ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - সঞ্জীব রায়ের ইতিহাস সংগ্রহশালা

সঞ্জীব রায়ের ইতিহাস সংগ্রহশালা

খালিদ আবু, পিরোজপুর >>
সঞ্জীব রায়। পেশায় তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। কিন্তু নেশা হল মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ছবি ও নানা ধরণের বিচিত্র তথ্য সংগ্রহের। আগামি প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস তুলে ধরতে প্রায় দুই যুগ ধরে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বিভিন্ন ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছেন । মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রায় ৫ শতাধিক দুর্লভ ছবি রয়েছে এখন তার সংগ্রহ শালায়। এসব ছবি এ্যালবামে সংরক্ষণ করে এলাকার স্কুল-কলেজে প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন প্রজণে¥র কাছে তুলে ধরা হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা আলোকচিত্র। এছাড়া নিজের বসবাসের ঘরটিও একটি সংগ্রহ শালায় পরিণত করেছেন। ফলে বাড়িটি এখন দর্শনীয় হয়ে উঠেছে দিন দিন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই আলোকচিত্র সংগ্রাহক হচ্ছেন, পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কালিকাঠি গ্রামের জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়ের পুত্র সঞ্জীব রায়।
সঞ্জীব রায়ের বাসভবনের সংগ্রহ শালায় ঘুরে জানা গেছে, নাজিরপুর ইউনিয়ন একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক সঞ্জিব রায় শিক্ষকতা করার সুবাদে নাজিরপুর সদরে একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। গত ২৬ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। শিক্ষকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য পর পর ৫ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এ বছরও ২০১৭ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। একদিকে যেমন শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তেমনি সাংবাদিকতায়ও বিশেষ অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। দেশের অনেক বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে । যুগান্তর, সমকালসহ অসংখ্য পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন তিনি। শিক্ষকতাসহ নানা সংগঠন ও পেশার সাথে জড়িত থেকেও এখনো সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে আঁকড়ে রেখেছেন।

পাশাপাশি গত দুই যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রায় ৫ শতাধিক দুর্লভ ছবির এ্যালবাম তৈরি করে বাড়িতে একটি বিশাল সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। এসব ছবি এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রদর্শনীর মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে এ প্রজণে¥র শিক্ষার্থীদের মাঝে। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধের আলোকচিত্র নয়,এর বাইরেও সঞ্জীব রায়ের সংগ্রহ শালায় পৃথিবীর সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের নানা কর্মকান্ডের ছবি সম্বলিত তালিকা রয়েছে। নোবেল বিজয়ীদের তথ্য ও নানা অজানা বিষয় রয়েছে এই সংগ্রহ শালায়। এছাড়া বিশ্বের শীর্ষ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসসহ নানা তথ্য সমৃদ্ধ এ্যালবাম রয়েছে এখানে। বিখ্যাত সব লেখকদের গ্রন্থ সম্ভারও রয়েছে এই সংগ্রহ শালায়। কি নেই এই সংগ্রহ শালায়? পৃথিবীর সব ইতিহাস যেন হাতের নাগালে। সব মিলিয়ে এলাকাবাসির কাছে সঞ্জীব রায়ের বাসভবনটি এখন একটি যাদুঘরে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অনেকেই ছুটে আসছেন এখানে। কেউ আসছেন বই পড়ার নেশায় আবার কেউ আসছেন ইতিহাস জানতে অথবা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আলোকচিত্র দেখতে।
সঞ্জীব রায় তাঁর এই সংগ্রহশালার কথা বলতে গিয়ে স্বচোখে দেখা একাত্তর সালে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নানা নির্মতার কাহিনী তুলে ধরেন। যুদ্ধের সময় তিনি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তার পিতা জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় ও গ্রামের ২৩ জন নীরিহ লোকদের পাকবাহিনীর দোসররা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিলো তাদের উপর। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও অনেক অবদানের কথা জানান তিনি। সেদিন তার পিতা ও গ্রামের লোকজনকে উদ্ধার করতে কিশোর সঞ্জীব রায় ছুটে গিয়েছিলেন অনেকের কাছে। বহুলোকের দ্বারস্থ হয়ে অনেক আকুতি-মিনতি করে অবশেষে সেদিন তার পিতাসহ অন্যদের উদ্ধার করে এনেছিলেন। কিশোর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই বিভীশিখাময় মুহূর্তগুলি তাঁর মনে দারুণ ভাবে দাগকেটেছিলো। সেসব স্মৃতি যেন এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ফলে আর থেমে থাকেননি তিনি। মুক্তি যুদ্ধের নানা তথ্য-উপাত্ত ও আলোকচিত্র সংগ্রহে নেমে পড়েন অনেক আগে থেকেই। প্রায় ২ যুগ ধরে এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘুরে ফেরেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ২৫ মার্চের কালোরাত্রির সেই গণহত্যার ভয়াবহতাসহ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের নৃশংসতার অনেক আলোকচিত্র রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়া দেশের প্রায় সবকটি বধ্যভূমির ছবিসম্বলিত এ্যালবাম সংরক্ষিত আছে এখানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক দুর্লভ ছবি ও নানা তথ্য আরো সমৃদ্ধ করেছে এই সংগ্রহ শালাটিকে। যুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে ৫ শতাধিক এ্যালবাম রয়েছে এখানে।
শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়েও সঞ্জীব রায় গবেষণাও করেছেন অনেক। সব কাজেই রয়েছে তাঁর সমান দক্ষতা। এলাকায় তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমী,পাবলিক লাইব্রেরী, জ্ঞানেন্দ্র নাথ গ্রন্থাগার, উপজেলা সাহিত্য সাংস্কৃতি পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাট্যগোষ্ঠীসহ নানা সংগঠন। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১২টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এলাকায়। নাজিরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যে গ্রহন্থের লেখকও তিনি।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য বার বার নানা পদকে ভূষিত করা হয়েছে তাঁকে। উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মননা পদক লাভ করেন। ২০১৭ সালে এসেও তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের খেতাবটি আবারও অর্জন করে নেন। এমন অসংখ্য পুরস্কার পেয়ে তিনিও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। নিরলস ছুটেছেন কাজের নেশায়। সে ধারাবাহিকতা এখনো চলমান রয়েছে।

