাঁড়িয়ে আছে। বুঝা যাচ্ছে অনেক পুরনো আমলের ঘরবাড়ি। শফিক স্যুটকেস হাতে নিয়ে আগে আগে আমি পেছনে। বেতন পাই আঠার হাজার বুঝেছ? বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠাই পাঁচ হাজার। রাজীবকে তো দেখনি, আমার ছোট ভাই। বরিশাল মেডিকেলে পড়ে। কি একটা পরীক্ষা চলছে আসতে পারেনি। ওকে দিতে হয় পাঁচ হাজার। থাকে কত? একটা স্লাব থেকে অন্যে স্লাবে পা ফেললে ঢক করে আওয়াজ হলো। আরে কি হলো, পড়লে নাকি? সাবধান, সামনে দেখ ম্যানহোলের ঢাকনা নেই। তোমার বাবার কাছে তো অঢেল পেয়েছ। আমার সাথে একটু কষ্ট হবে বুঝলে? সামনেই সরকার নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করবে। তখন আমার বেতন প্রায় ডবল হয়ে যাবে। তখন আর অভাব থাকবে না। শফিক বিনবিন করছে। আসার সময় বাবা ওর হাতে এক বান্ডিল টাকা দিতে চেয়েছিল। সে নেয়নি। কোনদিন নেবেও না বলেছে। মা আমার জন্য একজন কাজের মেয়ে দিতে চেয়েছিল তাঁদের বিসিএস জামাই রাজী হয়নি। আমার ভেতরে অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। কি খাব, কোথায় থাকব এসব নিয়ে ভাবছি না। আসার সময়ে আজরাফ ভাইয়ের চোখে একফালি মেঘ দেখেছি। বৃষ্টি জমার আগেই খুব দ্রুত সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। বা আমার ভুল অনুমানও হতে পারে। যাবার আগে চুপিচুপি বলেছিল, একদিন ঠিকই বুঝবি আজ যা হল খুব ভাল হলো। অন্তত তোর জন্য। কণ্ঠটা কি একটু ভেজা ছিল? কে জানে। আমরা সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছি। সরু লম্বা লম্বা ধাপের সিঁড়ি। পলেস্তারা খসে লালচে ইট বেরিয়ে আছে। পলিথিন, ডিমের খোসা, ছেঁড়া ঠোংগা পুরো সিঁড়ি জুড়ে উপচে পড়া আবর্জনা। এদিকটায় ভাড়া একটু কম, বুঝেছ? ভদ্রলোক বুঝেছ শব্দটা বেশি বলে। ভাড়া আর খাওয়া দাওয়া মিলে আট হাজারে চলে যায়। এখন তুমি আছ একটু কঠিন হবে অবশ্য। দেখা যাক। আল্লাহ ভরসা। স্বল্প আলোয় আমাদের ছায়া সিঁড়ি পাড়ায় তিরতির করে কাঁপছে। দীর্ঘ একটি পুরুষ ছায়ার পেছনে বেঁটে খাটো নারীর ভৌতিক ছায়া। এসে পড়েছি । বাড়িওয়ালী খালাম্মা একটু রাগী তবে মন ভাল। তোমাকে একটু মানিয়ে চলতে হবে। পারবে না? শফিক আমার জবাবের অপেক্ষা করছে না। আমরা তিনতলায় উঠে এসেছি। ভেতরে কলবেল বাজছে। শুকনো ঢ্যাঙ্গা মত একজন বৃদ্ধ মানুষ দরজা খুলে দিলেন। একগাল হেসে বলেন, আরে শফিক যে, রোহণের মা, দেখে যাও শফিক নতুন বৌ নিয়ে এসেছে। বুঝা গেল বিয়ে করতে যাবার খবর তারা জানে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম বাড়িওয়ালার বাসায় আমাকে কেন নিয়ে এল? ওর বাসা কত তলায়? তেল-কালি লাগানো শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে রোহণের মা আসলেন। ছেলের নাম যতটা আধুনিক ভদ্রমহিলা ততটা আধুনিক নন। শরীর স্থুল থাকার কারনে বেশ হাঁপাচ্ছেন। এত্ত রাত হল কেন? আমরা তো কেবল খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম।এখন খাবে কি? ভদ্রমহিলা যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বলার চেষ্টা করলেন।

