ব্রেকিং নিউজ
Home - অন্যান্য - কৃষি ও বাণিজ্য - ঘুটিয়া মসজিদ বরিশাল।

ঘুটিয়া মসজিদ বরিশাল।

নাম : কেশবচন্দ্র দাশ

পিতার নাম : স্বর্গীয় রাজেন্দ্রচন্দ্র দাশ

গ্রাম : কুন্দদিয়ার, ডাক : বানারীপাড়া

ইউনিয়ন : বানারীপাড়া, থানা : বানারীপাড়া, জেলা : বরিশাল

১৯৭১ সালে বয়স : ৩০

১৯৭১ সালে শিক্ষাগত যোগ্যতা : বি. এ., বি. এড

১৯৭১ সালে পেশা : শিক্ষকতা

বর্তমান পেশা : শিক্ষকতা

প্র: ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আপনার কি মনে হয়েছিল? আপনার এলাকার মানুষের মনোভাব কি ছিল?

উ: ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিক থেকে আমরা একটা ভয়ভীতিতে দিন কাটাইতেছিলাম। দেশে বোধহয় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতেছে না এর পরিণতিতে হয়ত এই দেশে একটা আন্দোলন হবে। এই আন্দোলনে বহুলোকের ক্ষতি হবে। বহুলোককে জেলে যেতে হবে। কিন্তু ’৭১ সালের মার্চ মাসে এত লোকজন হত্যা করবে পাকবাহিনী এটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। আমরা তখন মনে মনে চিন্তা করেছি বিগত দিনের বিভিন্ন আন্দোলনে যেমন আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন রকমের হামলা হয়েছিল তেমিন হবে পুলিশী হয়রানি হবে। আমার এক ছোট ভাই ছিল, তাকে প্রায়ই ধরতে আসত পুলিশ। আমাকেও পুলিশ বিভিন্ন কেসে অনেক সময় জড়িত করেছে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সময় আমাদের বিরুদ্ধে কেস হয়েছিল, তাতে আমি একজন আসামী ছিলাম। পরবর্তীকালে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশ আমাদের প্রায়ই খুঁজতো। আমাদের একটা ধারণা ছিল যে মার্চের পরেও আমাদের উপর এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের এলাকার মানুষ সবাই চেয়েছিল যেন শান্তিপূর্ণভাবে পাক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে। যখন তারা দিচ্ছে না, তখন সব মানুষের মনে একটা আতঙ্ক ছিল এবং সবাই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেছিল যে আমরা আন্দোলন করবো। আমরা পাকিস্তানের অত্যাচার কিছুতেই সহ্য করব না। বিশেষ করে বানারীপাড়ার লোক সব সময় প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল।

প্র: ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আক্রমণ সম্পর্কে কি শুনেছেন? কখন, কিভাবে শুনেছেন? আপনার তখন কি মনে হয়েছিল?

উ: পাকিস্তানি বাহিনী ২৫শে মার্চ ঢাকায় যখন আক্রমণ করলো, তখন আমরা বানারীপাড়াতে ছিলাম। পরের দিন ভোরে ভারতের রেডিও সংবাদ থেকে প্রথম শুনতে পারলাম যে, ঢাকায় পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে এবং বহু লোক হতাহত হয়েছে। এরপর থেকেই আমাদের মনের মধ্যে খুব ভয় দেখা দিল। আমাদের ঢাকায় যে সমস্ত বন্ধুবান্ধব ছিল, আত্মীয়স্বজন ছিল তাদের জন্য আমরা চিন্তা করতে লাগলাম। আমরা সব গ্রামের মানুষ পাগল হয়ে ছুটতে লাগলাম, কিভাবে খবর পাব। ২৬শে মার্চ রাতের বেলা আমরা বি.বি.সি থেকে মোটামুটি কিছু সংবাদ শুনতে পাইলাম এবং পরবর্তীকালে ভারত থেকে রাত সাড়ে দশটার নিউজেও শুনতে পাইলাম। ২৭শে মার্চ ভোরের দিকে আমাদেরই একজন বন্ধু ঢাকা থেকে আসলেন। তিনি এসে ঢাকার যে বর্ণনা দিলেন সেটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। তিনি সংবাদ অফিসে চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনি ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক গোলাম সারোয়ার। তার কাছ থেকে ঢাকার সমস্ত ঘটনা শুনার পর আমাদের মনে এক বিরাট আতঙ্কের সৃষ্টি হলো।

প্র: আপনি বললেন, আপনার বন্ধু ঢাকা থেকে এসে আপনাদেরকে ঢাকার খবরাখবর সম্বন্ধে অবহিত করেছেন। তিনি ঢাকার এই আক্রমণ সম্পর্কে আপনাদেরকে কি বলেছিলেন এবং আপনারা তার কাছ থেকে কি জানতে পেরেছিলেন?

উ: তিনি সংবাদে চাকরি করতেন। তিনি বললেন যে, পাকসেনারা ‘সংবাদ’ অফিসে গিয়ে সংবাদ অফিস পুড়াইছে। তখন তিনি অফিসে ছিলেন না। তিনি বহু কষ্টে তার বাসা থেকে হেঁটে তার এক বন্ধুর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে খাল পেরিয়ে তিনি বহু মাইল পায়ে হেঁটে দেশের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছেন। তার পা ফুলে গিয়েছিল। তিনি দেখেছেন ঢাকার সদরঘাটে এবং বিভিন্ন জায়গায় বহুলোককে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে।

প্র: ঢাকার এই আক্রমণ শুনে আপনার তখন কি মনে হয়েছিল?

