✒️ বার্ট্রান্ড রাসেলের উক্তি দিয়ে শুরু করছি। তিনি বলেছেন,”Teachers are the architect of a nation and herbringer of the civilization”. শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। শিক্ষার সার্বিক প্রসার এবং মানবিক গুনাবলী বিকাশে গুরু দায়িত্ব শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল।একটি উন্নত জাতি হিসেবে অাত্মপ্রকাশ করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।অামাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।সরকার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরকে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করে অাসতেছেন। বর্তমানে দেশের মোট শিক্ষকের ৯৫% জন বেসরকারি।তাঁরা দেশের বৃহত্তম পেশাজীবী গোষ্ঠী। সুশিক্ষক সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র।কিন্তু তাদের বেতন–ভাতা পর্যাপ্ত নয়।বেতন–ভাতা বৃদ্ধি করা উচিত।কারণ, শিক্ষক শিক্ষাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুনাগরিক সৃষ্টি করেন।শিক্ষক শুধু শিক্ষা দানই করেন না,মানুষ সৃষ্টি করেন এবং জাতি গঠন করেন।জাতির মান নির্ভর করে সমাজের প্রত্যেকটা নাগরিকের মানের উপর।নাগরিকের মান নির্ভর করে শিক্ষার মানের উপর।শিক্ষার মান সম্পূর্ন ভাবে নির্ভর করে শিক্ষকের উপর।
পরিতাপের বিষয়,আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ অবহেলিত।উন্নত দেশে বিশেষ করে রাশিয়ায় সমমানের যোগ্যতার দিক দিয়ে শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা অন্য যেকোন পেশার উর্দ্ধে। অামাদের দেশে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগ অনুৎপাদনশীল ধরা হয়।ব্যবসা–বানিজ্য ও শিল্প–কারখানায় পুঁজি বিনিয়োগ করা হলে এর মুনাফা হাতে হাতে পাওয়া যায়।কিন্তু শিক্ষা খাতে পূঁজি বিনিয়োগ করা হলে এর মুনাফা সরাসরি অর্থে পাওয়া যায় না।উন্নত দেশে শিক্ষা খাতের ব্যয়কে উৎপাদনশীল ব্যয় ধরা হয়।তারা শিক্ষা খাতে বিপুল পরিমানে পূঁজি বিনিয়োগ করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি করে।কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের সম্পদ।
বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন–ভাতা কম পাওয়ার কারণ হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার অভাব,অপরিকল্পিতভাবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও নতুন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দান। ফলে জাতীয় বাজেটের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।অপরদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায়,স্বজনপ্রীতি ও অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিক্ষার মান অবনতি হচ্ছে।সৃষ্টি হচ্ছে বহুমূখী সংকট।এ সংকট নিরসনকল্পে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। সুখী–সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে হলে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদেরকে সরকারি শিক্ষকদের অনুরুপ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।তাদেরকে বঞ্চিত করা যাবেনা।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৯ হাজার এম.পি.ও ভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(স্কুল এন্ড কলেজ সহ) অাছে।এম.পি.ও. প্রাপ্তির জন্যে অাবেদন করেছে প্রায় ৪ হাজার প্রতিষ্ঠান। এম.পি.ও. ভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখের অধিক শিক্ষক–কর্মচারী কর্মরত অাছেন।এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ। এম.পি.ও.বিহীন মাধ্যমিক শিক্ষক–কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার ।এম.পি.ও ভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষক–কর্মচারীরা বেতন স্কেলের শতভাগ পেলেও সরকারি শিক্ষক–কর্মচারীদের অনুরুপ সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের বৈষম্য নিম্নে দেয়া হলঃ
১।বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এম.এল.এস.এস থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান বর্তমানে ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক –কর্মচারী কর্মস্থল ভেদে বেতন স্কেলের ৪ ০–৪৫% বাড়ি ভাড়া পাচ্ছেন।
২।এম.এল.এস.এস থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা পাচ্ছেন।পক্ষান্তরে,সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীরা চিকিৎসা ভাতা পাচ্ছেন ৭০০ টাকা।
৩।বেসরকারি একজন মাধ্যমিক শিক্ষক তাঁর মূল বেতনের ২৫% টাকা এবং একজন কর্মচারী তার মূল বেতনের ৫০% টাকা উৎসব ভাতা পাচ্ছেন।অপরদিকে একজন সরকারি শিক্ষক কর্মচারী তার মূল বেতনের সম পরিমান উৎসব ভাতা পাচ্ছেন।
৪।বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারীকে তার মূল বেতনের বার্ষিক ৫% প্রবৃদ্ধি দেয়া হয় না।অপরদিকে একজন সরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীকে মূল বেতনের ৫% প্রবৃদ্ধি দেয়া হচ্ছে।
৫।বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকের পদোন্নতি নাই।পক্ষান্তরে, সরকারি শিক্ষকের পদোন্নতি আছে।
৬।একজন বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারী তার সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যে শিক্ষা ভাতা পান না। পক্ষান্তরে, একজন সরকারি শিক্ষক–কর্মচারী তাঁর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যে শিক্ষা ভাতা পান।
৭।বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীরা কর্মচারীদের অবসর সুবিধা এবং কল্যাণ ভাতা পেতে প্রায় ৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়। পক্ষান্তরে সরকারি শিক্ষক – কর্মচারীরা ৬ মাসের মধ্যে অবসর ভাতা পান।
৮।বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদেরকে বৈশাখী ভাতা দেয়া হয়না। পক্ষান্তরে সরকারি শিক্ষকদেরকে বৈশাখী ভাতা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির দাবী মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হোক।মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর মতে, এ মূহুর্তে জাতীয়করণ করা সম্ভব নয়। শিক্ষা জাতীয়করণ করতে হলে বিপুল পরিমান অর্থের প্রয়োজন হবে।মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদে বলেছেন,বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হলে সরকারকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে।অার এ খাতে এত টাকা দিলে অন্যান্য খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নিকট শ্রদ্ধার সাথে প্রশ্ন করছি,মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করতে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন–ভাতা,বাড়ি ভাড়া এবং শিক্ষার উপকরণ বাবদ কি পরিমান অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের বেতন, সেশন ফি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিল, সংরক্ষিত তহবিল এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সম্পদ বাবদ কি পরিমান অর্থ সরকার পাবেন তা শিক্ষা মন্ত্রনালয় জরিপ করেছেন কি? অামার মতে অপ্রয়োজনীয় এবং অযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাকীয়করণ করা হলে সরকারকে বিপুল পরিমান অর্থ দিতে হবে না।বরং সরকারই লাভবান হবেন।এছাড়া, শিক্ষানীতি অনুসারে এম.পি.ও. ভুক্ত ২৮৬৯ টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষক কর্মচারীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে সমন্বয় করা হলে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
শিক্ষা একটি উৎপাদনশীল খাত।এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিৎ।সরকার বহু অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিচ্ছেন, সরকারের বহু প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি ও অপচয় হচ্ছে।সরকারি ব্যাংক গুলো থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে সে অর্থ মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন তথা জাতীয়করণে ব্যয় করা হোক।মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে শ্রদ্ধার সাথে অনুরোধ করছি, বিষয়টি সদয় বিবেচনা করার জন্যে।অাসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অাওয়ামী লীগের নির্বচনী ইস্তাহারে মাধ্যমিক, কলেজ,মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করুন।
লেখকঃ প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি,মঠবাড়িয়া উপজেলা শাখা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
মোবাইল নম্বরঃ০১৭৩০৯৩৫৮৮৭