ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - স্মরণ ◼️ প্রয়াত সাংবাদিক মোস্তফা গোলাম ফারুক বাচ্চু

স্মরণ ◼️ প্রয়াত সাংবাদিক মোস্তফা গোলাম ফারুক বাচ্চু

দেবদাস মজুমদার↪️
সমাজে যখন অস্থিরতা চলে,যখন পরিবেশ প্রতিবেশের ওপর চলে নানা সংকট,নৈতিক অবক্ষয় আর সমাজের নানা বৈরী সময়। তখন আমাদের বুদ্ধিবাদি কেউ এসে পাশে দাঁড়ান। তিনি এক বিদ্বজন। তিনি মানুষ আর সমাজের ক্রান্তিকালে আলোর পথ দেখান। আর আমরা আলো পাই। সে আলোয় আমারা অবিরাম পথ চলি। জীবন হয়ে ওঠে দায়িত্বশীল আর সু দৃষ্টিভঙ্গীর এক জীবন। সে জীবন পশ্চাদপদতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে সভ্যতায় বেড়ে ওঠে। যিনি এমন আলোকিত পথের দিশারী তিনি বিদ্বজনের প্রতিকৃতি। আমরা আজন্মকাল ধরে তাই তাঁর কাছে নতজানু হই। কারন তিনি এক সমাজ হিতৈষী। তাঁর মহৎ জ্ঞান ও কর্ম সে কেবল সমাজের মঙ্গলে নিহিত। সমাজে বিদ্বজন আছে বলেই আমরা সৎ সংগ্রামে ব্রতী হই, তাঁকে আকড়ে ধরে বাঁচি,স্বপ্ন দেখি । আর সংবেদশীল জীবনের ভেতর দিয়ে জীবনের দায়বোধ শিখি। লালন করি সৃজনশীলতার মাঙ্গলিক সৌন্দর্য। আর অবক্ষয় দেখে ক্ষুব্দ ও ব্যথিত হই।

প্রিয় তিনি বিদ্বজন সাংবাদিক মোস্তফা গোলাম ফারুক বাচ্চু। তাঁর প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫০ বছর বয়সে মঠবাড়িযা পৌরশহরের থানাপড়ায় নিজ বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন। সেই সঙ্গে এই মানুষের অকাল মৃত্যুতে মঠবাড়িয়া উপকুলে এক আলোকিত মানুষের মহা প্রস্থান ঘটে। সেই সাথে মঠবাড়িয় উপকুলে সৎ আর নির্ভিক সাংবাদিকতার ইতিহাস থমকে যায়। তিনি মৃত্যু অবধি এ উপকুলে একজন পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন। এছাড়া তিনি মঠবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মঠবাড়িয়া উপজেলা শাখার সভাপতি,মঠবাড়িয়া কে.এম লতিফ ইনস্টিটিউশনের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক মঠবাড়িয়া সমাচারের উপদেস্টা সম্পাদক ছিলেন।

তাঁকে নিয়ে লিখতে হয় কারন একজন সাদা মনের মানুষের কল্যাণমুখী কর্মকা- ভাল সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন একজন সামাজিক উদ্যোক্তা। একজন শিক্ষানুরাগী। সৎ ও সাহসী রাজনীতিক। বঞ্চিত মানুষের নেতা। সংগ্রামী মিছিলের মুখ। আজন্মকাল ধরে দুঃখবাদী, নিঃস্বার্থবাদী,নিরাহংকারী। সরল আর সদালাপী ব্যক্তিত্ব। এত কিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলে প্রধানত একজন মফস্বল সাংবাদিক। নানা সংকটের ভিতরেও তিনি ছিলেন নির্ভীক আর সৎ সাংবাদিকতায় এ উপকুলের পথিকৃত। নির্ধিধায় বলা চলে তিনি এক সৃজনশীল মানুষের প্রতিকৃতি। একজন মোস্তফা গোলাম ফারুক বাচ্চু তাঁর কাছে ঋণি আমাদের মঠবাড়িয়ার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা। কেননা তাঁর হাত ধরে মঠবাড়িযা উপকুলে সৎ ও কল্যাণমুখী সাংবাদিকতা সমৃদ্ধ হয়েছে।