উ: ঢাকার আক্রমণ শুনে আমাদের মনে হইছিল যে, এইবার আমাদের সংগ্রামে নামতেই হবে, স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হবে। বানারীপাড়াতে তৎকালীন কিছু যুবক এবং ছাত্র নিয়ে বানারীপাড়ার স্কুল মাঠে সন্ধ্যার পর বসলাম। মোটামুটি একটা কর্মপন্থা ঠিক করলাম। পাকবাহিনীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে-এমন প্রতিজ্ঞা করলাম। আমাদের বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন সে সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। মানুষঝন নানারকম গুজব ছড়াচ্ছিল। কেউ বলছে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, কেউ বলছে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কয়েক দিনের মধ্যে কোনো সঠিক সংবাদ পাইলাম না।

প্র: আপনি বললেন যে আপনারা বানারীপাড়া স্কুল মাঠে এলাকার ছাত্র এবং যুবকদের নিয়ে একটি আলোচনায় বসেছিলেন, এটি কত তারিখে এবং সেদিনের আলোচনার ধরণটি কি রকমের ছিল?

উ: তারিখটা আমার সঠিক মনে নাই। সম্ভবত আমরা ২৮ মার্চ রাতের বেলা বসলাম। তখন আমরা উপলব্ধি করলাম যে, আমাদের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করা উচিত। অন্যান্য জায়গাতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রয়েছে এবং এ ব্যাপারে বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের যোগাযোগ করা দরকার। আমরা মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদেরকে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত করবো।

প্র: আপনার এই বক্তব্য থেকে কি এটা পরিস্কারভাবে বুঝা যায় যে ২৮শে মার্চ তারিখেই আপনারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন হিসাবে দাঁড়িয়েছেন বা সেই রকমের চিন্তা করছিলেন?

উ: মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন হিসাবে তো ঐ দিন আমরা দাঁড়াইনি। তবে আমরা একটা চিন্তাভাবনা করছিলাম। আমরা কি করতে পারি, কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি এবং কিভাবে দেশের এই বিপদকালীন সময়ে মানুষের পাশে থাকতে পারি। এই চিন্তাভাবনা আমরা সেদিনই করেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন হয়েছে তারও এক দুই মাস পরে।

প্র: ২৮শে মার্চ তারিখের আলোচনায় যারা ছিলেন পরবর্তীতে কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা?

উ: হাঁ, আমরা অধিকাংশই ছিলাম এবং এ ছাড়াও বাইরের এলাকার কিছু লোকজন ছিল।

প্র: ১৯৭১ সালে আপনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কি? কি ভাবে আক্রান্ত হলেন?

উ: ১৯৭১ সালে। একদিন রাতের বেলা অমরা বাড়িতে সব একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে বানারীপাড়া পিস কমিটির সভাপতি আলী মিয়া ও তার সহযোগী নজরুল দারোগা এবং আরও কিছু সংখ্যক লোক আমাদের বাড়ি-ঘর আক্রমণ করে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা মন্দির ছিল, মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের ঘরের চারিদিক দিয়ে বেড় দেয়। তখন আমরা পিছনের দরজা দিয়ে সব পালিয়ে যাই। আমাদের কাউকে পায়নি। কিন্তু আমাদের ঘরে ঢুকে বিভিন্ন মালামাল লুটতরাজ করে। আমার বৃদ্ধ পিতাকে-তার বয়স তখন প্রায় ৬০ বছর ছিল, তাকে ঘরের সামনে দাঁড়া করিয়ে গুলি করার হুমকি দেয় এবং তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। কোনোরকম প্রাণে বেঁচে আসি সেদিন। পরবর্তীতে বানারীপাড়া থানা আমরা আক্রমণ করি। আমাদের সহযোগী দু’জন মুক্তিযোদ্ধা সেদিন প্রাণ হারায়। পরে আবার আমরা থানা আক্রমণ করে দুই তিন জন পুলিশকে হত্যা করেছিলাম এবং পরে সবাই স্যারেন্ডারও করেছে। তাদের কাছ থেকে বহু অস্ত্র পেয়েছি। এরপরে নভেম্বর মাসের দিকে আমরা আবার থানা আক্রমণ করি। এই আক্রমণের সময় বর্তমান যিনি চীফ হুইপ আছেন জনাব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ তিনি আমাদের সাথে ছিলেন। তাঁর মুজিব বাহিনী এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয়ে বানারীপাড়া থানা আক্রমণ করি। আমরা সাকসেসফুল হই। দুটি ক্যাম্প থেকে আমরা ৮০ জন রাজাকারকে ধরতে সক্ষম হই।

প্র: আপনি বলছিলেন যে, বানারীপাড়া থানা আপনারা আক্রমণ করেছিলেন, বানারীপাড়া থানা কেন আক্রমণ করলেন?

উ: বানারীপাড়া থানাকে কেন্দ্র করে পাকবাহিনীর দোসররা বিভিন্ন জায়গায় রাতে দিনে আক্রমণ করতো। তারা অত্যাচার করতো, লুটতরাজ করতো। নজরুল ওসি করে একজন ওসি ছিল। সেই ওসি বিভিন্ন লোকরে যেমন-আমাদের পশ্চিম পাড় থেকে আবদুল কাদের নামে এক ছেলেকে ধরে নিয়ে পিরোজপুরে চালান দিয়ে হত্যা করে। বিভিন্ন জায়গায় সে অত্যাচার করতো। লুটতরাজ, নারীধর্ষণ কোনোটা বাদ রাখে নাই সেই নজরুল ওসি। সেই কুখ্যাত নজরুলের পতন ঘটাবার জন্যই আমরা বানারীপাড়া থানা বার বার আক্রমণ করেছি।

প্র: আপনার কথা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, এই নজরুল ওসি যার কথা আপনি বললেন সে তার থানাতে পাকবাহিনী এবং পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার আলবদরদের স্থানীয় ক্যাম্প বা ঘাঁটি তৈরি করেছিল?

উ: হাঁ, ঘাঁটি তৈরি করছিল। বানারীপাড়াতে যেটা বর্তমানে সিও রেভিনিউ অফিস ঐ রেভিনিউ অফিসের দোতলায়, মধু সাহেবের বাড়ির দোতলায় এবং আরেকটা অনুপ গুহের বাড়ির দোতলায় তারা পর্যায়ক্রমে তিন জায়গায় ক্যাম্প তৈরি করেছিল।

প্র: এই ক্যাম্প কতদিন স্থায়ী হয়েছিল এবং এই ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের কার্যক্রম কি ছিল?

