ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - যুদ্ধবিধবা

যুদ্ধবিধবা

দেবদাস মজুমদার >

মুক্তিযুদ্ধ আমায় বিধবা করেছে। স্বামীর জীবন কেড়ে নিয়েছে। সদ্য বিবাহিতা এক নারীর জীবনে এর চেয়ে বেদনার আর কি আছে। মাঝ রাইতে ঘুমন্ত স্বামীরে ওরা টাইনা হিচড়াইয়া নিয়ে গেল। তারপর খাল পাড়ে তার দুই হাত বাইন্ধা পিটাইয়া আধমরা করল। আধমরা মানুষটারে ওরা গুলি দিয়া মাইরা লাশ খালে ফালাইয়া দিল। আমার জীবনের ওই বেদনার রাইতের দুইদিন পর স্বামীর ফুলে ওঠা লাশ জোয়ারে আবার খালের ঘাটে ফিইরা আইলো। স্বামীর লাশ সমাধি দেওয়ার মত হেইদিন গায়ে আর কেউরে পাইলাম না। হেরপর লাশ ময়না তদন্ত করানোর কথা কইয়া নৌকায় কইরা থানায় নিয়া গেল। হুনছি থানা দিয়া লাশ জেলা শহরে নিয়া গেছে। এর পর স্বামীর লাশ আর বাড়ি ফেরত আসেনাই। আইজ অবধি । স্বামীর লাশ নিজের ভিটায় সমাধি দিতে পারলাম না। দেশ স্বাধীন হইল আমার বিধবার জীবন শেষ হয় নাই। এই জীবনে আমি মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর মরনের বেদনা নিয়া কি করে আর নতুন সংসার করি। সেই থেকেই তো বিধবা আছি,একা আছি । মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাতায়াত আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগের অপরাধে আমার স্বামীরে ওরা মারছে। এই জীবন বিসর্জণের কথা দেশের খাতাপত্রে নাই। মুক্তিযুদ্ধ তো আমারে স্বামী ও সংসার হারা করছে। কষ্ট একটাই শ্যাষ জীবনে আইসা স্বামীর জীবন দানের স্বীকৃতি পাইলাম না। কেউ খোঁজও নিলনা আমার !

মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামী নির্মল মিস্ত্রীকে হারানোর বেদনায় আজও কাদছেন বিধবা শোভা রানী মিস্ত্রী(৬২)। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মিরুখালী ইউনিয়নের ছোট হারজী গ্রামের সদ্য বিবাহিত যুবক নির্মল মিস্ত্রীকে ১৯৭১ সালে ১৭ অক্টোবর দিবাগত রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় টেনে হিচড়ে তুলে নিয়ে যায় স্থানীয় একদল রাজাকার বাহিনী। তারপর তাঁকে বাড়ির খাল পাড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে বেদম পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এরপর ওই অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ভাসিয়ে দেয় স্বাধীনতা বিরোধিরা। এমন অবস্থায় সেই রাতে প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছেড়ে নববধূ শোভা রানী স্বামীর ভিটা ছেড়ে পালিয়ে পাশ্ববর্তী বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনীয়া গ্রামে বাবার বাড়ি আশ্রয় নেন। অকালে স্বামীহারা হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিধবা শোভা রানী মিস্ত্রী বেচে থাকার জন্য আজও লড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ তার স্বামীকে কেড়ে নেওয়ায় আর কোন সংসার করেননি। আজীবন বৈধব্য কাটছে তার। বার্ধ্যক্যের ক্রান্তিকালে এসে এখন সে একা এক অসহায় নারী। শরীরে নানা রোগ বাসা বেধেছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর জীবন দানের স্বীকৃতি পেতে গত ৪৫ বছর ধরে চেষ্টা কম করেননি। ধর্ণা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ নানা ব্যক্তির কাছে। অনেকে সরল অসহায় বিধবার কাছ থেকে স্বামীকে শহীদের তালিকায় নাম উঠিয়ে দেবে এমন আশ্বাসে টাকা পয়সাও হাতিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। তবে আজও স্বামীর জীবন দানের স্বীকৃত না মেলায় এখন তিনি হতাশ।

শোভা মিস্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন,মুক্তিযুদ্ধ আমায় বিধবা করে দিল। দেশের জন্য স্বামীর মরনের কথা ভেবেই এই জীবনে আর নতুন সংসার করিনি। না হল সংসার না পেলাম স্বামীর জীবনদানের স্বীকৃতি। জীবনের শেষ বেলায় এসে স্বীকৃতিটুকু নিয়ে এখন মরতে চাই।

