ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - মুসলমানরা কি অন্য ধর্মাবলম্বীদের রক্ত দান বা গ্রহণ করতে পারেন ?

মুসলমানরা কি অন্য ধর্মাবলম্বীদের রক্ত দান বা গ্রহণ করতে পারেন ?

মানবদেহের যে কয়টি উপাদান ছাড়া মানুষ কোনভাবেই নিজেকে কল্পনা করতে পারেনা, তারমধ্যে রক্ত অন্যতম একটি প্রধান উপাদান। আমাদের প্রতিটি শিরা, উপশিরা, ধমনীতে রক্ত প্রবাহমান। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন অসুখ বিসুখের কারণে আমাদের শরীরে রক্তের অভাব দেখা দেয়। এছাড়াও দূর্ঘটনায় অধিক রক্তপাত, কিংবা সন্তান প্রসবকালেও প্রসুতি মায়ের জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়।

সাধারণত কোনো ব্যক্তির জন্য রক্ত প্রয়োজন হলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্লাড গ্রুপ অনুযায়ী মিল আছে এমন ক‍াউকেই রক্তদানের জন্য বাছাই করা হয়। তবে সময়ের অভাবে বা অন্য কোনো কারণে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে রক্ত পাওয়া না গেলে তখন আমরা অন্যের দারস্ত হই। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্লাডব্যাংক গুলোর রক্ত শতভাগ বিশুদ্ধ হয় না এমন একটা ধারণা সবাই কমবেশি পোষণ করেন। তাই রক্তচাহিদ‍া পূরণে ব্লাডব্যাংক গুলোও আর আগের মত ভূমিকা রাখতে পারছেনা। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীর রক্তের গ্রুপ বিরল হওয়ায় সহজে রক্ত সংগ্রহ করা যায় না। এরও একটা সহজ সমাধান আমরা বের করে ফেলেছি। হাতের কাছেই রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। এখনকার দিনে বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলোয় রোগীদের প্রয়োজনীয় রক্তের একটা বিরাট অংশ পূরণ করা হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। তাই রক্ত নিয়ে আর চিন্তা নেই। একটু দেরীতে হলেও রক্তদাতা জোগাড় হবেই। ফেসবুকে একট‍া পোস্ট দিলে কেউ না কেউ মানবতার ডাকে রক্ত দিতে আসবেই !

কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ধর্ম নিয়ে। আমাদের দেশের মানুষেরা বর্তমানে সবাই কমবেশি শিক্ষিত হলেও সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন কুসংস্কার এখনো সবক্ষেত্রে কমেনি। যার প্রভাব রক্তদানের মত একটি মহান স্বার্থহীন কাজেও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়…

আমাদের দেশের রক্তদাতারা প্রায়সময়ই রক্তদান করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটির মুখোমুখি হন, তা হচ্ছে রক্তদাতা অন্য ধর্মাবলম্বীর হওয়া। ডোনার অন্য ধর্মের অনুসারী হলে অনেকসময়ই রোগী এবং তার পরিবার রক্ত গ্রহণে অসম্মতি জানায়। ধরুন একজন সনাতন ধর্মের অনুসারী ব্যক্তির রক্তের প্রয়োজনে তার পরিবারের লোকজনেরা নিজেদের ভেতর থেকে কেউই রক্ত দিতে পারলেন না। রক্ত চেয়ে পোস্ট দিলেন ফেসবুকে। সেই পোস্ট দেখে মানবতার ডাকে দুপুরের প্রচন্ড রোদে এক মুসলিম ব্যক্তি হসপিটালে ছুটে গেলেন রক্ত দিতে। কিন্তু রোগী ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, “লোকটা তো মুসলিম”! রোগীর বাবা কড়া গলায় জানিয়ে দিলেন, “নাহ, কোনো বিধর্মীদের রক্ত নেয়া যাবেনা। অসুবিধা আছে !”

আবার মনে করুন একজন মুসলিম সিজারিয়ান বোনের জন্য ব্লাড চেয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া হলো তা দেখে একটা সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যগন একজন হিন্দু সেচ্ছাসেবক কে রক্ত দিতে নিয়ে আসলো কিন্তু রোগীর স্বামী সরাসরি বলে দিলেন আমরা কোন হিন্দু ধর্মাবলল্বীর রক্ত দিবো না।

সহজ কথায় আমরা এখনো এমন একটা ধারণা পোষণ করছি যে, একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী থেকে রক্ত গ্রহণ করলে ধর্ম তা মেনে নেবেনা। রক্তটা তাকে অপবিত্র করে দেবে ! কিন্তু সত্যিই কি তাই?

এ বিষয়ে কি বলে ইসলাম?

মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফের সূরা আল-মায়েদায় বনী-ইসরাঈলদের উদ্দেশ্য করে ৩২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে, “কোন ব্যক্তি যদি কারো জীবন বাঁচালো, তবে সে যেনো সমগ্র মানবজাতিকেই বাঁচালো।”

“If you save one life of human being it is equal of saving the whole humanity”

অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যে ধর্মেরই হোক না কেনো, জীবন বাঁচানোর জন্য সে যে কাউকে রক্ত দিতে পারে অথবা যে কারো রক্ত গ্রহণ করতে পারে। এ নিয়ে ইসলামে কোন বিধিনিষেধ নেই। আমি একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। অনেকেই আমার লেখাটি নিয়ে দ্বীমত পোষণ করতে পারেন। তাই আরো কিছু রেফারেন্স দিচ্ছি। আব‍ু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, মহানবী (সঃ) তার উম্মতদের উদ্দেশ্যে বলেছেন –

“O servants of Allah ! Seek medical treatment, because Allah did not make a disease without making a cure for it save old age” [Bukhari and Muslim].

“হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা রোগ হলে চিকিৎসা নাও। কারণ আল্লাহ চিকিৎসা ব্যতীত রোগ বানাননি। রোগের সাথে সাথে প্রতিকারও দিয়েছেন !” – বুখারী ও মুসলিম

অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যেমন আপনাকে আমাকে সৃষ্টি করেছেন। ঠিক তেমনি তিনিই আমাদের জন্য রোগব্যাধি বানিয়েছেন। আবার এই রোগব্যাধি থেকে উত্তোরণের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাও বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। রোগ হলে চিকিৎসা নিয়েই তার প্রতিকার করতে হবে। এটাই নিয়ম। রক্তদানও এর ব্যতিক্রম নয়। হোক অসুখ বিসুখ বা দুর্ঘটনা, সুস্থ হবার জন্য আপনার রক্তগ্রহণ প্রয়োজন। আপনি রক্ত নিবেন। সেখানে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খিষ্টান কোনো বিষয় নয়। আপন‍ার ‍‍দুঃসময়ে আপনার আত্মীয়স্বজনই যদি আপনাকে রক্ত দিতে এগিয়ে আসতে না পারে, ত‍াহলে আমি অন্যের সন্তান হয়ে কোনো স্বার্থব্যতীত আপনাকে রক্ত দিতে এগিয়ে আসলে আমার রক্ত নিতে আপনার সমস্যা কোথায়? মুসলিম হিন্দু সবার রক্তই তো এক। তাছাড়‍া পৃথিবীর কোনো ধর্মেই মানবসেবা অবহেলিত নয়। প্রতিটা ধর্মের মূলত মানবসেবাকে সবার উপরে অবস্থান দেয়া হয়েছে।

আজ যদি একজন হিন্দু বা অমুসলিম ব্যক্তির রক্তের প্রয়োজন হয়, তাহলে কি আপনি রক্ত দিবেন না? অবশ্যই দিবেন। বাংলাদেশের অসংখ্য মুসলিম প্রতিদিনই কোনো না কোনো অমুসলিমের প্রাণ বাঁচাতে রক্ত দিয়ে এগিয়ে আসছেন। ঠিক যেভাবে একজন মুসলিম রক্তদান করে একজন হিন্দুর জীবন বাঁচাতে পারেন। একইভাবে একজন অমুসলিম ব্যক্তিও রক্ত দিতে পারেন মুসলিমকে। এই রক্ত নিলে আপনি অপবিত্র হয়ে যাবেন না। বরং নিজের জীবন বাঁচিয়েই আপনি আরেকটি ফরজ আদায় করতে পারলেন।

আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। তোমরা নিজেদের ধ্বংস করে দিও না।”

‘নিজেকে ধ্বংস করা‘ – এ কাজটি বিভিন্নভাবেই হতে পারে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে হতে পারে। অসুখ বিসুখের সময় টাকা বাঁচাতে নিজের চিকিৎসা না করানোর মাধ্যমেও হতে পারে। আল্লাহ এ বিষয়গুলোকে কোর‍আনের মধ্যে স্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। এরপর বিধর্মীর রক্ত নিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে আপনার আর কোনো বাধা থাকে কি? অন্তত আমি আর কোনো বাধা দেখতে পাচ্ছিনা।


আমাদের দেশের মানুষেরা এখনো মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা, কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতার আচ্ছন্ন। বেশিরভাগ মানুষজনই এখনো ধর্মান্ধতার সীমারেখা পেরিয়ে ধর্মের সঠিক পথে আসতে পারেনি। এজন্য দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থা, বিবেকের সীমাবদ্ধতা ও মানবিকতার অভাব। একজন মানুষকে আমরা ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত না করে, তাকে উৎসাহিত না করে বরং ধর্মের দোহাই দিয়ে লজ্জ্বাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছি। একজন ডোনার যখন এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন, তখন তিনি নিজের কাছেই প্রচুর হীনম্মন্যতার স্বীকার হন, যা তাকে রক্তদানের মত মহ‍ৎ কাজটি করার বিষয়ে অনুৎসাহিত করে।

রক্ত আমার আপনার যে কারোই প্রয়োজন হতেই পারে। রক্তের জন্য প্রতিনিয়ত যে কত মানুষ মারা যাচ্ছে, তা গুনে শেষ করা যাবেনা। এখনই সময় এসব ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার। রক্তদানের এই মহান কাজটির প্রসারে আপনিও এগিয়ে আসুন।

লেখকঃ আবিদ হাসান সোলায়মান।
পরিচালকঃ রক্তকনা ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ। মঠবাড়িয়া,পিরোজপুর।

Leave a Reply

x

Check Also

লাইটার জাহাজের ধাক্কায় চরখালী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে বিধ্বস্ত 🔴 যানবাহন চলাচল বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কঁচা নদীর চরখালী-টগরা ফেরিঘাটের চরখালী ঘাটে একটি জাহাজের ধাক্কায় ফেরির ...