উ: এই ক্যাম্পে যারা ছিল তারাতো প্রায় সবাই ছিল পাকিস্তানি পুলিশ এবং রাজাকার। তারা বিভিন্ন জায়গায় দিনের বেলায় লুটতরাজ করতো এবং মাঝে মাঝে কুরিয়ানা, আটঘর এবং গাবাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়া গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়াই দিত এবং যাদের পাইত তারা তাদেরকে ধরিয়া নিয়া হত্যা করতো।

প্র: আপনার এলাকায় কোন কোন স্থানে পাকবাহিনী, রাজাকার বা আলবদর এবং শান্তিকমিটির ক্যাম্প বা অফিস ছিল?

উ: বানারীপাড়া বাজারে রামকৃষ্ণ সাহার বাড়ির দোকান ঘরে শান্তিকমিটির একটা অফিস ছিল এবং থানায়, মধু সাহার বাড়িতে রাজাকারের ক্যাম্প প্রথম থেকেই ছিল। পরবর্তীকালে যখন মধু সাহার বাড়ি আক্রমণ করে দালানটা ধ্বংস করা হয়, তখন তারা আর সি অফিসে এবং অনুপ গুহের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐখান থেকেই বিভিন্ন এলাকায় তারা আক্রমণ করতো।

প্র: এই ক্যাম্পগুলোতে যে সমস্ত রাজাকার বা শান্তিকমিটির লোকজন ছিল বা পাকবাহিনীর দোসররা ছিল এদের কারও নাম কি আপনার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে?

উ: নাম সবার জানি। কারা কি করেছে তাও জানি। কিন্তু বলা ঠিক হবে না আজ। একজন নাম করা পিস কমিটির লোক ছিলেন-তিনি এই অঞ্চল থেকে যত লোক যেতো সেই নৌকাগুলা লুট করতো। আর একজন ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে স্বরূপকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হইছেন। তিনিও একজন বড় লুটেরা ছিলেন। এখনও তিনি জীবিত আছেন।

প্র: আপনি কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন?

উ: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে। এ ছাড়া আমার গত্যন্তরও ছিল না।

প্র: আপনার এলাকা কখন পাকবাহিনীরা আক্রমণ করলো? কিভাবে আক্রমণ করলো?

উ: পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রায়হাট থেকে প্রথম ঢুকে বানারীপাড়া। আমরা যখন সংবাদ পাইলাম তখন বানারীপাড়ার আলতাতে কমলা চৌধুরীর বাড়িতে বহু হিন্দু বরিশাল থেকে আইয়া আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে অবণী ঘোষ ছিলেন। আরও বড় বড় অনেক নামকরা লোক ছিলেন। এরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা রায়হাটে পাকবাহিনী আসছে এ সংবাদ পাওয়ার পরেই আমার ছোট ভাই শহীদ বিমলকৃষ্ণ দাশ বিকল্প রাস্তা দিয়ে প্রথম সেখানে ছুটে যায় এবং খবর দেয় যে, আপনারা সরে যান, পাকবাহিনী ঢুকেছে। এরপরে গাবা অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকেও গোলাগুলি শুনতে পাইলাম। গোলাগুলি করতে করতে পাকবাহিনী গাবা বাজারে আসে। সেখানে দোকানদার দুইজন বণিক এবং আরোও কয়েকজন দোকানদারকে তারা হত্যা করে। গাবা বাজারে তারা লুটতরাজ করলো। এরপর বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে ঢুকে বহুলোককে তারা ধরে নিয়ে গেল। ধরে নিয়ে এসব লোককে কমলা চৌধুরীর বাড়ির কাছে একটি খাল পাড়ে যায়। সেখানে চৌদ্দ পনের জন লোককে তারা হত্যা করলো। এরপরে নরেরকাঠি পুলের গোড়ায় ত্রিশ পয়ঁত্রিশ জন লোককে ধরিয়া নিয়া তারা সেখানে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো। এ রকম করে সমস্ত দিন তারা তান্ডবলীলা চালালো। এরা বরিশাল থেকে এসেছিল আবার বরিশালে সন্ধ্যার আগেই চলে গেল। আমরা পরবর্তীকালে এইসব ডেডবডি দেখেছি। তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বানারীপাড়ায় তেমন সংগঠিত হয়নি। হঠাৎ করেই আক্রমণ হয়েছে। পাকবাহিনী ঘুটিয়া পর্যন্ত আসছে লঞ্চে। ঘুটিয়া থেকে হাটিয়া এই অঞ্চলে ঢুকছে বেলা দশটার দিকে। সঙ্গে পাকবাহিনীর দোসররা ছিল। গাবা-রামচন্দ্রপুরের তৎকালীন চেয়ারম্যান ফজলু সিক্‌দার তাদের সাথে ছিল। তারই ইঙ্গিতে এরা বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন করেছে বলে শুনেছি।

প্র: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আপনার এলাকায় কি করলো?

উ: পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই অঞ্চলে প্রায়ই আসত। তবে তাদের সাথে আমাদের যে যুদ্ধ হয়েছে তারমধ্যে তিনটা অপারেশন খুব উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে। একটি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, আরেকটি মে মাসের শেষ সপ্তাহে, আরেকটা জুন মাসের মাঝামাঝি। এই তিনটা অপারেশন এখানে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই তিনটা অপারেশনে কয়েক’শ লোককে তারা হত্যা করেছে। যেমন-আমাদের বর্তমান বানারীপাড়া থানাধীন গাবা অঞ্চলে তারা তিন বার অপারেশন করেছে। গাবা অপারেশনের পরে সন্ধ্যার সময় যখন পাকবাহিনী চলে গেছ, তখন আমরা বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে যা দেখেছি, সেই দৃশ্য এখনও আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গাবার বেশকিছু বাড়িতে আগুন দিয়ে তারা পুড়িয়ে দেয় এবং সেই জায়গায় ৮০ বৎসর বয়সের দুই মহিলাকে আমরা দেখেছি যে, সেখানে তারা ঘরের মধ্যে আগুণে পুড়ে দলা হয়ে রয়েছে। পুকুর পাড়ে, জঙ্গলের মধ্যে যে যেখানে পালায়ছিল পাকবাহিনী তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে সেখানেই হত্যা করেছে। আমরা বানাহাটখোলা অঞ্চলে যখন গেলাম, তখন শুনতে পাইলাম রমেশ নামের একজন নামকরা লোক, গাবা-রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের লোক, তাকেও হত্যা করেছে পাকবাহিনী। বিভিন্ন জায়গা থেকে নারায়ণপুর, ঘুটিয়া তারপর অন্যান্য এলাকার লোকজনকে তারা ধরিয়া আনিয়া, এক মাঠে বসিয়া প্রায় এক দেড়’শ লোককে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। সেই ডেড বডিগুলোর কথা মনে পড়লে আজও আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। তিন চার দিন পরেও আমরা দেখেছি এই গাবা অঞ্চলের খালে বহু লাশ ভাসছে। সেই লাশ দাফন করার মতো কোনো লোক এই অঞ্চলে ছিল না। কোনো লোক তখন আগাইয়া আসতে সাহসও পায়নি। এই অঞ্চলে ছিল না। কোনো লোক তখন আগাইয়া আসতে সাহসও পায়নি। এই অঞ্চলে পাকবাহিনীর দোসররা এবং পাকবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তা ছিলো ভয়াবহ। এটা অত্যন্ত দুঃখদায়ক। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি বা যারা সেই দৃশ্য দেখেছে তারা সে কথা মনে করলে আজও আতঙ্কে কেঁদে ওঠে।

প্র: আপনি বলছিলেন তিনটি এলাকায় পাকসেনারা অপারেশন করেছে-গাবা, রামচন্দ্রপুর এবং নলছিটি। অপর দুইটি এলাকা সম্বন্ধে কি আপনি কিছু বলতে পারবেন?

উ: তারা বানারীপাড়া নলছিটিতে কতগুলো ঘর পুড়াই দিছিল বিশেষ করে মন্দির পুড়াই দিছে। বহু ঘর দরজা তাদের দোসররা ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। অনেক বাড়ির ভাল ভাল ঘর তারা ভাইঙ্গা নিয়া গেছে এবং জিনিসওপত্র লুট করছে। পাকবাহিনীর অপারেশনের পর পরই তৎকালীন পিস কমিটির লোকের নেতৃত্বে রাজাকার আলবদর-তারা বহু লুটতরাজ এই অঞ্চলে করেছে এবং মানুষকে নিঃস্ব রিক্ত করে দিয়েছে।

প্র: আপনি বলছিলেন হানাদাররা এখানে অনেক লোককে হত্যা করেছে এবং অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, আপনার ধারণা কত সংখ্যক লোক এখানে নিহত হয়েছিল?

উ: আমার মনে হয় গাবা, রামচন্দ্রপুর এবং আমাদের এলাকা মিলিয়ে প্রায় তিন’শ লোকের উপরে নিহত হয়। একটা গ্রামেই পাঁচ সাতশ’র উপরে ঘর-বাড়ি তারা পুড়াই দিছিল। আর সে গ্রামটা গাবা।

প্র: আপনার এলাকায় আর কোন জায়গায় এ রকমের অপারেশন হয়েছে?

উ: বানারীপাড়ার বেণীলাল দাশগুপ্তের ঘর পুড়াইছে, আমাদের বাড়ির একটা ঘর পুড়াইছে। তারপরে নলছিটি এলাকার কিছু ঘর পুড়াইছে। মাছরঙাতে ঘর পুড়াইছে, বিভিন্ন জায়গায় তারা ঘর পুড়াইছে আরকি। বড় ঘর তারা ভাইঙ্গা চুইরা লুটতরাজ কইরা নিয়া গেছে। পাকবাহিনী যখন প্রথম দিন আক্রমণ করলো মে মাসের দিকে, তখন কোনো লোক কিন্তু প্রস্তুত ছিল না। যেই শুনেছে যে পাকবাহিনী এসেছে, পাকিস্তানি আর্মিরা এসেছে, তখন যে যেখানে পারছে পালিয়ে গেছে। তবে তখন অনেকের একটা সুযোগ ছিল। পাকবাহিনী সাধারণত হিন্দুদের বাড়ি খুঁজত। তারা জিজ্ঞাসা করতো হিন্দু কাঁহা হ্যায়। এইজন্য স্থানীয় যারা হিন্দু ছিল তারাই বেশি পলাইছে এবং মুসলমান বাড়িতে গিয়া আশ্রয় নিতো। তারাও তখন আশ্রয় দিত। হয়তো তারা মনে করতো যে, এক ভাই আরেক ভাইকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের নৈতিক কর্তব্য। তখন কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সব মানুষই কিভাবে বাঁচবে বাঙালি হইয়া এই একটা চিন্তাভাবনা তাদের মধ্যে ছিল। এ জন্য প্রথম অবস্থায় হিন্দুরা সাধারণত স্থানীয় মুসলমানদের এলাকায় যাইয়া থাকত। আবার তারা রাতের বেলা বাড়ি চলে আসত। ভোর বেলা হইলে পরেই পাক করে, খাওয়া দাওয়া করে তারা যাইয়া নিরাপদ আশ্রয়ে থাকত। দিনের বেলা আইয়া পাকবাহিনী ঢুকতো গ্রামে। পরবর্তীকালে যখন ঘুটিয়া, নারায়ণপুরে পাকবাহিনী আক্রমণ করলো তখন দেখা গেল যে, কোনো লোক বাঁচে না, হিন্দুও মারে, মুসলমানও মারে। তখন সবার মধ্যে একটা বিরাট আতংকের সৃষ্টি হইল। মুসলমানরাও পালাইতে শুরু করলো, হিন্দুরাও পালাইতে শুরু করলো। তখন আমরা সাধারণত এই অঞ্চলের মানুষরা দিনের বেলা জঙ্গলে যাইয়া থাকতাম, গভীর জঙ্গলে অথবা বিল এলাকায় নৌকায় বা বিল এলাকার কোনো বাড়িতে যেখানে রাস্তাঘাট নাই। পাকবাহিনী সহজে যেতে না পারে সেইসব অঞ্চলেই মানুষ আশ্রয় বেশি নিয়েছে। বিশেষ করে সইকখালি বিল এলাকায়, কুরিয়ানার সেই পেয়ারাবাগানে তারপরে আউখবাগানে বিভিন্ন লোক দিনের বেলা যাইয়া থাকত। দিনের বেলা অনেকের বাড়িতেই অনেকের পেটেই খাওয়া জুটত না। তখন খাওয়া পাওয়া যেত না। অনেকেই খেতে পেতো না, না খেয়েও দিন কাটাতে হতো। ঘরের মধ্যে যা থাকত পাকবাহিনী, রাজাকাররা সব লুটতরাজ করে নিয়ে যেতো। তখন মানুষের খাওয়ারও খুব অভাব দেখা দিল। তবে তখন যার ঘরে যা ছিল সবাই মিলেমিশে খাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। কারণ আমাদের সবাইকে বাঁচতে হবে, বাঙালি আমরা সবাই এক। এই প্রবণতার জন্যই বাঙালিরা তখন বেঁচে গেছে।

