ব্রেকিং নিউজ
Home - জাতীয় - বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি – ৩

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি – ৩

নূর হোসাইন মোল্লা >

(৩য় পর্ব)
জাসদের অগ্রযাত্রা ঠেক দেয়ার জন্য শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ গঠন করেন। ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহে জাতীয় শ্রমিক লীগ ভেঙ্গে যায়। দলের প্রধান ৩ নেতার মধ্যে মো. শাহজাহান খান ও রুহুল আমিন ভুইয়া জাসদের প্রতি সমর্থন জানান। অপর নেতা আব্দুল মান্নান আওয়ামীলীগে থেকে যান। খন্দকার আব্দুল মালেক ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কৃষক লীগের প্রায় পুরো কমিটিই ছিল জাসদপন্থি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় কৃষক লীগ এবং জাতীয় ছাত্রলীগ সব ক’টি সংগঠনই দাবি করলো তারা আসন্ন বিপ্লবের সহায়ক।

১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে মেজর এম,এ, জলিল এবং আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে ৫১ সদস্যের জাসদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। আহবায়ক কমিটির রিপোর্ট পেশ করার সময়ে আব্দুর রব জনগণকে সকল শক্তি দিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন গণ বিরোধী সরকারকে উৎখাত করার আহ্বান জানান। সরকারের কথিত অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে প্রকাশ্যে সরকার উৎখাতের এ আহবান গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থি। তিনি দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য আহবান জনান।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে কয়েকটি বিরোধী দল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের আগে একটি অন্তরবর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করে। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে রমনায় এক ছাত্র সমাবেশে বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নির্বাচনে অংশগ্রহন করে জাসদ ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ২৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়। এ নির্বাচনে ১১টি রাজনৈতিক দলের ৯৮১ জন প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র ১১৮ জন প্রার্থী সহ ১০৭৯ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন লাভ করে। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে জাসদ ৩টা, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং স্বতন্ত্র ৩টা আসন লাভ করে। এ নির্বাচনের ফলে একদলীয় সংসদ গঠিত হয়। এটা নিশ্চিত অশুভ লক্ষণ। এ নির্বাচনের ফলে নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্পর্কে জনগণের মনে প্রবল সন্দেহের উদ্রেক হয়। দেশী পত্র পত্রিকা ছাড়াও যেসব বিদেশী পত্র পত্রিকা বাংলাদেশের প্রাতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল তারাও আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে থাকে। এ রুপ একদলীয় সংসদ অকার্যকর হতে বেশি দিন সময় নেয়নি। নতুন রাষ্ট্রের শুরুতেই গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া হোঁচট খায়। এ নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদ “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইয়ে লিখেছেন, “আমি আওয়ামীলীগ নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, বিরোধী পক্ষের অন্তত ৫০ জন নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করতে দেওয়া উচিৎ। তাতে গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী বিরোধী দল গড়ে ওঠবে। কিন্তু আমার পরামর্শে কেউ কান দিলেন না। তিনি আরো বলেন, ৩০০ আসনের মধ্যে বিরোধী দলের ২৫ জন সদস্য থাকলে সরকারের কোন অসুবিধা হত না। বরং সংসদের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পেত। তাদের বক্তৃতা বাগ্মিতায় সংসদ প্রাণবন্ত, দর্শনীয় ও উপভোগ্য হত। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মেজর এম.এ. জলিল, আ.স.ম.আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, বিধান চন্দ্র সেন, মির্জা সুলতান রাজা, মাঈনউদ্দিন খান বাদল, নুরে আলম জিকু, অধ্যাপক মোজফ্ফর আহমেদ, মুজিবুর রহমান(রাজশাহী), আমিনুল ইসলাম চৌধুরি, সলিমুল হক খান,মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, জিল্লুর রহিম, অলি আহাদ, ড. আলিম আল রাজী, বজলুস সাত্তার, নুরুর রহমান, হাজী মোহাম্মদ দানেশ প্রমুখ অভিজ্ঞ সুবক্তা ও পার্লামেন্টারিয়ানকে জয়ী হতে দেওয়া আওয়ামীলীগের ভালোর জন্যই উচিত ছিল। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য, আওয়ামীলীগ উদারতার পথে না গিয়ে উল্টো পথ ধরে।” ৯ মার্চ জাসদের সভাপতি মেজর এম.এ. জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক আ. রব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যাপক সন্ত্রাস এবং কারচুপির আশ্রয় নিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থীদেরকে পরাজিত করতে বাধ্য করেছে। ওই দিন ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, কমপক্ষে ৭০টি আসনে বিরোধী দলের প্রর্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাস, ভয়ভীতি, জাল ভোট, পুলিং বুথ দখল, পুলিং এজেন্ট অপহরণ ইত্যাদি চরম অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নির্বাচন চরম প্রহসনে পরিণত করেছে। এ নির্বাচনে ব্যাপক র্কাচুপির অভিযোগে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামীলীগকে কঠোর সমালোচনা করলেও ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি।