আজ আমরা যাঁরা কাগজের মানুষ। লেখালেখিতে যাদের পেটে ভাত হয়। যারা সাংবাদিকতা নিয়ে দম্ভ করি। যারা সুবিধার স্বার্থে প্রতিনিয়ত নীতি ও নৈতিকতা বিলীন করি। আমরা যারা নিজের ঘুম,নিজের খাওয়া আর নিজের বিছানায় নিমগ্ন তারা কেউ পারিনি তাঁর কর্মের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে। তবে স্বীকার করি সংকটে তাঁর মুখ মনে পড়ে। এখনও ভাবি শত সংকটে নিঃস্বার্থ সাংবাদিক কি করে হয়? তাঁর সময়কালে আজকের মত সাংবাদিকতার এত উৎকর্ষময় প্রযুক্তি ছিল না। প্রযুক্তির কারসাজির এ যুগের সংবাদ একজনে লিখে আর দশ জনে দশ পত্রিকায় ছাপানোর কৃতিত্ব রয়েছে। সহজ বলে আজ সাংবাদিক সমাজের পাল্লাও ভারী হয়েছে। কিন্তু বাচ্চু ভাইয়ের আমলে ওই প্রযুক্তির কারসাজি ছিলনা। ভুরিভুরি সাংবাদিকও ছিলনা। কিন্তু কল্যাণ সাংবাদিকতা ঠিকই ছিল। আজ যারা সাংবাদিক বলে সমাজে সম্মান নেই তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন এ কাজে এখন আর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম নেই। এখন পাকা সড়ক ধরে মটরসাইকেলে চড়ে সংবাদ সংগ্রহ করার মত সুযোগ আমাদের হলেও বাচ্চু ভাইকে বেহাল সড়কের এই উপকুলে একটা লক্কর ঝক্কর অতি পুরানো বাইসাইকেল চড়ে এ কাজ করতে হয়েছে। তিনি শারীরিক অক্ষমতার কারনে পায়ে হেঁটে চলতেও পারতেন না। সেই মানুষের নিত্য ছুটে চলা ছিল বাইসাইকেলে। মৃত্যু অবধি তাঁর অমন জীবনই আমারা দেখেছি। চরম অর্থনৈতিক সংকটেও লোভাতুর জীবন ছিলনা এই মানুষের। আজ বুঝতে পারি সাংবাদিকতা তিনি সমাজ ও মানুষের কল্যাণেই করেছেন।

তিনি বলতেন, কোন সমাজের সাংবাদিকতার নৈতিক স্খলন ঘটলে সমাজ উচ্ছন্নে যায়। সমাজ সভ্যতা পদদলিত হয়। সংবেদনশীল মানুষ না হলে তাঁর সাংবাদিক হওয়া বৃথা। তখন অতটা বোঝার বয়স না হলেও এটা বুঝি ভাল হতে হলে অনেক ত্যাগ করতে হয়। তিনি বলতেন যে পারে সে সংকটের মধ্য দিয়ে পারে। তাকে পারতে হয়। মফস্বলে প্রলোভনে সৎ থেকে সাংবাদিকতা কি করে হয় জানতে হলে বাচ্চু ভাইকে আজও ভাবতে হয়। তিনি সব সময় বলতেন মন ভালো আর মাথা ভালো মানুষের কেবল এ কাজে আসা উচিত। সাংবাদিকতায় তাঁর মত মানুষ এখানে একদা অভিভাবক ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর প্রয়াণের পর কেউ আর এখানে সাংবাদিকতায় অভিভাবকের মত উঠে দাড়ায়নি। তিনি আমাদের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধই করে গেছেন। স্বীকার করতে হয় তাঁর মৃত্যুর পর মঠবাড়িয়া উপকুলের সমৃদ্ধ সাংবাদিততার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে। আর ভবিষ্যতে কি হবে তাও আমাদের জানা নেই।

মঠবাড়িয়া সমাচার নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার তিনি ছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক। সংস্কৃতিজন মিজানুর রহমান তসলিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ওই পত্রিকাটির সহযোগি সম্পাদক সাংবাদিক জাহিদ উদ্দিন পলাশ আর আমি ছিলাম সহকারী সম্পাদক। । ওই পত্রিকার নিউজের ব্যাপারে তিনি আমাদের পরামর্শ ছাড়া কোনদিন হস্তক্ষেপ করেননি। তবে একদিন বাচ্চু ভাই আমাদের ডেকে পাঠান। আমরা তাঁর বাসায় দেখা করি। তিনি জানান বামনার রামনায় দরিদ্র এক স্কুল ছাত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছে। মেয়েটির বাবা বাঁধা দিতে গেলে বখাটেরা তাকে কুপিয়ে জখম করে। ওই ঘটনায় বরগুনা আদালতে নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবারের পক্ষ হতে ৫/৬ জনের নামে মামলা দেওয়া হয়। মামলায় অভিযুক্তরা বাচ্চু ভাইয়ের আত্মীয়। তারা বাঁচতে বাচ্চু ভাইয়ের কাছে আসেন। বাচ্চু ভাই ওই ঘটনার নিউজ করতে আমাকে ও পলাশ ভাইকে ঘটনাস্থলে পাঠান। আমরা একদিন ভরা বর্ষায় সরেজমিনে ঘটনাস্থলে যাই। নির্যাতিত পরিবার ও গ্রামের নিরপেক্ষ মানুষের সাথে কথা বলি আর অভিযুক্তদের সঙ্গেও। আমাদের সেদিন দিনভর তদন্তে উঠে আসে বাচ্চু ভাইয়ের কয়েক আত্মীয় ঘটনার সাথে জড়িত। আমরা ওই ঘটনার নিউজ করতে বিব্রত বোধ করি। ঘটনাটা বাচ্চু ভাইকে বলি। তিনি সেদিন বলে ছিলেন,সাংবাদিকতায় কেউ আত্মীয় নয়,সাংবাদিকতায় কেউ বন্ধুও নয়। তোমরা সৎভাবে রিপোর্ট করো। আমরা ওই নির্যাতন ঘটনার ঠিক সরেজমিন প্রতিবেদন করেছিলাম। বাচ্চু ভাইয়ের আত্মীয় বলে তিনি রেহাই দেননি। আমাদের প্রভাবিতও করেননি।