প্র: যখন পাকবাহিনী প্রথম দিন এলো, তখন লোকজন কোথায় কিভাবে ছিল?

উ: লোকজন কেউ বাজারে গেছে, কোনো পুরুষ হয়তো কাজ করতে গেছে, মহিলারা রান্নাবান্না করতে গেছে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই পাকবাহিনী যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করে তখন কিছু যুবক আসিয়া খবর দিল। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে বাজার বন্ধ হয়ে গেল, রান্নাবান্না বন্ধ করে দিল এবং যারা শ্রমিক ছিল তারাও ফিরে আসল এবং সবাই ঘর ছেড়ে পালই গেল। কে, কোথায় পালাবে কারো জন্য কেউ চিন্তা ভাবনা করতো না। যে যেভাবে পার নিজের জীবন নিয়ে তখন পালাইতে চেষ্টা করছে। অনেক সময় দেখা গেছে যে, ঘরের মধ্যে তিনি চারজন ফ্যামিলির লোক তিন চার দিকে চলে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রাত আটটা দশটা বাজে কেউ ফিরে আসছে না, অনেকে হয়তো তাদের আশাই ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু পরে দেখা গেল যে, তারা গভীর রাতে আবার বাড়ি চলে আসছে। আবার ভোর বেলা যে যেখানে পারছে পালিয়ে গেছে।

প্র: এই সময় মেয়েছেলে যারা ছিল তারা কিভাবে পালিয়েছিল এবং তাদের তখন কোনা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল কি?

উ: মেয়েছেলেরা অনেক দূরে বিল অঞ্চলে, জঙ্গলে যাইয়া বসে থাকত দিনের বেলা, রাতের বেলা আবার ফিরে আসত। অনেকের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। অনেক জায়গায় দুষ্টুলোকের পাল্লায় তারা পড়েছে এবং তাদের সর্বস্ব লুটও হয়েছে। এ রকম ঘটনাও আমাদের চোখে পড়েছিল। পরবর্তীকালে তাদের অনেককে শায়েস্তাও করা হয়েছে।

প্র: আপনি মেয়েদের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা বলেছেন অর্থাৎ তাদের যে ইজ্জত, সেটিই নষ্ট হয়ে গেছে। এ রকমের ঘটনাগুলো কোন কোন এলাকায় বেশি ঘটেছিল?

উ: এটা সাধারণত কুরিয়ানা তারপরে গাবা-এইসব অঞ্চলগুলাতে বেশি হটেছে।

প্র: আপনার ধারণা এ রকম মেয়েদের সংখ্যা কত?

উ: মেয়েদের সংখ্যা সঠিক আমি বলতে পারব না। তবে পঞ্চাশ, ষাটজনের নাম আমার তখন জানা ছিল।

প্র: আপনার কি জানা আছে যে, এই সমস্ত মেয়েরা এখন কোথায়?

উ: এরা অনেকেই দেশে নাই। অনেকেই চলে গেছে ভারতে। কেউ হয়তো মারা গেছে। কারো হয়তো অনেক দূরে বিবাহ হয়েছে। আমার জানা মতে, এখন আর কেউ এখানে নাই। বলা বাহুল্য, এরা সবাই হিন্দু।

প্র: পাকবাহিনী যে সব লোকদের হত্যা করেছে-তাদের লাশগুলো নদীতে ভেসে যেতে দেখেছেন, জঙ্গলে ঝোপের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছেন, এই সমস্ত লাশগুলোর কি হাল হলো?

উ: দুই তিন দিন পরও দেখা গেছে, যে সমস্ত লাশ জঙ্গলে টঙ্গলে ছিল সেগুলোকে শৃগালে খেয়েছে, বিভিন্ন পশু পাখিতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। চারদিকে পঁচা গন্ধ ছুটে গেছে। ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় বহু লাশ পড়েছিল। এগুলো কেউ দাফনও করেনি, সৎকারও করেনি।

প্র: সে সমস্ত লাশগুলো আপনি পড়ে থাকতে দেখলেন তাদের মধ্যে আপনার পরিচিত বা আপনার চেনা জানা এ রকম কি কারোও নাম বলতে পারবেন?

উ: নাম ধাম কিছু বলতে পারবো না। তবে রমেশের লাশ আমি দেখছি। নারায়ণ ভুঁইয়া, সরোজ মাস্টারের লাশ, গোবিন্দের লাশ, তারপরে কেষ্ট বোসের বাড়িতে তার এক ভাই ও তার শাশুড়ির লাশ আমি দেখেছি। অনেক লাশই আমি দেখেছি তবে সব লাশের নাম আমার মনে নাই।

প্র: যে লাশগুলো আপনি দেখেছেন, সেগুলো কি অবস্থায় দেখলেন?

