দেবদাস মজুমদার>>
মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান সেই সাথে নিরাশ্রয় বাঙালীদের আশ্রয়দানের অপরাধে সংঘবদ্ধ রাজাকারদের হামলা প্রতিহত করেছিলেন শিক্ষক রমেশ চন্দ্র মিস্ত্রী। গ্রামবাসির সাথে রমেশ চন্দ্র মিস্ত্রী ও তাঁর আপন ভাই গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রিী ল্যাজা বল্লম আর ঢাল সড়কি নিয়ে সশস্ত্র স্বাধীনতা বিরোধিদের প্রতিহত করেছিলেন। শিক্ষক রমেশ চন্দ্র সেদিনের সম্মূখ যুদ্ধে দুই হাঁটু আর পীঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। কিন্তু ভাই গণেশ চন্দ্র ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। সেই সাথে সেদিনের সস্মূখযুদ্ধে শহীদ হন আরও ১৫জন বাঙালী। স্বাধীনতার পর সহযোদ্ধাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠলেও যুদ্ধাহত শিক্ষক রমেশ চন্দ্র আজও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত হতে পারেননি। সেই সাথে ভাইয়ের জীবনদানেরও স্বীকৃতি পাননি।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত ভীমনলী গ্রামের এক নিভৃত জনপদের মুক্তিকামী বাঙালীর সম্মূখযুদ্ধই ছিল এ জনপদের মুক্তিকামী মানুষের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। বীরত্বের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় ধরে যেন এক জনশ্রুতি হিসেবেই টিকে আছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়ও এসকল বীরের নামও লিপিবদ্ধ হয়নি।
বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র জানান, মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউনিয়নের নলীভীম গ্রামটি হিন্দু অুধ্যষিত এক জনপদ। ওই গ্রামের নলী খালের পাড়ে ওয়াপদা বেড়ি বাঁধ লাগোয়া ৮০টি হিন্দু পরিবরের বসবাস। গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়ই বংশের পরিবারগুলো ছিল এলাকার ধনাঢ্য। মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দুরের ওই গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধ সমকালীন সময়ে আশ্রয়ের জন্য একটি নিভৃত জনপদ ছিল এ ভীমনলী গ্রাম। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে যাতায়াত গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিতাড়িত হিন্দু বাঙালীরাও সেখানে প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নেয়। এ কারনে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধি রাজাকারদের কাছে গ্রামটি টার্গেটে পরিনত হয়।
সাপলেজা ইউনিয়নে সংগঠিত অর্ধ সহস্রাাধিক স্বাধীনতাবিরোধি এলাকায় আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। তারা এলাকায় হিন্দুদের ঘর বাড়ি লুটতরাজ,গণ হত্যা ও নারী নির্যাতন চালায়।
এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ও হিন্দুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ভীমনলী গ্রামের বাড়ই বাড়ি রাজাকারদের বিশেষ টার্গেটে পরিনত হয়। রাজাকারকারা পরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ সালের ২২মে বাড়ই বাড়িতে আক্রমন চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও সেদিন রাজাকারদের পাল্টা আক্রমন করে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সেদিনের সেই সম্মূখ যুদ্ধে রাজাকার লালু খাঁ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। আর রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন ১৫ জন মুক্তিকামী বীর বাঙালী।
ওই যুদ্ধে সেদিন অংশ নিয়ে দুই হাঁটু আর কোমড়ে গুলি বিদ্ধ হয়ে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন সাপলেজা মডেল হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রমেশ চন্দ্র মিস্ত্রী(৫৮)। তবে তাঁর বড় ভাই গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রী সেদিনের সেই যুদ্ধে শহীদ হন। পরে রমেশ চন্দ্র মঠবাড়িয়ার গুলিসাখালী হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদেন। প্রশিক্ষণকালীন সময়ে ৯ নম্বর সেক্টর কমা-ার মেজর (অব:) জয়নুল আবেদীন খান, যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষক সুবেদর মেজর এম.এ লতিফ ও যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষক ছত্রীসেনা গেরিলা এ.এম হাবিবুর রহমান শিক্ষক রমেশ চন্দ্রকে প্রশিক্ষণ প্রত্যায়ন দেন। এরপর যুদ্ধাহত শিক্ষক রমেশ চন্দ্র এলাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, আশ্রয়দান আর খবরাখবর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত থাকেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি ১০ আগস্ট স্থানীয় সাপলেজা মডেল হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। শিক্ষক রমেশ চন্দ্র সম্প্রতি শিক্ষকতায় অবসর গ্রহণ করেন।
স্থানীয়দের সূত্রে জানাগেছে, ১৯৭১ সালের, ২২ মে বাংলা ৭ জ্যৈষ্ঠ রবিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে স্থানীয় একদল সংগঠিত রাজাকার বাহিনী ভীমনলী গ্রামের হিন্দু পাড়ায় সশস্ত্র তা-ব চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা লেজা,সড়কি,বল্লম দিয়ে সশস্ত্র রাজাকারদের প্রতিহতের চেষ্টা করে। রাজাকাররা পাল্টা গুলি চালায়। দুই ঘন্টা ধরে চলে এই পাল্টা আক্রমনের যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে লালু খাঁ নামে এক রাজাকার নিহত হয়। আর রাজাকারদের গুলিতে ভীমনলী গ্রামের মাঠে শহীদ হন ১৫জন বীর বাঙালী। তারপর রাজাকার বাহিনী ভীমনলী গ্রামের ৮০টি হিন্দু বাড়িতে পালাক্রমে তান্ডব চালায়। ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে ওরা ঘর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়,মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ আর আশ্রয়হীন বাঙালীকে আশ্রয় দেওয়াই ছিল আমাদের অপরাধ। আমাদের দুর্ভাগ্য এই বীরত্বগাঁথা আর ১৫ বাঙালীর এ জীবন দান আজও স্বীকৃতি পেলাম না।ওই সম্মূখ অংশগ্রহণকারী কেবল ৫জন মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছেন। আর আমি যুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আর আপন ভাই হারিয়ে আজও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলামনা। এখন জীবনের শেষ বেলায় এসে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম দেখে মরতে চাই।
সেদিনের সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা বীরেন্দ্র নাথ বাড়ই বলেন, ভীমনলীর সম্মূখ যুদ্ধই মঠবাড়িয়ার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। শিক্ষক রমেশ চন্দ্র ওই যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন। তার এক ভাই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আজও রমেশ চন্দ্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।
সাপলেজা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি মো, সুলতান মাহমুদ বলেন, সাপলেজার ভীমনলী স্মূখ যুদ্ধই মঠবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ। সেদিনের যুদ্ধে শিক্ষক রমেশ অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। তবে ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলেও শিক্ষক রমেশ চন্দ্র উপেক্ষিত থেকে গেছেন। এটা দু:খজনক।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সুন্দববন অঞ্চলের আসাদ নগরের ইয়াং কমাণ্ডিং অফিসার মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক মজনু বলেন, মুক্তিযুদ্ধে উপকুলীয় অঞ্চলে যে কয়টি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তারমধ্যে নলী গ্রামের বাড়ই বাড়ির যুদ্ধ অন্যতম ছিল। এ বীরত্বের ইতিহাস এখনও স্বীকৃতি পায়নি। ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলেই মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার।