কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ আর নেই

মেহেদী হাসান বাবু ফরাজী: বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আজ (তারিখ ও সময় উল্লেখ করে) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। তার মৃত্যুতে জাতি হারালো এক প্রবীণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদকে, যার জীবন ছিল দেশের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।


১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর ভোলার কোড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তোফায়েল আহমেদ। পিতা মৌলভী আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা বেগম ছিলেন এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। মেধাবী ছাত্র তোফায়েল আহমেদ ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, যা তাকে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ছাত্রনেতায় পরিণত করে।

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি হিসেবে তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাকে ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন, যা পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, ১৯৭০ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ‘মুজিব বাহিনী’র অন্যতম চার অঞ্চলভিত্তিক অধিনায়কের একজন, যার দায়িত্বে ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত পশ্চিমাঞ্চল।


স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদ প্রতিষ্ঠায় এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ভোলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তোফায়েল আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ ৩৩ মাস কারান্তরালে থাকার পর ১৯৭৮ সালে কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন, যা তার প্রতি জনগণের অগাধ আস্থা ও ভালোবাসার প্রমাণ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি শিল্পমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। গত ২৪ সালের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের আগে থেকেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।

তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তার বর্ণাঢ্য জীবন ও দেশের প্রতি নিবেদিত কর্ম তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এই কিংবদন্তি জননেতাকে স্মরণ করবে।

About The Author

Leave a Reply