ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - ৩ নভেম্বর বঙ্গালীর ইতিহাসে আরেকটি কলংক ও বেদনাময় দিন

৩ নভেম্বর বঙ্গালীর ইতিহাসে আরেকটি কলংক ও বেদনাময় দিন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালীর ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকময় ও বেদনাময় দিন। ওই বছরের ৩ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের আরেকটি কলংকময় ও বেদনাদায়ক দিন। এ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারিয়েন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চারজন প্রিয়ভাজন ব্যক্তি,যাঁরা তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্য এনেদিয়েছেন।স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত ছিলেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদের ভয় ছিল,সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান বেচে থাকলে তার সাধ পূরন হবে না। মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সতর্ক থাকায় তার চেষ্টা সফল হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খন্দকার মোস্তাক আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন । বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীদেরকে মেনে নিতে পারেন নি। তার শখ ছিল স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও প্রেসিডেন্ট হওয়া। সেকারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর মর্মান্তিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল ।সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা মনে করে যে,সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং কামরুজ জামান বেচে থাকলো তারা পার পাবে না। তাই তারা রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সুরক্ষিত নিরাপদ কক্ষে এ চারজন জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। মূলতঃ ৩ নভেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের অসমাপ্ত অংশের সমাপনী অংশ। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হয়ে তাদেরকে তার মন্ত্রী সভায় যোগদান করতে আহবান জানান। কিন্তু তারা মোস্তাকের আহবানে সারা না দেয়ায় তাদের স্হান হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। খুনী কর্ণেল ফারুক – রসিদ গং ট্যাংকসহ আশ্রয় গ্রহণ করে খন্দকার মোস্তাক আহমেদের সাথে বঙ্গ ভবনে এবং প্রায়শই সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ জারী করতে থাকে। এতে সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন।বিদ্রোহীরা অক্টোবর মাসের শেষ দিকে উপলব্ধি করতে পারে যে,সেনানিবাস থেকে পাল্টা অভ্যূত্থান অত্যাসন্ন। এ সময়ে কর্নেল ফারুক ও রসিদ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের অনুগত সৈনিক দিয়ে একটি ব্রিগেড গঠন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল ও অন্যান্য বিরোধী অফিসারগণকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তুবায়ন করা অসম্ভব বলে তা বাতিল করে।
খন্দকার মোস্তাকের শাসনামলের দুই মাসের মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক আবস্হার বিপর্যয় ঘটে। বঙ্গভবন এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেই সাথে বঙ্গভবনে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর নাটকীয় ঘটনা ঘটে। জেনারেল এম,এ,জি, ওসমানী অনেকটা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ এড়াতে তিনি মধ্যস্হতা করেন। এরুপ অবস্থায় ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অফ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ জানান। সেনাপ্রধান গড়িমসি করতে থাকেন। খুনী ফারুক – রশিদ গং নিজেদেরকে নিরাপদ মনে না করে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কিলার গ্রুপ সৃষ্টি করে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ৭৯ দিন পর ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল ২ নভেম্বর রাতে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ করার জন্যে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ উল্লাহকে নির্দেশ দিলে তিনি এক প্লাটুন সৈনিক নিয়ে দ্রুতগতিতে সেনাপ্রধান এর বাসভবনে প্রবেশ করে তার বুক বরাবর স্টেন গান তাক করে বলেন, স্যার আপনি এখন বন্দী। দয়া করে আপনি পদত্যাগ করুন। সেনাপ্রধান পদত্যাগ করেন। তার বাস ভবনের টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে তাকে খুনী মোস্তাক,ফারুক, রশীদ গং চক্রের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়।
