ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - যুদ্ধজয়ী হাসেম মাঝির পরাস্ত জীবন

যুদ্ধজয়ী হাসেম মাঝির পরাস্ত জীবন

 

দেবদাস মজুমদার >

বয়সের ভারে এখন নতজানু আবুল হাসেম মাঝি। তারুণ্যে দেশের জন্য লড়াই করেছেন। যুদ্ধজয়ী এ সংগ্রামী এখন জীবন যুদ্ধে পরাজিত। চরম দারিদ্র,অনটন আর রোগে শোকে বিপর্যস্ত এই মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এই দেশ মাতৃকার টানে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে জীবন বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । স্বাধীনতা বিরোধীদের পরাস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলার বিজয়। যুদ্ধজয়ী এ মুক্তিযোদ্ধার অর্থনৈতিক মুক্তি আজও মেলেনি। জীবনযুদ্ধে পরাস্ত এক সৈনিক হাশেম আলী। জীবিকার তাগিদে গ্রাম্য হাট বাজারে সালসা বিক্রি করে চলছে তাঁর রুটি রুজি। আট সদস্যের পরিবারের পেটে ভাত জোগাতে তিনি এখন পথের দোকানী। ভূমিহীন আর গৃহহীন জীবনে নিজের ঘর নাই । তবে ঠাঁই মিলেছে আবাসনের ঘরে। এলাকার মানুষ যুদ্ধজয়ী হাসেম মাঝিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনলেও আজও রয়েছেন তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতিহীন। devdas-pic-hsaem-1
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার শিয়ালকাঠী ইউনিয়নের জোলাগাতী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম হাওলাদার এলাকায় পরিচিতি হাশেম মাঝি নামে । মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে নৌকার মাঝি ছিলেন হাশেম। সে কারনে এ জনপদের মানুষ এখনও তাকে মাঝি বলেই চেনে। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই চেনেন ও জানেন।

সোমবার সাপ্তাহিক হাটে কাউখালী শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে সালসা বিক্রর সময় কথা হয় তাঁর সাথে। এসময় তিনি জানান, কাউখালী উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বিড়ালজুড়ী আবাসন প্রকল্পে অস্থায়ীভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। স্ত্রী, চার কন্যা ও দুই ছেলেসহ আট সদস্যের পরিবার তাঁর। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য তিনি বেছে নেন গ্রাম্য কবিরাজি পেশা। গ্রাম্যহাট বাজারে সালসা বিক্রির কাজ করেওে মাঝি নামটার আজও বদল হয়নি তার। হাটে বাজারে পথের ধারে সালসা বিক্রি করে যা রোজগার হয় তা থেকেই চলে তার সংসার।

তিনি জানান,১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউদ্দিন (অবঃ) নয় নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার যার নেতৃত্বে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই বীর সেনা। ১৯৭১ সালে তিনি সুন্দরবনে বনশ্রমিকের কাজ করতেন। তৎকালীন নয় নম্বর সেক্টর ছিল নদীবহুল এলাকা। নদীনালা ও অসংখ্য খাল বিল মাকড়শার জালের মতো বিস্তৃর্ন ছিল এই সেক্টর। সড়ক পথের ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। এখানে যুদ্ধের ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল একমাত্র নৌপথ। বর্ষাকালে নদ নদীগুলো ধারনকরত ভয়ংকর দৈত্যের মতো রূপ। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নৌপথে চলাচলের জন্য ভাল পথ ঘাট চেনা দক্ষ মাঝির প্রয়োজন পড়ে। যিনি অস্ত্র গোলাবারুদ সহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিরাপদে পৌঁছে দিবেন। সে সময় এ রকম একজন মাঝি পাওয়া খুবই দুস্কর ছিল। ঠিক তখনই মেজর জিয়া উদ্দিন তাকে নির্বাচিত করলেন। হাশেম মাঝির সুন্দরবন ও বরিশাল সহ দক্ষিণ উপকুলের জলপথ ছিল যার নখদর্পনে। তারপর আবুল হাশেম নৌকার মাঝি পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।