উ: আমি দেখছি কেউ গুলি খাওয়া, গুলি দিয়া মারিয়া রাইখা গেছে, পড়িয়া আছে জঙ্গলের মধ্যে। রক্ত জমাট হইয়া আছে। এ রকম লাশও আমি বহু দেখেছি আরকি। এক যায়গায় দেখেছি দড়ি বান্ধা অবস্থায়। খাল পাড়ে দড়ি বান্ধা অবস্থায়। দড়ি বান্ধিয়া তাদের সেখানে গুলি করিয়া হত্যা করা হইছে। দড়ি বান্ধা বহু লাশ দেখেছি।

প্র: আপনি বলছিলেন যে প্রথম এসেই তারা হিন্দু লোকজন খুঁজতো। এদের কেন খুঁজতো এবং কিভাবে চিহ্নিত করতো যে এই লোকটি হিন্দু অথবা মুসলিম?

উ: তাদের সাথে দুই-একজন লোক তো থাকত, দালাল আরকি। এরাই হিন্দু এলাকায় পাকবাহিনীকে নিয়ে আসতো এবং তারাই আইডেন্টিফাই করে দিত, কে হিন্দু এলাকায় পাকবাহিনীকে নিয়ে আসতো এবং তারাই আইডেন্টিফাই করে দিত, কে হিন্দু, কোনটা হিন্দু বাড়ি, কোনটা মুলমান বাড়ি। এভাবেই তাদের ধরতো আরকি। তারা অনেক সময় ছুরা জিজ্ঞাসা করতো কোরআন শরীফ থেকে। কেউ দুই একটা আয়াত বলতো এ বিষয়ে অনেক মজার কাহিনীও আছে। যেমন-বহু হিন্দুদের মুসলমান মনে করিয়া প্রথম অবস্থায় ছাড়িয়া দিছে। যারা কোরআন শরীফ থেকে দুই একটা আয়াত বলতে পারছে, সুরা বলতে পারছে-তাদের অনেকে ছাড়া পাইছে। নরের কাঠিতে গোপাল রায় করে এক ভদ্রলোক ছিলেন। বর্তমানে সে বেঁচে নেই। উনাকে ধরিয়া নিয়া রওনা হইছে পাকবাহিনী। হঠাৎ পাকবাহিনীর এক সৈনিক খালে পড়িয়া গেলে ঐ ভদ্রলোক লাফাইয়া পড়িয়া ঐ সৈনিকরে নদী থেকে উদ্ধার করছে। তখন তারা তার প্রতি সদয় হইয়া তারে ছাইড়া দিছে। এর রকম ঘটনাও ঘটছে দুই একটা। অনেক সময় নেংটা কইরা তারা দেখত। উলঙ্গ করিয়া হিন্দুদের পরীক্ষা করতো-এ রকম ঘটনাও আছে।

প্র: আপনার পরিবারে কেউ শহীদ হয়েছে কি? কিভাবে শহীদ হলো?

উ: আমার পরিবারে আমার ছোট ভাই শহীদ হয়। বানারীপাড়ার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক এবং সে চাখার কলেজে বি. এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল। সে একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিল এবং খুব সাহসী ছিল। তিনি যখন দেখলেন যে, নজরুল ওসি এবং তার দোসর আলি মিয়া এবং অন্যান্য লোকজন এখানে অত্যাচারে অতিষ্ঠ করে তুলছে, তখন থানা আক্রমণ করার জন্য সে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য বাবুগঞ্জে গিয়েছিল। তার সাথে ছিল আলেকান্দার নজরুল। সেখানে তারা এক রাজাকারের খপ্পরে পড়ে। তারা বুঝতে পারেনি যে, অর্তকিত তাদের ওপর আক্রমণ হবে। তাদের দু’জনকে রাজাকাররা রহমতপুর পুলের কাছে কৌশলে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাদের হত্যা করা হয়।

প্র: রাজাকারের নাম কি আপনার জানা আছে?

উ: রাজাকারের নাম আমার জানা আছে। কিন্তু তার নাম বলতে এখনও আমার ভয় করে, সে হলো বাবুগঞ্জের এক দারোগা। সে বড় বড় লোকের আত্মীয়। কাজেই তার নাম না বলাটাই, প্রকাশ না করাটাই এখনও আমার পক্ষে মঙ্গল হবে। আমি এখনও ভয় পাই। যে কোনো অজুহাতে তারা হয়তো আবার একটা ষড়যন্ত্র করে আমাকে শেষ করে দিতে পারে।

প্র: আপনার এলাকায় কখন থেকে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়? তখন মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি ছিল?

উ: আমাদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয় বরিশার পতনের পরে। বরিশালের যখন ২৬শে এপ্রিল পতন ঘটলো, তখন বরিশাল থেকে হাজার হাজার লোক এ অঞ্চলে পালিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন বেগ, মেজর মিয়া, জলিল এবং আরো কিছু লোক আসিয়া কুরিয়ানাতে আশ্রয় নেয়। এই কুরিয়ানাতে বসিয়াই প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং শুরু হওয়ার পরে বানারীপাড়া থেকে বেশ কিছু যুবক সেখানে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে। এই অঞ্চলের মধ্যে প্রথমে কুরিয়ানাই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে গাবাতে ক্যাম্প হয়। এই গাবা ক্যাম্পেই আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম-তারা গাবা ক্যাম্প পরিচালিত করেছি এবং গাবা ক্যাম্পেই আমরা ছিলাম। গাবা ক্যাম্প থেকে বানারীপাড়া, কুরিয়ানা বিভিন্ন জায়গায় আমরা আক্রমণ করতাম। সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আটঘর কুরিয়ানায় ট্রেনিং শুরু হয়। এরা ছাড়াও কিছু কিছু ছেলেরা বরিশাল থেকে আসার পরে কিছু অস্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। তারা অনেক অস্ত্র যখন সংগ্রহ করে ফেলে তখন সে অস্ত্র নিয়ে তারা নিজেরাই দল গঠন করে। যেমন-বানারীপাড়া দলটা সংগঠিত হইছিল বরিশাল পতনের পরে।

প্র: আপনার এলাকায় কোন কোন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল?

