টিটু দাস, কিশোরগঞ্জ থেকে >
গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী বাজারে প্রবেশ করতেই শোনা যাচ্ছে অনেকগুলো ঢাকের শব্দ ও সানাইয়ের শব্দ। দূর থেকে এ শব্দ শুনে যে কেউ ভাবতেই পারেন হয়তো কোথায়ও বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু আদতে তা নয়। দুর্গা পূজা আয়োজকদের আকৃষ্ট করতেই ঢাকিওয়ালারা বাজনার তালে নাচ আর নানা ঢংয়ের অঙ্গ-ভঙ্গী প্রদর্শনের মাধ্যমে নজর কাড়ার চেষ্টা করছে ঢাক আর ঢোল ব্যবসায়িরা। এভাবেই ঢাকিওয়ালারা টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পূজার দিনগুলোর জন্য বিভিন্ন জায়গার পূজা মন্ডপে চলে যায়। স্থানীয়রা জানান ৫০০ বছরের পুরানো ব্যাতিক্রমী কটিয়াদির এই ঢাকির হাট।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজ প্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। উপজেলাটির চারিপাড়া গ্রামে ছিল ওই রাজার রাজমহল। একদা রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকির সন্ধান করতে বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সেসময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর কটিয়াদীর যাত্রাঘাট নামক স্থানে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তীতে স্থানান্তরিত হয়ে পুরান বাজারে বসে আসছে এ হাট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকের বাজনা বা ঢাকিওয়ালা জোগাড় করতে পূজা আয়োজকদের ভিড় জমেছে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরান বাজারে। ৫০০ শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট এবারও বসেছে। পূর্ব রীতি অনুযায়ী, হাট বসে দুদিন। পূজা শুরুর আগের দিন ও পরদিন কটিয়াদীতে বসে ঢাকের হাট। এ হাটে আসা ঢাকিরা আসেন মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর, ঢাকার নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর ও নরসিংদী থেকে। ঢাক, কাসি, সানাই, নানা জাতের বাঁশি, করতাল, মঞ্জুরীসহ তাঁরা সমবেত হন হাটের আগের দিন থেকে।
ওই দুই দিন পুরানবাজারে অন্য রকম উৎসব বিরাজ করে। চারপাশ বাজনার শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। দক্ষতা দেখার পর চলে দর কষাকষি। সাধারণত দল ভিত্তিক চুক্তি হয়ে থাকে। প্রকার ভেদে ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকেন তাঁরা। দুর্গাপূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত তাঁরা ম-পেই অবস্থান করেন এবং বাজনা বাজিয়ে পূজায় আগত দর্শনার্থীদের আনন্দ দেন।
ঢাকের হাটের আয়োজকরা দাবি করছেন বাংলাদেশে কোথাও এ ধরণের হাট বসে না। তাঁরা জানান, ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে হাটটি এখন গর্ব ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেব বিবেচিত হয়ে আসছে।
ঢাকার শাখাঁরী বাজার থেকে আসা অমল দেবনাথ বাংলানিউজকে বলেন, আমি বা আমার পরিবারের লোকজন প্রতিবছর ঢাকের খোঁজে এ হাটে আসি এবং ঢাকীসহ বাদক নিয়ে যাই। এবার এসেছি দাম যাই হোক ঢাক নিয়ে যাব।
মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে আসা ঢাকী বাদক সুবেন দাস বলেন, আমি ও আমার সাথে বুলু দাস দু’জনে ২৫ হাজার টাকায় যাচ্ছি নরসিংদী জেলার মনোহরদীতে।
মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর লৌহজং থেকে আসা ঢাকী বাদক বিপদ ভঞ্জন দাস বলেন, আমি এ হাটে আসছি প্রায় ১৮ বছর ধরে। কোথায়ও চুক্তিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত মন্দির বা আখড়ার বারান্দায় রাত কাটাতে হয়। ঢাকের হাটের আয়োজকরা যদি আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করেন খুব ভাল হয়।
এ বিষয়ে ঢাকের হাটের প্রধান আয়োজক শীতল কুমার সাহা বলেন, ভবিষতে ঢাকীদের থাকার কথা মাথায় রেখে আমরা টিনশেড ঘরের ব্যবস্থার কথা ভাবছি।