ব্রেকিং নিউজ
Home - মঠবাড়িয়া - বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পটভূমি

বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পটভূমি


১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেও বাঙালিরা ক্ষমতা পায় নি। আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারী শাসন আর শোষণের ধরন দেখে শেখ মুজিবুর রহমান (তখন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন নি) ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পথ ধরে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। এদেশের স্বাধীনতার জন্যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী তাজউদ্দিন আহমেদ, ব্যক্তিগত সহকারি গোলাম মোর্শেদ, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মহসিন, সিলেটের চা বাগানের মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী প্রমুখ এর পরামর্শে ভারত সরকারের সাথে একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়ার জন্যে তিনি ১৯৬৩ সালের ২০ জানুয়ারি গোপনে কুমিল্লা হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় চলে যান এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আলাপ আলোচনা কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রস্তাব করেন যে, ত্রিপুরার সীমান্তে অবস্থান করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা চালাবেন। এ ব্যাপারে তিনি ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। তাঁর এ প্রস্তাবটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে আলোচনা করেন। চীনের সাথে যুদ্ধে ভারতের বিপর্যয়ের কারণে নেহেরু এত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নি। আগরতলায় ১৫ দিন অবস্থান করার পর তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি খালি হাতে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঐ দিন রাতেই পুলিশ জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে তাঁর ধানমন্ডি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৩ সালের ১৮ জুন তিনি মুক্তি পান। অতপর তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের বলেন যে, ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নিজেরা কিছু করি।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সামরিক দিক দিয়ে এদেশ একেবারেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। জরুরী অবস্থায় কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত ক্ষমতা এদেশের শাসকদের ছিল না। এহেন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার তথা এদেশের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি তুলেন।
অতপর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দল সমুহের জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার ৬ দফা পেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন দলই ৬ দফা সমর্থন না করায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বর্জন করেন এবং ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলন করে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পেরে গোপনে করাচী গিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কন্যা বেগম আখতার সোলায়মানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরের দিন ঢাকায় আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।ছয় দফা নিন্মে বর্নিত হলঃ
১/লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিনত করতে হবে,যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে।
২/ ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং অপর সব বিষয় থাকবে ফেডারেল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে।
৩/ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে।
৪/ সব ধরণের কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে।
৫/ দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্যে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দিবে।
৬/ প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে অধা সামরিক বাহিনী গঠন এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্হাপন এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্হাপন করতে হবে।
ছয় দফা রচনায় বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেন তাজউদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির( কৃষি ব্যাংকের মহাব্যবস্হাপক), রুহুল কুদ্দুস(সি,এস,পি),আহমেদ ফজলুর রহমান (সি,এস,পি),শামসুর রহমান খান (সি,এস,পি)সহ ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের ওয়ার্কি কমিটির সভায় ৬ দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। ৬ দফা ঘোষণার পরপর এদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পাকিস্তান সরকার ৬ দফা কর্মসূচীকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্ট করার পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রত্যাখ্যান করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ৮ মে গ্রেফতার করে। ছাত্র – জনতার আন্দোলনে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জওনক জাহান বলেন, ৬ দফা আন্দোলন ক্ষনস্থায়ী হলেও তা বাঙালির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় এবং পরবর্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি- প্রকৃতি নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে এ ছয় দফা এক দফা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের দাবীতে পরিণত হয়।
তথ্য সূত্রঃ
১/বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দ্বিতীয় খন্ড।
২/ বাংলাপিডিয়া —-৪ র্থ খন্ড।
৩/জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫ —–অলি আহাদ। ৪/স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস —+ডঃ রামদুলাল রায় ।
৫/ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১–প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্য।
৬/ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস —ডঃ মোহাম্মদ হান্নান।

নূর হোসাইন মোল্লা
অবসরপ্রাপ্তপ্রধানশিক্ষক
গুলিশাখালীজিকেমাধ্যমিকবিদ্যালয়

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...