উ: আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্প ছিল গাবা বুড়ির বাড়ি করিয়া একটা বাড়ি ছিল সেখানে। জঙ্গলের মধ্যে ছোট একটা বাড়ি। সেখানে প্রথম আমরা সংগঠিত হই। পরবর্তীকালে গাবা কমলা চৌধুরীর বাড়িতে, বিল্লু বাড়িতে আমাদের ক্যাম্প ছিল।

প্র: এ ছাড়া বানারীপাড়ায় আর কোথাও কি বা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল?

উ: ক্যাম্প ছিল না, তবে অস্থায়ীভাবে আমরা বিভিন্ন জায়গায় যাইয়া আশ্রয় নিতাম। যেমন-সৈয়দকাঠিতে আমাদের একটা ক্যাম্প ছিল। ওখানে আমরা যাইয়া মাঝে মাঝে আশ্রয় নিতাম। জয়কাঠিতে একটা ছিলো এক বাড়িতে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা থাকতাম ওখানে। অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। সৈয়দকাঠিতে মাখন করে এক লোক আছে। মাখন হাওলাদার। তার বাড়িতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যাইয়া আশ্রয় নিতাম এবং সেখান থেকে আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়তাম। আরেকটা ছিল বাইশালিতে, বাইশালির শেষ প্রান্তে একটি বাড়ি, সেটাও এক হিন্দু বাড়ি। বাড়িটার মালিকের নাম আমার ঠিক মনে নাই। ও বাড়িতেও আমরা ক্যাম্প করেছিলাম।

প্র: আপনারা এই যে ক্যাম্প করেছিলেন, এই সমস্ত ক্যাম্পগুলোতে কয়টি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ছিল এবং এই মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে কে কে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা লিডার হিসাবে কাজ করেছেন?

উ: আমরা যে ক্যাম্পে ছিলাম, বানারীপাড়া থানার মূলত দায়িত্বে ছিলেন বেণীলাল দাসগুপ্ত। বেণীলাল দাসগুপ্ত ছিলেন একজন শিক্ষক। বেণীলাল দাসগুপ্ত এবং আমি যৌথভাবে দল পরিচালনা করতাম। মিলিটারি পার্টের কমান্ডার ছিলেন একজন, তার নাম কাদের কমান্ডার। এই কাদের কমান্ডারের আন্ডারেই মুক্তিযোদ্ধারা থাকত এবং যুদ্ধ করতো। আরেক ছেলে ছিল খুব ভাল, তার নাম ছিল রাশেদ। তার বাড়ি ছিল ডহড়পাড়া। তিনিও কিছুদিন ক্যাম্পের চার্জে ছিলেন। কিন্তু তিনি পাকবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পরে এই কাদের কমান্ডার এখানে ক্যাম্প পরিচালনা করে। আরো অনেক কমান্ডার ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে, ইন্ডিয়া থেকে যারা ট্রেনিং প্রাপ্ত হইয়া আসছেন, তারাও আমাদের সাথে ছিল। চার পাঁচটা গ্রুপ ছিল আমাদের।

প্র: যুদ্ধের শেষে গ্রামে ফিরে কি অবস্থা দেখলেন? আপনার গ্রামের স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, ব্রিজ, বাড়িঘরের অবস্থায় কি দেখলেন?

উ: আমরাতো গ্রাম দেশেই ছিলাম। দেশে থাকার কারণে সমস্ত ঘটনাই আমরা জানতাম। যুদ্ধের পরে দেখা গেল অনেক বাড়িতে ঘর নেই। অনেকের ঘর-দরজা ভেঙ্গে নিয়ে গেছ। ঘর-বাড়ি পুড়াই দিয়েছে। মন্দির বলতে কোনো মন্দিরই ছিল না। সব মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। বানারীপাড়াতে একটা সুন্দর মন্দির ছিল তার পাথর পর্যন্তও তারা নিয়ে গেছে। বড় বানারী বাড়িতে একটা বিরাট মন্দির ছিল। সেই মন্দিরের প্রতিমা তারা লুট করে নিয়ে গেছে। মন্দির বেশি ক্ষতি হয়েছিল। স্কুলের তেমন ক্ষতি হয়নি।

প্র: আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোন কোন এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন?

উ: আমি তো মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের অর্গানাইজ করতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত করতাম। যে সমস্ত এলাকায় আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি তারমধ্যে শর্ষীনার যুদ্ধ। সেখানে আমি অংশ নেই। সেই যুদ্ধে একটা ছেলে, খুব ভাল ছেলে শহীদ হয়েছে তার নাম মতি গাজী। তাছাড়া বানারীপাড়া থানা দুই তিনবার আক্রমণ হইছে, সেখানেও আমি ছিলাম। মূলত বানারীপাড়ায় এবং শর্ষীনায় এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। স্বরূপকাঠি, বানারীপাড়া এবং সবশেষ উজিরপুরে পাকবাহিনীর সাথে একটা যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধেও আমি অংশগ্রহণ করেছি।

প্র: সর্বশেষ উজিরপুরে পাকবাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধে আপনি অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই যুদ্ধের কিছু কি আপনি বলবেন?

উ: পাকবাহিনী যখন বরিশালে সারেন্ডার করলো তখন কিন্তু উজিরপুরে পাকবাহিনী স্যারেন্ডার করেনি। তারা বাংকারের মধ্যেই ছিল। ক্যাম্পে ছিল। সেখানে আমরা আক্রমণ করেছি, গোলাগুলি করেছি প্রচন্ডভাবে। কিন্তু তারা কোনো অবস্থাতেই সারেন্ডার করবে না। তারা জানালো যে তারা বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জু এবং মেজর জলিল-এর কাছে সারেন্ডার করবে। তারা ক্যাম্পটাকে বহুদিন দখল করে রাখে। সেখানে মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ হতো। তারাও গোলাগুলি করতো, আমরাও গোলাগুলি করতাম। তবে সেখানে কেউ হতাহত হয়নি।

প্র: আপনারা বানারীপাড়া থানা কত তারিখে আক্রমণ করেছিলেন এবং থানা কত তারিখে মুক্ত হয়েছিল?