খালাম্মা, আমাদের খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি বাইরে থেকে নিয়ে আসব। আহা, এখন কোথায় খাবার পাবে? রাত প্রায় বারটা বাজে। রোহণের মা দুটো চাল চড়িয়ে দাওনা । জবাবে বাড়িওয়ালী বিপুল বেগে চোখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। খালুজান থামেন তো। কিছু না কিছু পেয়ে যাব। আসবাবে ঠাসা একটি ঘর পার হয়ে অন্ধকার সরু আর একটি প্যাসেজ দিয়ে আমরা অন্য একটি বন্ধ দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। শফিক পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলছে। আমি তখনো আজরাফ ভাইয়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। মনে মনে নাটাইয়ের সুতো ছেড়েই যাচ্ছি। তা না হলে বুঝতাম ঘরের মধ্যে ঘরে আমার স্বামীর বাসা কেন? এমন রাজপুত্রের মত ছেলে দেখ, কি বিয়ে করে এনেছে। কালো পাতিল। খালাম্মা বোধ হয় নিচুস্বরে কথা বলতে পারেন না । চুপ চুপ আস্তে শুনে ফেলবে। আমার কাছে তো ভালই লাগলে। রংটা একটু চাপা। তোমার তো দুনিয়ার সকল মেয়েই পছন্দের। সুন্দরের কি বুঝ? বাড়িওয়ালীর কথা শফিকের কানেও গিয়েছে নিশ্চয়। ও আমার দিকে একটু তাকিয়ে শুষ্ক হাসলো। আমি নির্বিকার। কারণ শিশুবেলা থেকেই এসব শুনে অভ্যস্থ । ফুল নেই, নেই আলোকসজ্জা, বিয়ে বাড়ির হৈচৈ নেই, নতুন বৌ এর জন্য সামান্যতম আয়োজন নেই। স্বামীর ঘরে আমার গৃহ প্রবেশ ঘটল। শফিক খাবার আনতে বাইরে গিয়েছে। মাঝারি সাইজের ঘরটির মাঝখানে আমি নববধূর সাজে দাঁড়িয়ে আছি। একপাশে একটা চৌকি। তোষকের উপর বেড কভার নেই। মশারীর দুপাশ খুলে অন্য দুপাশে লটকে রাখা। জানালার গ্রিলে লুঙ্গি নেড়ে সম্ভবত পর্দার কাজ চালানো হয়েছে। কাঠের চেয়ার টেবিল। রঙহীন। টেবিলে রাজ্যের বই। বিশাল একটা আলনায় লুঙ্গি, প্যান্ট-শার্ট জড়াজড়ি করে ঝুলছে। আন্ডারওয়ার মেঝেতে। তবে এক পাশের দেওয়াল জুড়ে বই রাখার যে সেলফ রয়েছে সেটা প্রায় ছাদ অবধি উঁচু। কাঠের নকশা অত্যন্ত নান্দনিক। প্রতি তাক বইয়ে ঠাসা। আমি একটু একটু করে সেদিকেই যাচ্ছিলাম। তুমি বই পড়তে পছন্দ কর? আরও অনেক বই তোমাকে এনে দেব। বই পড়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা তুমি পৃথিবীর অন্য কিছুতে পাবে না। শফিক ফিরে এসেছে হাতে খাবারের প্যাকেট। ঘর কি একটাই ? এই প্রথম আমি সরাসরি কোন প্রশ্ন করলাম। হ্যাঁ একটাই । রান্নাঘর নেই? সাবলেট বাসা তো। আমি বাইরে খাই। তুমি খালাম্মার রান্নাঘর ব্যবহার করতে পারবে। ও এজমালি। কয়েকদিন। খুব তাড়াতাড়ি দুই রুমের একটা বাসা নিয়ে আমরা চলে যাব। ওকে খুব বিব্রত লাগছে। ‘সাবলেট’ নামটির সাথে আমার পরিচয় ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, সাবলেট কি? বলল, পরে বুঝিয়ে বলব। সেই ভোর থেকে ভারী শাড়ি পরে আছ। এখন গোছল সেরে এস। ভাল লাগবে। খুব ক্লান্ত লাগছিল। গোছল করতে পারলে ভাল লাগতো কিন্তু সেটার কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছিল। টের পেল কেমনে জানি না। নিজেই সুটকেস খুলে দিল। আমি কাপড় বের করে গোছল করতে গেলাম। ঘরের সাথে চিলতে