ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - কুরবানীর তাৎপর্য

কুরবানীর তাৎপর্য

নূর হোসাইন মোল্লা >

ঈদুল আযহা শব্দদ্বয় আরবী। হযরত ইব্রাহিম (আঃ), তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা বিবি এবং তাঁদের প্রিয়তম পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরম ত্যাগের স্মৃতিস্বরূপ প্রতি বছর জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সারা বিশ্বের মুসলমানরা মাহাসমারোহে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন তা-ই-কুরবানী। মুসলমানদের প্রধান জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা সাধারণত কুরবানীর ঈদ নামেই পরিচিত। ঈদুল আযাহা শুধু উৎসব নয়, পরম আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত ইবাদতও বটে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি বিধানে হযরত ইব্রাহিম (আঃ), তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা বিবি এবং তাঁদের প্রিয়তম পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগের এত বড় নজির মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। আল্লার নামে তাঁদের পরম ত্যাগের স্মৃতি পালনার্থে সারা বিশ্বের মুসলমানেরা প্রতি বছর কুরবানী করে থাকেন। কুরবানীর তাৎপর্য হলো ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। কুরবানী প্রত্যেক সামর্থবান ও বালেগ মুসলিম নর-নারীর উপর ওয়াজিব। এখন প্রশ্ন হলো সামর্থবান কে? যিনি ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ অথবা ৬১২.১৫ গ্রাম রৌপ্য অথবা উহার বাজার মূল্য টাকার মালিক তিনিই সামর্থবান ব্যক্তি। বলা আবশ্যক যে, সম্পদ বা অর্থ সারা বছর সঞ্চিত থাকলে ২.৫০% টাকা হিসেবে জাকাত ফরজ হয়। কিন্তু কোরবানীর জন্যে ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ বা ৬১২.১৫ গ্রাম বা বাজার মূল্য টাকা জিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে হস্তগত হলেই নিজের পক্ষে আল্লাহর নামে কুরবানী করতেই হবে। এটি আল্লাহ রব্বুল আলামিন সম্ভবত এ জন্যে ব্যতিক্রম করেছেন যাতে কোন সামর্থবান মুসলিম কুরবানীর অতুলনীয় সওয়াব লাভ থেকে বঞ্চিত না হয়। কুরবানীর গোশত এবং পশুর চামড়ার মূল্য অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিরা পায়। অনেক অভাবী ব্যক্তি আছে যারা সারা বছর গোশত খেতে পায় না। পেলেও তৃপ্তি সহকারে পায় না। তাই কুরবানীর দ্বারা মানুষ আল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ আর পার্থিব দিক থেকে গরীব-দুঃখীর পাশে দাড়াতে পারে। কুরবানীর গোশতের মধ্যে বরকত আছে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেন, সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যদি কেহ কুরবানী না করলে সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে। কুরবানী যাতে খাঁটি নিয়তে একমাত্র আল্লাহর প্রতি তাকওয়া ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দ্যেশেই হতে হবে। সেজন্য পবিত্র কুরআনে সূরা হাজ্ব এর ৩৭ নং আয়াতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এ ভাবে: ‘‘আল্লাহর নিকট কুরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত পৌছায় না, পৌছায় তোমাদের তাকওয়া’’। সুতরাং স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, তাকওয়া ব্যতিত হাজার হাজার বা লক্ষ টাকা মূল্যের কুরবানীর পশু জবাই করা অন্তঃসার শূণ্য। এর দ্বারা শুধু গোশত খাওয়া হবে, কিন্তু আল্লাহ নৈকট্য ও সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদা এর ২৭ নং আয়াতে বলেন, ‘‘যে কুরবানীর মধ্যে তাকওয়ার স্থলে রিয়া বা লোক দেখানো ভাব থাকে, সেই কুরবানী তিনি কবুল করেন না। তিনি কবুল করেন মুত্তাকিদের কুরবানী। যে কুরবানীর সাথে তাকওয়া এবং আবেগ ও অনুভূতি নেই সে কুরবানীর কোন মূল্য নেই।
ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করবে। তার জন্য কুরবানী না করাই উত্তম। এরপরও যদি সে কুরবানী করে তা হলে সে সওয়াব পাবেন। মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েজ। এতে সে অধিক সওয়াব পাবেন। এমন ভাবে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর পক্ষ থেকে কুরবানী করাও বিশেষ সওয়াবের কাজ। নিখুঁত মোটাতাজা উট, গরু, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া ও মহিষ ছাড়া অন্য পশু কুরবানী করা জায়েজ নহে। কারণ এটি পুলসিরাতের বাহন হবে। কুরবানীর পূর্বে উটকে ৪০ দিন, গরু মহিষকে ২০ দিন এবং ছাগল ও ভেড়াকে ১০ দিন বেঁধে আহার দিতে হবে, যাতে নাপাকী জিনিস ভক্ষণ করতে না পারে। বর্তমানে অসাধু পশু ব্যবসায়ীরা পশুকে মোটা তাজাকরণের জন্য কুরবানীর কয়েক দিন পূর্বে পশুর শরীরে নানা ধরণের ওষুধ প্রয়োগ করেন। এটা না জায়েজ। কুরবানীর গোশত তিন ভাগের এক ভাগ পরিবার পরিজনের জন্য রাখতে হবে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজন এবং আর এক ভাগ গরীব মিসকিনদের বন্টন করতে হবে।
কুরবানীর বিধান যুগে যুগে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অবতীর্ন সব শরীয়তেই বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা হাজ্বের ৩৪ নং আয়াতে বলেন, ‘‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে তাদের জীবনের উপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ প্রাণি দিয়েছি সে গুলো তোমারা আমার নামে জবাই কর’’। মানব ইতিহাসে সর্ব প্রথম কুরবানী হযরত আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। জাহেলিয়া যুগে আরববাসীরা দেব-দেবীর নামে পশু কুরবানী করত। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কুরবানী দ্বারা জাহেলিয়া যুগের কু-প্রথাটি মুলোৎপাটিত হয়। হিজরতের পর মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) দেখতে পান যে, মদিনাবাসীরা বিশেষ দুই দিন খেলা ধুলা ও আমোদ প্রমোদে ব্যাপৃত থাকে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এদিন দু’টি কিসের দিন। তারা জানায় জাহেলিয়াতকালে খেলা ধুলা ও আমোদ প্রমোদ করে এ দিন ২টি উদযাপন করত। তাই আমরাও উদযাপন করি। তখন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দিন ২টির পরিবর্তে উত্তম দুই দিন ধার্য করেছেন একটি ঈদুল ফিতর অপরটি ঈদুল আযহা বা কুরবানী। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুরবানীর অপূর্ব ইতিহাস তুলে ধরে বলেন; খাবে দেখেছিলেন ইব্রাহিম; দাও কুরবানী মহামহিম। তোরা যে দেখিস দিবা লোকে, কি যে দুর্গতি ইসলামের। পরীক্ষা নেন খোদা তোদের, হাবিবের সাথে বাজি রেখে।
মূলত প্রচলিত কুরবানী হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং হযরত ইমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। এ অবিস্মরণীয় ঘটনাকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্যই হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর উম্মতের উপরে তা ওয়াজিব করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা কাউসার এর ২ নং আয়াতে বলেন, ‘‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দ্যেশে নামাজ আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মত চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আসুন, আমরা কোরবানীর দিনে শপথ করি, লোভ-লালসা, অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি, কু-প্রবৃত্তি, সন্ত্রাস, খুন-গুম, ছিনতাই, রাহাজানী, চাঁদাবাজী, নারীর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকি। দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের বিধান মেনে চলি, সুখি ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠন করি।
লেখকঃ অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। মোবাইল নং-০১৭৩০-৯৩৫৮৮৭।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...