ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূল - মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির শুরু পাকিস্তানের করাচিতে

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির শুরু পাকিস্তানের করাচিতে

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং দেশরক্ষা বাহিনীতে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বৈষম্য ছিল হিমালয়সম। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কোন বাঙালি সচিব ছিলেন না। দেশরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদগুলো ছিল অবাঙালিদের দখলে। জুনিয়র গ্রেডে শতকরা ১০% ছিল বাঙালি।

কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য এবং বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নানা রকম নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর করাচিতে নৌবাহিনীর কতিপয় জুনিয়র অফিসার ও সদস্যদের নিয়ে ১৯৬১ সালে একটি বিপ্লবী সংস্থা ‘পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফোর্স’ গঠন করেন পিরোজপুরের সন্তান, তৎকালীন পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর তেজস্বী জুনিয়র অফিসার লে. মোয়াজ্জেম হোসেন।

তৎকালীন পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর জুনিয়র অফিসার লে. মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৩২ সালে পিরোজপুর জেলার পিরোজপুর সদর উপজেলার ডুমুরিতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মোফাজ্জল আলী। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে লে. কমান্ডার পদে উন্নীত হন। তিনি বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করা যাবে না। আর এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে বিপ্লবী সংস্থা ‘পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফোর্স’ গঠন করেছিলেন। আর এ ফোর্স পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ধীরে ধীরে বাঙালি রাজনীতিবিদ, সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদেরকে স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের চিন্তা-চেতনা সমন্বিত করতে থাকেন।

এ অবস্থায় জেনারেল আইউব খান সরকারের নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ডিমোক্রাটিক ফ্রন্টের কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে শেখ মজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি তখনও) ১৯৬৪ সালের ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করাচিতে অবস্থান করেন। ওই সময়ের কোন একদিন করাচির মালামা আবাদে ফেনী নিবাসী কামাল উদ্দিন আহমেদের বাসভবনে একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শেখ মজিবুর রহমান, লে. মোয়াজ্জেম হোসেন (পিরোজপুর), স্টুয়ার্ড মজিবুর রহমান (মাদারীপুর), প্রাক্তন লিডিং সিম্যান সুলতান উদ্দিন আহমেদ (গাজীপুর), আহমেদ ফজলুর রহমান, সিএসপি (কুমিল্লা), লিডিং সিম্যান নুর মোহাম্মদ (মুন্সীগঞ্জ), ও লে. মোজাম্মেল হোসেন (ময়মনসিংহ)।

ঐ বৈঠকে লে. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী সংস্থা ‘পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফোর্স’ গঠন করেছেন। এ সংস্থায় সেনা ও বিমান বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। এ সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন।

শেখ মজিবুর রহমান বলেছিলেন, তার নিজের পরিকল্পনার সাথে এ সংস্থার পরিকল্পনার মিল রয়েছে। এ সংস্থার প্রতি তিনি তার পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি (কুমিল্লা), লে. মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বলেন যে, পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য নিরসন করতে হলে সশস্ত্র বিদ্রোহের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক।

শেখ মজিবুর রহমান বিষয়টি তিনি দেখবেন এবং ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ১৯৬৫ সালে জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধীদল জয়লাভ করলে এর প্রয়োজন না-ও হতে পারে।

দুর্ভাগ্য, ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারির অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জেনারেল আইউব খান দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর শেখ মজিবুর রহমান ১৯৬৫ সালের ১৫-২১ জানুয়ারি পুনরায় করাচি যান। এ সময়ের মধ্যে কোন একদিন কামাল উদ্দিনের বাসভবনে একটি গোপন বৈঠক হয়।

এ বৈঠকে শেখ মজিবুর রহমান, লে. মোয়াজ্জেম হোসেন (পিরোজপুর), স্টুয়ার্ড মজিবুর রহমান (মাদারীপুর), প্রাক্তন লিডিং সিম্যান সুলতান উদ্দিন আহমেদ (গাজীপুর), আহমেদ ফজলুর রহমান, সিএসপি (কুমিল্লা), লিডিং সিম্যান নুর মোহাম্মদ (মুন্সীগঞ্জ) ও লে. মোজাম্মেল হোসেন (ময়মনসিংহ) ছাড়াও ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজউল্লাহ (নোয়াখালী) আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে শেখ মজিবুর রহমান বলেন, শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবে। তিনি এ সংগঠনকে পূর্ণ সমর্থন ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি লে. মোয়াজ্জেম হোসেনকে তার সংস্থার সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরপূর্বক কাজ তরান্বিত করতে অনুরোধ জানান।

১৯৬৬ সালের মে মাসে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ‘নেভাল বেস চিফ ইঞ্জিনিয়ার’ পদে চট্টগ্রামে বদলি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৭ সালের ১১ মার্চ ডেপুটেশনে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষের চাকরিতে যোগদান করেন।

সরকার এরমধ্যেই তার সংস্থার ভেতর ‘গুপ্তচর’ প্রবেশ করিয়ে দেন। এতে তার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় এবং ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর সরকার দেশরক্ষা আইনের আওতায় তাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিযোগ এনে তাকে রাষ্ট্র বনাম শেখ মজিবুর রহমান এবং অন্যান্য তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ২নং আসামি করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলা থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন’ কমিটি গঠন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্নতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান বাহিনী তাকে ঢাকার নিজ বাড়ি থেকে বের করে পরিবার পরিজনের সামনে গুলি করে হত্যা করে।

লেখক: সাবেক প্রধান শিক্ষক, গুলিশাখালি জি.কে. ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়

Leave a Reply

x

Check Also

লাইটার জাহাজের ধাক্কায় চরখালী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে বিধ্বস্ত 🔴 যানবাহন চলাচল বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কঁচা নদীর চরখালী-টগরা ফেরিঘাটের চরখালী ঘাটে একটি জাহাজের ধাক্কায় ফেরির ...