১৯৭৩ সালে ১১-১৩ মে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জাসদের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সম্মেলনে মেজর এম.এ. জলিল এবং আ.স.ম. আব্দুর রব এর নেতৃত্বে ৫৪ সদস্যের একটা জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিতদের মধ্যে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বিধান কৃষ্ণ সেন, মির্জা সুলতান রাজা ও মোশাররফ হোসেন- সহ-সভাপতি, নুরে আলম জিকু- সাংগঠনিক সম্পাদক, সুলতান উদ্দিন আহমেদ- প্রচার সম্পাদক, মাজহারুল হক টুলু- দপ্তর সম্পদক, হাবিবুল্লাহ চৌধুরী- কৃষি সম্পাদক, জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু- শ্রম সম্পাদক, শাহ আলম- তথ্য ও গণসংযোগ সম্পাদক, মমতাজ বেগম- মহিলা সম্পাদক এবং কামরুজ্জামান- অর্থ সম্পাদক। উল্লেখ্য, লেঃ কর্ণেল আবু তাহেরের জন্য জাতীয় কমিটিতে সহ- সভাপতির একটা পদ শূণ্য রাখা হয়। কর্নেল তাহের সেনা বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর এ পদে যোগদান করবেন এই প্রত্যাশায়।

১৯৭৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এ ৪টি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থি ন্যাপ এবং বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। জাসদ ও ভাসানী ন্যাপ এ জোটের বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়। জাসদের বিবৃতিতে বলা হয়, ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ষড়যন্ত্রমূলক, গণবিরোধী ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ভয়াবহ হুমকি স্বরুপ। জাসদের জাতীয় কমিটির সভায় তাঁরা মুজিব- মনি- মোজাফ্ফর চক্রের ত্রিভুজী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জনগণের ঐক্যের আহবান জানায়।

১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাসদ ২৯ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আগামি ১৫ মার্চের মধ্যে এটা মেনে নেয়ার জন্যে সরকারকে সময় বেধে দেয়। জাসদ ঘোষণা করে সরকার যদি ২৯ দফা দাবি মেনে না নেয় তা হলে তারা ঘেরাও আন্দোলন শুরু করবে। ২৯ দফার মধ্যে ছিলঃ ১। রক্ষী বাহিনীকে ভেঙ্গে দিয়ে তার সদস্যদেরকে সেনা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা। ২। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সম্পুর্ন পৃথক রাখতে হবে এবং বিচার বিভাগের ওপর থেকে ক্ষমতাসীনদের সকল প্রকার দলীয় প্রভাবের অবসান করা। ৩। রাষ্ট্রপতির ৮,৯,৫০ নং অর্ডারসহ সকল কালাকানুন অবিলম্বে বাতিল করা। ৪। সকল প্রগতিশীল রাজবন্দীর অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি প্রদান এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা ও মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা। ৫। যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করেছিল তাদের অস্ত্র শস্ত্রের হিসাব দিতে হবে। ৬। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী, এম.পি. সহ অন্যান্য নেতা ও উপনেতাদের সম্পদের যথায়থ বিবরণ দিতে হবে। ৭। অবাঙ্গালিদের ফেলে যাওয়া পরিত্যাক্ত সম্পদের হিসাব দিতে হবে। ৮। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে এ যাবৎ কি পরিমান বিদেশী সাহায্য পাওয়া গিয়েছে এবং কিভাবে বন্টন করা হয়েছে তার হিসাব দিতে হবে, ইত্যাদি।

১৯৭৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাসদ এক বিবৃতিতে ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে । বিবৃতির শিরোনাম ছিল শাসক গোষ্ঠির প্রতি জাসদের চরমপত্র ও জনতার দাকব মেনে নাও । ১৭ মার্চ পল্টন ময়দানে জাসদের উদ্যেগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মেজর এম.এ. জলিল এবং আ.স.ম. আব্দুর রব সভায় অত্যন্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে। সভা শেষে ২৯ দফা মেনে নেওয়ার জন্যে প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্মারকলিপি না দিয়ে হঠকারিতাবশত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য মেজর এম.এ. জলিল এবং আ. রবের নেতৃত্বে এক বিশাল মিছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সরকারি বাস ভবনের সামনে হাজির হয়ে মুহুর্মুহু উস্কানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। উত্তেজিত জনতা ভবনের গেটে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী এসে গোলাগুলি শুরু করলে জনতা এলোপাতারি ছুটাছুটি করতে থাকে। গুলিতে ৩০-৪০জন নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মেজর এম.এ. জলিল, আব্দুর রব, মির্জা সুলতান রাজা, মঈনউদ্দিন খান বাদল, বিধান কৃষ্ণ সেন, মমতাজ বেগম প্রমুখ ছিলেন এবং তারা গ্রেফতার হন। এটা ছিল জাসদের বালকোচিত কাজ। জাসদের এ বালকোচিত কাজে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে রাজনীতি ছেড়ে দৈনিক বাংলার ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মাসুদ আহম্মেদ রুমি (কুষ্টিয়া) । তাঁর মতে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যদি গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ না হয়, তাহলে ওই দল করার কোন মানে হয়না।…….(চলমান)

# লেখকঃ অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
মোবাঃ ০১৭৩০-৯৩৫৮৮৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...