দেবদাস মজুমদার >
শহীদ সওগাতুল আলম সগীর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া মঠবাড়িয়া থানা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি । ইতিহাস সাক্ষী আছে। মানুষের প্রাণপ্রিয় এক অনন্য নেতা তিনি। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা এ মহতী মানুষকে অকালে হারিয়েছি। নির্মমতার জিঘাংসা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। দেশবিরোধী আততায়ীরা নিজভূমে তাঁকে মেহত্যা করেছে! আজ ৩ জানুয়ারী এই মহতী নেতার ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্বাধীনতাকামী জাতির ইতিহাসের দায় আছে। দায় আছে প্রজন্মের কাছে। দেশ ও জাতি গঠনে মহান মানুষের প্রতি আমাদের দায় আছে। দেশ ও মানুষের প্রতি দায় আছে। কেননা আমরা উত্থানের ইতিহাস আগলেই বাঁচি। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে বাঁচি। দলীয় স্বার্থ নয়, দেশ বিবেচ্য বিষয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ দেশের জন্যই হয়। দেশপ্রেমিক বীরের রক্ত কখনও বৃথা যায় না। যেতে পারে না। আমাদের বীরদের রক্তদানও বৃথা যাওয়ার নয়। শহীদ সওগাতুল আলম সগীর সেই বীর। জননন্দিত মহতী এক মানুষ।
১৯৭৩ সালের ৩রা জানুয়ারি সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া থানা থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে আসছিলেন তিনি। হাইস্কুল সড়কের ওপর (বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের পাশে) স্বাধীনতাবিরোধী একদল দুষ্কৃতিকারী এই মহান মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। পরিকল্পিতভাবে বুকের ওপর অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে দুর্বৃত্তদল। গুলিতে তাঁর বুক বিদীর্ণ হয়। রক্তস্রোত গড়িয়ে পড়ে সড়কজুড়ে। নিহত নিথর সেই মহতী মানুষের দরদী শরীর রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল সেদিন সন্ধ্যায় । আর আমরা সেই কাল সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়ার অসীম জনপ্রিয় নেতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। অভিভাবক, ভাই ও স্বজনহারা হই আমরা। আমাদের শোকের আয়ু দীর্ঘ হয় না। আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারও হয় না। জাতি দুর্ভাগা হলে এমনই হয়। বিস্মৃত হয়ে যায় বীরের রক্তস্রোতধারা!
অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক। বেলা এসে ঠেকেছিল অবেলায়। মহতী মুখ বিস্মৃত হয়ে যায়। তবু প্রজম্নের কাছে, ইতিহাসের কাছে দায় টিকে থাকে। দেরি হলেও ঘুরে দাঁড়ায় সত্য ও সুন্দর।
শহীদ সওগাতুল আলম সগীরের ম্যুরাল উন্মোচনের মধ্য দিয়ে সে দায় আমরা আজ অনুভব করি। আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হয়ছে এ মহতী মানুষের ম্যুরাল। তাঁর প্রতিকৃতি এখন আমাদের ঘাতকের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়। আর আমরা মহতী বীরের প্রতিকৃতি ফুলে ফুলে ভরে তুলবার অদম্য সাহস পাই।
মঠবাড়িয়া মুক্তািযোদ্ধা সংসদ ও শহীদ সওগাতুল আলম সগীর স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাশে নির্মিত প্রতিকৃতি উন্মোচন করা হয়। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে ১৭ জন শহীদের তালিকা সংবলিত স্মৃতিফলক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মঠবাড়িয়া কন্ট্রোল রুমের স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়। ১৯৭১ সালে মঠবাড়িয়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা এমাদুল হক খান এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সকল শহীদের স্মৃতি সুরক্ষার লক্ষ্যে এই মহতী উদ্যোগ নিয়েছে। মঠবাড়িয়ার কৃতী সন্তান চিত্রশিল্পী চঞ্চল কর্মকার ম্যুরালটি নির্মাণ করেন। সগাতুল আলম এলাকার গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন। আজও তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।
এই ঐতিহাসিক ম্যুরালটির নির্মাতা শিল্পী চঞ্চল কর্মকার বলেন, কিছুটা দেরিতে হলেও ইতিহাসের দায়বোধে উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছি। আমার সৌভাগ্য ছাত্রনেতা থাকা অবস্থাতেই আমি আরেক কিংবদন্তি ছাত্রনেতার ম্যুরাল নিজ হাতে করতে পেরেছি, যাকে খুনিরা বাঁচতে দেয়নি। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত পূর্বসূরিদের কর্মের ইতিহাস যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারি তাহলে প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।