উ: বানারীপাড়া থানা তিনবার আক্রান্ত হয়। প্রথম বার জুন মাসের ৬ তারিখ, দ্বিতীয় বার আক্রমণ হয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এবং সর্বশেষ আক্রমণ হয় নভেম্বর মাসের ২৪ তারিখ। মুক্ত হয় ২৪ তারিখ, চব্বিশে নভেম্বর। এরপরে-বানারীপাড়ার ওসি যুদ্ধচলাকালীন সময়ের পরে ঝালকাঠিতে বদলী হয়ে যায়।

প্র: যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বানারীপাড়া থানার ওসির যে তান্ডব সে প্রসঙ্গে কি জানেন বলুন?

উ: বানারীপাড়ার ওসি প্রায়ই লঞ্চে পুলিশ নিয়া দিনের বেলা বের হতো। সে ফোর্স নিয়া ডানডোয়া, গলদা, বাইশালি এবং বানারীপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় হানা দিত। সে মেয়েছেলেকেও হেরাই দেয় নাই, তাদেরকে পিডাইতো। বুড়া মানুষ তাগোও মারত এবং লুটতরাজ করে টাকা পয়সা নিয়া যাইতো। যুবকদের যদি পাইত তাইলে তো সে তাদেরকে মেরে ফেলত। মেয়েছেলের উপর যে শারীরিকভাবে লাঞ্জনা দিয়েছে, অত্যাচার করেছে। তার অত্যাচারে বানারীপাড়াতে অনেক লোকই নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেক বাড়িঘরের টাকা পয়সা ধন-সম্পদ সে নিয়ে গেছে। এই লোকটা অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে আবর চাকরি পেয়েছে যা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের এবং অপমানের।

প্র: আপনার গ্রাম বা এলাকার কোন কোন জায়গায় ব্যাপক হত্যাকান্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হয়েছে? এ সব কারা করেছে?

উ: আমাদের এলাকায় বেশি লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ হয়েছে কুন্দিদিয়ার, গাবা, বাইশালি এবং নলছিটি গ্রামে। এগুলার অধিকাংশই হয়েছে রাজাকারদের সহযোগিতায়। এই রাজাকাররা পাকবাহিনীদের লিড করেছে। এ ছাড়া স্থানীয় ও.সি নজরুল রাজাকারের নেতৃত্বে এগুলা বেশি হয়েছে।

প্র: যুদ্ধ করতে গিয়ে কে কোথায় শহীদ হয়েছেন?

উ: যুদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের মতি গাজী বলে এক ছেলে ছিল, সে শহীদ হয়েছে শর্ষীনাতে। আমার ভাই বিমল কৃষ্ণ শহীদ হয়েছেন বাবুগঞ্জে, কাজী দেলোয়ার হোসেন শহীদ হয়েছেন পাকবাহিনী যেদিন বানারীপাড়া আক্রমণ করে সেদিন, এনায়েত করে এক ছেলে, সে আলতা ক্যাম্পে শহীদ হইছে, জাফর বলে এক ছেলে সেও শহীদ হইছে। এ রকম বহু লোকই স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন।

প্র: আপনার হিসেব মতে কতজন লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন?

উ: আমাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে অস্ত্র হাতে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে সাত জন।

প্র: কোনো স্কুল বা কলেজ শিক্ষক শহীদ হয়েছেন কি?

উ: পাকবাহিনীর হাতে গাবা স্কুলের এক শিক্ষক শহীদ হয়েছেন তার নাম সুখরঞ্জন।

প্র: এই সময় পাকবাহিনীর হামলায় বা অপারেশনে এলাকার কত সংখ্যক লোক তাদের বাড়িঘর হারিয়েছে?

উ: বাড়িঘরতো বহুলোকে হারাইছে। যেমন-বানারীপাড়ার সমস্ত বাজারটা। বাজারের দুটো ঘর বাদে আর কোনো ঘরই ছিল না। বাজারে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরে বাড়িঘরও বেশ পুড়ছে। বাড়িঘর গাবা, বানারীপাড়া মিলায়ে দুই তিন’শ নষ্ট হইছে। পুড়িয়ে ফেলছে। আর লুটতরাজ হইছে বহু বাড়ি। প্রত্যেক বাড়িরই মালপত্র, ঘরের খুটি, কাঠ, ঘরের টিন সব নিয়ে গেছে।

প্র: কাদের বাড়িঘরগুলো লুট হইছে?

উ: প্রথম হয়েছে হিন্দুদের বাড়িতেই বেশি। হিন্দু এলাকাতেই বেশি অত্যাচার হইছে। পরে মুসলমানদেরও হইছে।

প্র: আপনার সাথে কে কে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

উ: আমার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বেণীলার দাসগুপ্ত। তারপর রঞ্জিত ছিলো, সাত্তার, ফজলু, লোকমান সহ আমরা আড়াই’শ ছিলাম প্রায়। সবার নামতো আমার মনে নাই।

প্র: যুদ্ধের শেষে আপনার অস্ত্রটি কি করলেন?

উ: আমাদের অস্ত্রতো ইনডিভিজুয়াল অস্ত্র ছিল না। এগুলো ছিল আমাদের ক্যাম্পে। আমাদের ক্যাম্পে যে সমস্ত অস্ত্র ছিল সব অস্ত্র আমরা পিরোজপুরে গিয়ে এসডিও অফিসে কমা দিয়া আসি।

প্র: যুদ্ধ শেষে আপনি কি করলেন?

উ: যখন বাংলাদেশ বেতার মারফত সংবাদ আসল যে, যার যার কাজে যোগদান করতে হবে-আমরা তখন আবার শিক্ষকতা শুরু করলাম। বানারীপাড়াতে আমি আবার আমার শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হলাম।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : নিরঞ্জন দাশগুপ্ত অনু

তারিখ : ১৫ আগস্ট ১৯৯৬

Leave a Reply

x

Check Also

কাউখালীতে কৃষকের মাঝে শষ্যবীজ ও সার বিতরণ

কাউখালীপ্রতিনিধি: পিরোজপুরের কাউখালীতে দুই হাজার ২০০ প্রান্তিক কৃষকের মাঝে সার ও শষ্যবীজ বিতরণ করা হয়েছে। ...