ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন

বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয় করা জরুরী প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এ কাজটি হয় নি। এ ব্যাপারে মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্ণেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী আদৌও আগ্রহী ছিলেন না।
ভারত সরকার আমাদের মুক্তিবাহিনী ও প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য , প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী কামানের গোলা ছুড়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত বা এলোমেলো করে দিত।তারপর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়ে যুদ্ধের তৎপরতা পরিচালনা করতেন এবং লক্ষ্য পূরণ করতেন।পরে ক্রমাগত অবনতিশীল পরিস্থিতিতে যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে উঠলো তখন ভারতের পক্ষ থেকে সমন্বয়ের বিষয়টি আসে এবং যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের বিষয়টি প্রথমে ওঠে রাজনৈতিক পর্যায়ে। মুজিবনগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এ বিষয়টির দায়িত্ব কর্ণেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে প্রদান করেন। তিনি বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন হোক এটা চান নি।তাঁর মতে, আমাদের সামরিক তৎপরতা আমরা পরিচালনা করব। তাছাড়া, যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের ভিত্তি কিসের ওপর হবে? ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে কাশ্মীরের মত বাংলাদেশকে একবার দখল করে নিলে, যদি না ছাড়ে তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে শেখ আবদুল্লাহর মত হতে হবে। আগে স্বীকৃতির বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পর যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন করা যেতে পারে। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হলে রাজনৈতিক পর্যায়ে যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে মস্কো সফর করেন। ৯ আগষ্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।এ চুক্তির ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় সাহায্য বেড়ে যায়। মিসেস গান্ধী মস্কো থেকে দেশে ফিরে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সীমান্ত তৎপরতার বাধানিষেধ তুলে নেন এবং সেনাবাহিনীকে স্পষ্ট বলে দেন যে,যদি ঘটনার চাপে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়, তাহলে করতে পারবে।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজেরাই যুদ্ধে নেমে পরে।আমাদের সেক্টরগুলোকে যে দায়িত্ব দেয়া হত অনেক ক্ষেত্রে পালন করতে পারত না। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেই দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হত। পাশাপাশি দুটো কমান্ড, একটি ভারতীয় অন্যটি আমাদের সেক্টর কমান্ড। কিন্তু যুদ্ধ একটি।
অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের একটি তাত্ত্বিক রুপরেখা রচিত হয়। যৌথ সামরিক কমান্ড পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরার ওপর।তিনি বাংলাদেশ রণাঙ্গনকে চারটি সেক্টরে,যথা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য সেক্টরে ভাগ করেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত যুদ্ধে নেমে পড়ে। তারা বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে এবং ট্যাংকসহ ২ ডিভিশন সৈন্য যশোর জেলার ঝিকরগাছায় ঘাঁটি স্হাপন করে। কিন্তু আমাদের সেক্টরগুলো সীমান্ত যুদ্ধে খুব একটা এগোয় নি।তারা দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধে ব্যস্ত।২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্যে ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধির নিকট চিঠি প্রেরণ করেন।
পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করা তথা মুক্তিযুদ্ধে ভারত যাতে সাহায্য করতে না পারে সেজন্যে ৩ ডিসেম্বর বেলা শেষে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি শহরে বোমা বর্ষণ করে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। সংবাদ পেয়ে দ্রুত দিল্লীতে ফিরে গিয়ে মন্ত্রী সভার বৈঠক করে এদিন মধ্য রাতে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৪ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিন বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে এক চিঠিতে বলেন, আমাদের মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনো ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। চিঠিতে আমাদের দু দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্হাপনের জন্যে দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ সামরিক কমান্ডের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়। যৌথ সামরিক বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। যৌথ সামরিক বাহিনীর আক্রমণে তারা পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ সামরিক বাহিনীর নিকট সারেন্ডার করলে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
এযুদ্ধ সম্পর্কে বাংলাদেশ বাহিনীর উপ প্রধান এ, কে, খন্দকার বলেন,যুদ্ধ আমাদের। আমাদের সমর্থ থাকলে ভারতের প্রয়োজন ছিল না।আমাদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না বলেই প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা আমাদের অপরিহার্য ছিল। এমনকি, সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রথম থেকেই যৌথভাবে আমাদের করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সেটা হয় নি। মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ যৌথ সামরিক কমান্ড বা বাহিনী গঠন না করলে ভারতীয় বাহিনী এককভাবে সব কৃতিত্বের দাবীদার হত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সারেন্ডার দলিলে শুধু ভারতের কথাই থাকত। এটা ভারতীয় বাহিনীর বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হত। যৌথ সামরিক কমান্ড বা বাহিনী গঠনের লিখিত চুক্তি না থাকলে আমরা এযুদ্ধের অংশীদার তা প্রমান করতে পারতাম না।এজন্যে মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যদি আমাদের দেশ ত্যাগ না করত, তাহলে আমাদের মহাবিপদ হত। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত নেই। তাঁরা উভয়ই ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আমি তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।

 

নূর হোসেন মোল্লা

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক

গুলশাখালী ইউনিয়ন জিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...