এই মহতী উদ্যোক্তা মানুষটি নীরবে-নীভৃতে এখনো নিজেকে উজার করে দিয়েছেন মানুষের সেবায়। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিতে চান দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। শিক্ষকতা পেশায় সামান্য যে মাইনে পান তার বড় অংশই ব্যয় করেন এসব তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পেছনে। ফলে সংসারে নানা ধরণের টানাপড়েন ও প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও থেমে নেই তাঁর পথচলা। একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে সঞ্জীব রায় সাধারণ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান আরো বহুদূর। বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান সেবামুলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে এমন অভিমত ও আগ্রহের কথা জানালেন সঞ্জীব রায়। তবে উপযুক্ত সংরক্ষণের জায়গার অভাবে তার সংগ্রহশালাটি কতদিন টিকে থাকবে এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করলেন তিনি। পারিবারিক জীবনে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক সঞ্জীব রায়। স্ত্রী শুভ্রা রানী একজন গৃহিনী। তিনিও স্বামীর নানা কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ান। এছাড়া তাঁর মা’ আমোদিনী রায়কে পর পর দু’বার এলাকার শ্রেষ্ঠ মা’ হিসেবে সংবর্দনা প্রদান করা হয়েছে। তাঁর পরিবারে ৬ জনই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ।
শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার নানা স্বপ্ন ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে সঞ্জীব রায় জানান, আজকের শিশু যেহেতু আগামি দিনের কর্ণধর, সেহেতু তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও সঠিক ভাবে দেশত্ববোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস তাদের বেশি বেশি জানানো দরকার। যে কারণে তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের উপর ১২টি নাটক লিখেছেন এর মধ্যে ১০ টি নাটক এলাকায় মঞ্চস্থ হয়েছে। দু’টি নাটকের বই তিনি শেখ রাসেলের নামে উৎসর্গ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শেখ রাসেলকে উৎসর্গকৃত বই দু’টি তুলে দিতে চান বলে ইচ্ছা পোষণ করেছেন তিনি।

নাজিরপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, চাকরীর জীবনে অনেক শিক্ষকের সাথে পরিচয় ঘটেছে, কিন্তু সঞ্জীব রায়ের মতো একজন আদর্শ মানুষ খুব কমই চোখে পড়েছে। তিনি শুধু একজন ভালো শিক্ষকই নন, এর বাইরে বহুগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব তিনি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ৫ শতাধিক দুর্লভ আলোকচিত্রের যে এ্যালবাম তিনি সংগ্রহ করেছেন এটি একটি অসম্ভব কাজ। আগামি প্রজন্ম তাঁর কাছে থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক ইতিহাস জানতে পারবে।

নাজিরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু সাঈদ খান ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান লাভলুর সাথে কথা হলে তারা জানান, সঞ্জীব রায় একজন নিবেদিত মানুষ। তিনি সমাজে একদিকে যেমন শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন তেমনি একজন আদর্শ কলম সৈনিক ও বটে। এলাকায় প্রতিটি ভালো কাজের সাথে তিনি সম্পৃক্ত আছেন। বিশেষ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপর যেসব তথ্য ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করেছেন এটি অবাক করার মতো। এছাড়া যে কোন কাজে ডাক দিলেই রাতে-বিরাতে মানুষের পাশে ছুটে আসেন তিনি। তাঁর অবদানের কাছে এলাকাবাসি চিরঋণী থাকবে।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...