আজ তাঁর মুত্যৃ দিবসকে ঘিরে বলতে হয়। কারন এগুলো অভিজ্ঞতার স্মৃতি। না বলা হলে একদিন বাচ্চু ভাইয়ের মরচে ধরা পুরোনো বাই সাইকেলের মত হারিয়ে যাবে। তখন আমি দৈনিক ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি। মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনের চাকরী। এত সহজে তখন জেলা শহরে যাওয়া-আসা যেতনা। এক সন্ধ্যা বেলা বাচ্চু ভাইয়ের বাসায় গিয়ে বিষয়টা বলি। তিনি বললেন তুমি থানার সাংবাদিকতা ছেড়ে জেলায় যাও। যদিও একাজে ক্ষুধা নিবারণ হবেনা তবু এ তুমি কখনও ছেঁড়োনা। তাঁর কথা মেনে আমি রাজি হই। তখন এখানের কোন সাংবাদিকই তাঁর কথা ফেলতেন না। সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনের সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু করে আজ আমি বেঁচে তো আছি সে কেবল তাঁর কথা মেনে। তাঁকে অনুসরন করেই আমি ও আমরা আজও অদম্য লড়ছি। এ কাজে আমার মত অনেকের পেটে আজ ভাত হয়। আমাদের অনেকের এ কাজ করে অর্থনৈতিক মুক্তিও মিলেছে। কত লোক আমাদের চেনে। সমাজে সম্মানে বসতে পাই খেতে পাই। সভা সমাবেশে মেহমান হয়ে কথা বলি । প্রিয় বাচ্চু ভাই আমাদের ক্ষমা করবেন। আমরা আপনার যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা আপনার কর্ম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বাঁচাতে পারিনি। আপনার লড়াই আমরা আজ ভুলতে বসেছি। তাই আজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই আর সহকর্মীর বিরুদ্ধে সহকর্মী । বৈরী সময়ের মধ্যে কোথায় য়ে চলেছি এসেছি আমরা তা টেরও পাচ্ছিনা।

১৯৯৮ সালের কোন এক রাত। ঠিক তারিখ মনে করতে পারছিনা। পিরোজপুরে এক অনুষ্ঠানে বাচ্চু ভাইয়ের সহচর হিসেবে যেতে হয়। রাতে শহরের একটি হোটেলে এক কক্ষে আমরা দুজন থাকি। সেইদিন গভীর রাতে গুণি এক বয়সী মানুষকে আমি কাঁদতে দেখেছি। জীবনে চরম হতাশা ছিল বুঝি তাঁর। আমরা টেরই পাইনি। খুড়িয়ে হাঁটার জীবন। পুরানো মরচে ধরা ব্রেকহীন একটি বাই সাইকেল নির্ভর জীবন ছিল যাঁর। যিনি জীবনে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মমূখর ছিলেন। দুর্যোগে হতাশায় বিপন্ন জীবনের পাশে যিনি দাড়িয়েছেন। উপকুলের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ,বঞ্চণা শোষনের কাহিনী যিনি লিখেছেন। অধিকার আদায়ে মানুষের বিক্ষোভে বিপ্লবে যিনি ছিলেন অগ্রগামী মুখ। সেই মানুষ জন্মাবধি চরম অর্থনৈতিক সংকটে ছিলেন। তবু বিপর্য¯ত সেই জীবনেও আমরা তাঁর অমলিন হাসি দেখেছি। সমাজের দায়িত্বশীল মানুষ বুঝিবা এমনই হয়। সেই মানুষ শিশুর মত কেঁদে ছিলেন সেই রাতে। একা মানুষ আমি তাঁর পাশে সেদিন অসহায় বোধ করি। এছাড়া ওই সময়ে আমার কিছুই করার ছিলনা। আমি তাঁর সেই রাতের কান্না থামাতে ব্যর্থ ছিলাম। অনেক কষ্টে তিনি এই শহরে কয়েকহাত জমির একটু বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন। তাঁর দখল পেতে যে হযরাণি আর প্রশাসনিক জটিলতা চলছিল তাতে তিনি খুব অসহায় বোধ করেছিলেন,বিব্রত বোধ করেছিলেন। তাঁরমত এক গুণি মানুষের এই শহরে বিপন্ন জীবন যাপন কারো অজানা থাকার কথা নয়। কি অদ্ভূত আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ তার রাজনীতি ! এখানে দাম্ভিক ও লোভাতুর মানুষের সহজে স্বীকৃতি মেলে,পূণর্বাসন মেলে কিন্তু সরল,গুণি আর সমাজ হিতৈষী মানুষের কখনও স্বীকৃতি মেলেনা।

লেখক > সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...