মধ্য রাতের পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার জন্যে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইটে আসে এবং চারজন ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে কারারক্ষী কারাগারের গেইট খোলতে অস্বীকার করেন।কারাগার গেইটে সৈন্যদের হুমকি – ধুমকি ও উচ্চস্বরে বাক্যালাপ শুনে সেখানে উপস্থিত হন ডি,আই,জি, প্রিজন কাজী আবদুল আাউয়াল। তিনি সেনা সদস্যদেরকে কারাগারে প্রবেশ করতে অনুমতি না দেয়ায় রিসালদার মোসলেম উদ্দিন লেঃ কর্ণেল খন্দকার রশীদকে ফোন করে একটু পারে মোসলেম উদ্দিন ডি,আই,জি, প্রিজন কাজী আবদুল আউয়ালকে রিসিভার হস্তান্তর করে। কর্নেল রশীদ তাকে মোসলেম উদ্দিনের কথা অনুযায়ী কাজ করতে বলে। এ সময়ে ডি,আই,জি, প্রিজন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাকের সাথে কথা বলতে চাইলে কর্নেল রশীদ রিসিভার মোস্তাককে হস্তান্তর করে। মোস্তাক তাকে বলেন, ওরা যা বলে তা শুনুন এবং ওদেরকে কাজ করতে দিন। রাত চারটায় কারাগারের গেইট খুলে দেয়া হয় এবং পাগলা ঘন্টা বাজানো হয়। চারজন ঘাতক রিসালদার মোসলেম উদ্দিন,দফাদার মারফত আলী ও এলইডি আবুল হাসেম মৃধা জে ল গেইটের খাতায় স্বাক্ষর করে জেল ভবনের যেখানে পাঁচ জাতীয় নেতা বন্দী ছিলেন সেখানে আসে।
এক নং কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ,দুই নং কক্ষে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ,এইচ,এম, কামরুজ্জামান এবং , অন্য একটি কক্ষে আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন। প্রথম চারজনকে এক নং কক্ষে একএিত করা হয়। ফজরের আজান হচ্ছিল। এমন সময়ে জেলার আমিনুর রহমানের সামনে হত্যাকারীরা স্টেন গান ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে তাদের বুকে গুলি করে ঝাজরা করে জেল ভবনে রক্তের বন্যা বহিয়ে দেয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাথে সাথে মৃত্যু করলেও তাজউদ্দিন সাহেব পেট ও পায়ে গুলি খেয়ে রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে তারা ওই কক্ষ তালাবদ্ধ করে রাখে। উল্লেখ্য, জেলে থাকাকালীন তাজউদ্দীন আহমদ ইঙ্গিত পেয়েছিলেন, একটা কিছু ঘটবে। তিনি তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমার মনে হয় না যে,আমরা জীবিত আবস্হায় জেল থেকে বের হতে পারব। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীরা ৩ নভেম্বর রাতে দেশ ত্যাগ করার পর এ হত্যাকান্ডের খবর ৪ নভেম্বর ১০ ঘটিকায় প্রকাশিত হয়।
জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে রটানো হলো তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারে বসে গোপনে ভারতীয় হাই কমিশনারের নিকটে চিঠি পাঠিয়েছেন, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য আনার জন্যে।কারাগারে জাতীয় চার নেতার লাশ তালাবদ্ধ রলো। কেউ কিছু জানতে পারেন নি। ৩ নভেম্বর খন্দকার মোস্তাক আহমেদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড প্রকাশ হলে হত্যাকারীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে ভেবে তারা সরকারের সহায়তায় সপরিবারে ৩ নভেম্বর রাতে একটি বিশেষ বিমান যোগে ব্যাংককের উদ্দেশ্য ঢাকা ত্যাগ করে। ৪ নভেম্বর সকাল ১০ ঘটিকায় চার নেতার নৃশংস হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। এ জঘন্য নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটে। জনগণ ও সেনাবাহিনী এ হত্যাকান্ডের জন্যে খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন। খন্দকার মোস্তাক ৫ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।তবে পদত্যাগের পূর্বে তাদের লাশ তাদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন। জানাজার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলীর লাশ বনানী কবর স্হানে সমাহিত করা হয় এবং কামরুজ্জামানের লাশ রাজশাহীতে তার পারিবারিক কবর স্হানে সমাহিত করা হয়।
৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাস্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের তিন জন বিচারকের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাড়ে পাঁচ বছর শাসনকালে তদন্ত কমিশনকে তাদের কাজ পরিচালনা করতে অনুমতি দেননি। এ ঘটনাটি জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্মৃতিকে কলংকিত করেছে। কারাগারে বন্দী রেখে সরকারের ইংগিতে নির্মমভাবে হত্যা করা নিসন্দেহে একটি জঘন্যতম লোমহর্ষক অপরাধ।
বিঃ দ্রঃবিস্তারিত জানার জন্যে মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরী, কর্নেল শাফায়াত জামিল , ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন, লেঃ কর্ণেল , এস, এম, মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর রফিকুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ এবং সিমিন হোসেন রিমির লেখা বই পড়তে পারেন।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...