একদিন হাসনাবাদ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রের চালান নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন সুন্দরবন অভিমুখে। তখন ঘোর বর্ষাকাল, প্রমত্তা নদী। ঘোর অন্ধকার রাত নদীর মাঝপথে শুরু হয় উথাল পাথাল ঢেউ সেই সাথে ঝড়ের তা-ব। বাংলার অগ্নি সন্তান হাশেম মাঝি শক্ত করে নৌকার হাল ধরেন। তুমুল বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকানোর মাঝে হঠাৎ মাঝ নদীতে পাক সেনাদের গানবোট দেখতে পেয়ে চমকে উঠেন নৌকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। মূহূর্তেই পাক সোনাদের মেশিন গানের গুলি এসে হাশেম মাঝির হাতে লাগে। গুলিতে আঙুল উড়ে যায়। তবু রক্ত জখমমের হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেন নৌকার হাল। পাক সেনাদের গুলি তখনও থামেনা। তখন মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাল্টা গুলি চালায়। কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় পাক বাহিনীর আক্রমন। কয়েক ঘন্টা বিপদ সংকুল অবস্থা কাটিয়ে হাসেম মাঝির নৌকা পৌছায় ক্যাম্পের নিকট। এরপর জ্ঞান হারায় হাশেম মাঝি। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন অঞ্চলে নৌপথে মুক্তিবাহিনী ও অস্ত্র বহন করতেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌপথে যাতায়াত চলত হাশেম মাঝির নৌকায়। এই সত্য ইতিহাস এ জনপদে স্বীকৃত । তবু হাসেম মাঝি রাষ্ট্রের খাতাপত্রে মুক্তিযোদ্ধা আজও নন!
দেশ স্বাধীনের পর হাশেম খুলনা ও মংলায় শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা শুরু করেন। গত ১৬ বছর আগে তিনি কাউখালীতে ফিরে আসেন। নিজের জমি ও ঘর না থাকায় শুরু হয় তার বস্তি জীবন। ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিপন্ন হাসেম গৃহহীন হয়ে পড়েন। সিডর পরবর্তী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সন্ধ্যা নদী তীরবর্তী বিড়ালঝুড়ি আবাসন প্রকল্পে মাথা গোজার একটু ঠাঁই মেলে তাঁর ।
হাশেম আলী আক্ষেপ,যুদ্ধের ময়দানে আছিলাম। সবাই তা জানে তবু মুই মুক্তিযোদ্ধা না ! ল্যাহা(লেখা) পড়া না জানার কারনে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তবু আইজও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় মোর নাম ওডলো না। এই দুঃখ কওনের মানুষ পাইলাম না।

এ ব্যাপারে কাউখালী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মো. হারুন আর রশীদ সাইদ বলেন, হাসিম মাঝি আবেদন করেছেন কিনা আমার জানা নেই। তবে হাশেম মেজর জিয়া ভাইয়ের সাথে ছিলেন তাঁর উচিত ছিল এত দিনে হাসেমকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত করা।

এ বিষয়ে কাউখালী উপজেলা নির্বাহী লাবনী চাকমা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, হাসেম মাঝি আবেদন করেছেন। তার যাচাই বাছাই বিষয়ে গত দুই দিন আগে আমার দপ্তরে কাগজপত্র এসেছে। তবে যাচাই বাছাই কমিটি গঠন পরবর্তী তার বিষয়টা সমাধান করা হবে।

প্রসঙ্গত ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হোসেন বীরপ্রতীক উপকুলীয় অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কাউখালী ও ধানসিঁড়ি বাঁকের মুক্তিযুদ্ধ নামে প্রকশিত ওই বইয়ের ৪৫ পৃষ্ঠায় হাশেম মাঝির সচিত্র একটি প্রতিবেদন লেখেন তিনি। ও মাঝিরে – শিরোনামে হাশেম মাঝির মুক্তিযুদ্ধকালীন সুন্দরবন অঞ্চলে তাঁর অবদানের বিশদ বর্ননা দেওয়া হয়েছে ওই গ্রন্থে।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...