একটা বারান্দা তার সাথে বাথরুম। ঘরের তুলনায় বেশ বড়। গোছল সেরে ঘরে ঢুকে দেখলাম শফিক বিছানায় একটা চাদর বিছিয়েছে। বড় বড় ফুলের জংলী ছাপা। চাদরটি ঘরের উজ্জ্বলতা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। টেবিলের উপর ডাই করা বই ভদ্রমত হয়ে এক জনের উপর আর একজন উঠে গেছে। টেবিলে অন্যপাশে একটা প্লেট, খাবারের প্যাকেট এক গ্লাস পানি। মশারী বিছানার একপাশে ভাঁজ করা। আলনা আগের মতই তবে আন্ডার ওয়ার গোপন কোন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। আমাকে দেখে একটু লজ্জিত হল। ঘর খুব অগোছালো ছিল।তাই গুছিয়ে নিলাম। গোছল শেষ? ভাল লাগছে না একটু? আমি ঘাড় নাড়লাম। আচ্ছা এস, খাবার দিয়েছি। বেশি কিছু পেলাম না। কাচ্চি বিরিয়ানি। খেয়ে নাও। আমি গোছল সেরে আসছি। ফেরীতে শুধু কাঁদলেই কিছু খেলে না। বললাম, আপনিও তো খাননি। আসেন একসাথে খাব। দুজনের জন্য চৌকিটা মোটেই প্রশস্ত নয়। আমরা দুজনেই যথাসম্ভব নিজেকে গুটিয়ে একে অন্যের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের মাঝের সমতল স্পেসে কে যেন অদৃশ্য বেড়া তুলে দিয়েছে। ওর নিঃশ্বাসের ওঠানামা আমি টের পাচ্ছি সেই নিঃশ্বাসকে অস্বীকার করে আমি অন্য একজন পুরুষকে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছিলাম। একসময় তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। আমি আলগোছে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে জোছনার আলো থই থই করছে। বাইরে বিল্ডিঙের ফাঁকে ফাঁকে আলো আঁধারির খেলা। দূরের অনুজ্জ্বল আলোর রাস্তাটি এই অচিন রাতটির মত অফুরন্ত লম্বা। সেদিকেই দৃষ্টি পেতে সীমানা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। তন্দ্রা! আমি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠলাম। মানুষটা আমার কাঁধে হাত রেখেছে। হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আমার শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, রুমঝুম, রুমঝুম। আমি কোন রকম তার মুখের দিকে তাকালাম। ও আমাকে দুহাতে বুকের মধ্যে আকর্ষণ করে বলল, কাকে ভাবছ? আজরাফকে? আমি আর একবার আমুল কেঁপে উঠলাম। তুমি তখন সাবলেট কি জানতে চেয়েছিলে না? আমি চুপ। এই যে বড় বাড়িটা দেখছ, এটির পুরোটা নয়, একটি ছোট্ট অংশ নিয়ে আমি ভাড়া থাকি। এটা এক ধরণের সাবলেট। আবার ধর, তোমার মনটা একটা বিশাল বাড়ি। ওই বাড়িতে এখন শুধুমাত্র আজরাফ বাস করছে। তুমি আমার সংসার করতে করতে যখন অভ্যস্থ হয়ে যাবে তখন হয়ত আমার ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ সে বাড়ির এক কোণে আমাকেও থাকতে দেবে। সেটাও এক ধরণের সাবলেট। শফিক হাসছে। মানুষের হাসিতেও এত কান্না মেশানো থাকে? শফিক চলে যাচ্ছে। আমি গ্রিলে মাথা রেখে ওর অপ্সৃয়মাণ অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকি। চাঁদের আলো ঢাকা পড়েছে। পুরো আকাশে ঘন কালো মেঘ। বাতাসে শোঁশোঁ আওয়াজ। এখনই হয়ত ঝড় উঠবে। প্রচণ্ড ঝড়।

 

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...