তিনি জানান,১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মঠবাড়িয়ার মিরুখালী ইউনিয়ন বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে ওঠে। ছোটহারজী গ্রামের বিপীন মিস্ত্রীর ছেলে নির্মল মিস্ত্রী সেখানে যাতায়াত শুর করেন। এলাকার খবরা খবর ক্যাম্পে পৌছানো ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুবক নির্মল মিস্ত্রীর সখ্যতা গড়ে ওঠার বিষয়টি টের পায় এলাকার রাজাকার বাহিনী । রাজাকার বাহিনীর হুমকিতে প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছেড়ে এক নিকট আত্মীয়র সহায়তায় পার্শ্ববর্তী বামনা উপজেলার বুকাবিুনীয়া গ্রামের মিস্ত্রী বাড়িতে আত্মগোপন করেন। এক পর্যায় ওই বাড়ির মহিম মিস্ত্রীর কিশোরী কণ্যা শোভা রানীর সাথে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। মুক্তিযুদ্ধে নিরাপত্তাহীন এক কণ্যা দায় গ্রস্থ বাবা মহিম মিস্ত্রী মেয়েকে পাত্রস্থ পেরে কিছুটা হাফ ছেড়ে বাচেন। এরপর এলকার কয়েকজন মাতুব্বরের নিরাপত্তার আশ্বাসে নব দম্পতি নির্মল ও শোভা ছোট হারজী গ্রামের বাড়ি ফিরে নতুন সংসার শুরু করেন। কিন্তু এত শেষ রক্ষা হয়না। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর দিবাগত রাত ১১টার দিকে সশস্ত্র একদল রাজাকার নির্মলের ঘরে হানা দেয়। তারা ঘুমন্ত নির্মলকে বিছানা থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়। তারপর খালের পাড়ে দড়ি দিয়ে বেধে পিটিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ভাসিয়ে দেয়। দুইদিন পড়ে নির্মলের লাশ আবার জোয়ারে ভেসে ঘাটে ফিরে আসে। লাশ সমাধিস্থ করার মত কোন লোক না পাওয়ায় লাশ ময়না তদন্তের কথা বলে সেদিন মঠবাড়িয়া থানায় নেওয়া হয়। লাশ আর ঢেরত পায়নি নিহত নির্মলের স্বজনরা। এরপর বেচে থাকার জন্য বিয়ের চার মাসের মাথায় সদ্য বিধবা শোভা রানীকে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় সেই অবধি তিনি সেখানেই আছেন। তবে আর সংসারী হননি। মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর এ জীবন দানের প্রতি সম্মান জানাতেই আর বিয়ে করেননি তিনি। এখন ৬২ বছরের বার্ধক্য জীবনে এসে বিধবা শোভা মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর জীবন দানের স্বীকৃতির আশা করছেন।মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর জীবন বিসর্জণে শহীদ স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে বিধবা শো রানী আক্ষেপ করে বলেন, আবেদন করেও কোন সাড়া পাইনি । এখন হতাশা নিয়েই মরতে হবে !

মিরুখালী ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রমেশ চন্দ্র শীল বলেন,নির্মল মুক্তিযুদ্ভের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য মিরুখালী ক্যাম্পে যাতায়াত করত। এ কারনে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর রোষানলে পড়ে। এক রাতে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সামনে থেকে ঘৃুমন্ত নির্মলকে রাজাকার বাহিনী তুলে নিয়ে হত্যা করে। এরপর তার বিধবা স্ত্রী গ্রাম ছাড়েন। তিনি আজ অবধি আর সংসার করেননি। কিন্তু নিয়তি কি পরিহাস আজও নির্মলের জীবনদানের স্বীকৃতি মেলেনি। এ দায় আমাদের সবার।

এ ব্যাপারে মঠবাড়িয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বলেন,মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নির্মলকে যেভাবে রাজাকার বাহিনী হত্যা করেছে তা অমানবিক। তবে নির্মলের বিধবা স্ত্রী পরিবারের পক্ষ হতে শহীদের তালিকায় নাম ওঠানোর কোন চেষ্টা ছিলনা বলে বিষয়টি চাপা পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগের কারনেই রাজাকারা নির্মলকে হত্যা করেছে। তার নাম শহীদের তালিকায় ওঠার দাবিদার। সেই সাথে নির্মলের বিধবা স্ত্রীর জীবনভর ত্যাগের বিষয়টিও আমাদের মানবিক বিবেচনায় নিতে হবে।

Leave a Reply

x

Check Also

লাইটার জাহাজের ধাক্কায় চরখালী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে বিধ্বস্ত 🔴 যানবাহন চলাচল বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কঁচা নদীর চরখালী-টগরা ফেরিঘাটের চরখালী ঘাটে একটি জাহাজের ধাক্কায় ফেরির ...