ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - আখতারুজ্জামান আজাদ ; শব্দের জাদুকর,শব্দের জাদুঘর

আখতারুজ্জামান আজাদ ; শব্দের জাদুকর,শব্দের জাদুঘর

সাব্বির মো. খালিদ >>

আখতারুজ্জামান আজাদ একজন কবি, আপাদমস্তক কবি। তিনি শব্দের জাদুকর, তিনি শব্দের জাদুঘর। শব্দ তার হাতের খেলনা, তিনি শব্দ নিয়ে খেলতে এবং শব্দ ভাঙতে-চুরতে ভালোবাসেন। শব্দ নিয়ে তিনি কখনও লীলা খেলেন, কখনও খেলেন ছিনিমিনি। একাধিক শব্দের সঙ্গমে প্রতিনিয়ত তিনি সৃষ্টি করে চলছেন নিত্য-নতুন বিচিত্র-বর্ণাঢ্য সব শব্দ। তাকে কেউ ডাকেন ‘এ কালের সুকুমার’, কেউ ডাকেন ‘হালের সত্যেন্দ্রনাথ’।

প্রায় আড়াইযুগ বয়সী আজাদ আনুষ্ঠানিক লেখালেখি শুরু করেছিলেন একযুগ আগে, জাতীয় দৈনিকগুলোয় রাজনৈতিক স্যাটায়ার লেখার মধ্য দিয়ে। সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ তৎকালীন আজাদ শব্দবাণে বিক্ষত করতেন রাজনীতিকদেরকে, বিদ্রূপের বিষবাক্যে পরাস্ত করতেন রাষ্ট্রের পরাক্রমশালীদেরকে। প্রথম আলো, ইনকিলাব, আমার দেশ পত্রিকার বিদ্রূপ সাময়িকীগুলোতে ছিল আজাদের সদর্প বিচরণ। আজাদ এককালে কবিতা অপছন্দ করতেন, কবিতাকে মনে করতেন অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা। ব্যক্তিজীবনে প্রেমঘটিত বিপর্যয়ের পর সেই আজাদই ঘর বেঁধেছেন কবিতার সাথে, কবিতা ঘর বেঁধেছে আজাদের সাথে; এক দশক ধরে চলছে কবিতা ও আজাদের সহবাস। আজাদের লেখকজীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অর্জন— কবিতাবিমুখ প্রজন্মকে তিনি কবিতামুখী করেছেন, গ্রন্থবিমুখ প্রজন্মকে তিনি বাধ্য করেছেন কবিতার বই কিনতে-পড়তে-বুঝতে। কবিদের জন্য না; আজাদ কবিতা লেখেন অকবিদের জন্য, অলেখকদের জন্য। সহজ-সুবোধ্য অথচ লক্ষ্যভেদী ভাষায় কবিতা লিখে আজাদ আস্ত একটি প্রজন্মকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। তার দেখাদেখি যে কত তরুণ কবিতা লিখতে উৎসাহী হয়েছে, এর ইয়ত্তা নেই। অনেকেরই জীবনের প্রথম কেনা কাব্যগ্রন্থটি আজাদের রচিত। আজাদ প্রেমের কবি, রাজনীতির কবি, দ্রোহের কবি। প্রকাশ্যে না হলেও অপ্রকাশ্যে অবশ্য তিনি নিজেকে দাবি করেন ‘পোলিটো-রোমান্টিক কবি’ বলে। শব্দটি তার নিজেরই উদ্ভাবিত। একই কবিতায় রাজনীতি ও প্রেমের উপস্থিতি থাকলে সেটিকে তিনি পোলিটো-রোমান্টিক কবিতা বলেন এবং তিনি এই ধাঁচের কবিতাই বেশি লেখেন। তার কবিতায় হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবুল হাসানদের প্রভাব লক্ষণীয়; সঞ্জীব চৌধুরী ও কবীর সুমনের গান দ্বারাও তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত এবং এই প্রভাবের কথা তিনি অস্বীকার করেন না। ‘আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি’ পঙক্তি দিয়ে শুরু হওয়া ‘ইতিহাস’ কবিতাটিকে বলা যায় তার সিগনেচার কবিতা। কাউকে তোয়াক্কা না করার স্বাধীনচেতা মনোভাব ফুটে উঠেছে অর্ধযুগ আগে লেখা তার এই কবিতায় এবং এই কবিতাটি তাকে এনে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি ও তুমুল পাঠকপ্রিয়তা। কবিতাটি অজস্র তরুণের মুখস্থ, অনেকে কবিতাটি ব্যবহার করেন ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ‘অ্যাবাউট মি’ অংশেও। কবিতাটির শেষ দুই চরণ ‘তোষামুদে-জন প্রিয় হয় সবার পৃথিবীর পরিহাসে, তোষামোদ নেই রন্ধ্রে আমার— লিখে রেখো ইতিহাসে’ অজস্র পাঠকের অন্তরাত্মা স্পর্শ করেছে। তার চা-পানের ইতিবৃত্ত, নষ্ট বিধির দণ্ডবিধি, আমি বরাবরই একজন রাবীন্দ্রিক প্রেমিকা চেয়েছিলাম, অনুভূতি জেনারেল স্টোর ইত্যাদি কবিতাও সমানভাবে জনপ্রিয়। আজাদের এক অভিনব সৃষ্টির নাম ইয়াম্মি সিরিজ। সমকাল সম্পর্কে খোঁজ না-রাখা হ্যাংআউট-প্রিয় মেকআপ-সর্বস্ব ট্রিটবাজ ব্রো-সিস প্রজন্মকে বিদ্রূপ করে ইয়াম্মি সিরিজ নামে তিনি লিখেছেন তিন ডজনেরও বেশি ছড়া, যেসব ছড়ায় তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে ঐ প্রজন্মটির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। এই সিরিজটি পাঠকদেরকে অভাবনীয় বিনোদন দিয়েছে। এই সিরিজ নিয়ে তিনি দুই সংস্করণ বই প্রকাশ করেছেন, প্লে স্টোরে এটির অ্যাপ রয়েছে এবং এই ছড়া নিয়ে মিউজিক ভিডিও নির্মাণের কাজও চলছে বলে আজাদ জানিয়েছেন। কারো-কারো কাছে আজাদের কবিতার চেয়ে গদ্যই বেশি শক্তিশালী। সমকালীন রাজনৈতিক ইশুতে রচিত কলামে তিনি যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দেন, তা অনেকটা অবিশ্বাস্য। ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোদীদল বা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে তার কলম সমানভাবে সোচ্চার। অন্তর্জালে তার বেপরোয়া রাজনৈতিক লেখা তাকে অবশ্য কম ভোগায়নি। বহুমুখী রাজনৈতিক-অরাজনৈক চাপ এই বয়সেই তাকে সামাল দিতে হয় প্রতিনিয়ত এবং চাপের বিপরীতে আজাদ নেহায়েতই নির্বিকার।

আজাদের দাবি-মতে তিনি নিরপেক্ষ নন, তবে নির্দলীয়। সম্প্রতি তিনি গল্প লেখাও শুরু করেছেন। এমনকি তার কলামে-গল্পেও যে পরিমাণ উপমা-রূপক-অনুপ্রাসের উপস্থিতি থাকে, তাতে তার গল্প বা রাজনৈতিক কলামগুলোকেও দীর্ঘ কবিতা বলে ভ্রম হয় এবং আজাদ তার কলামকে বলেন পলিটিক্যাল লিটারেচার। তার প্রথম রাজনৈতিক কলামগ্রন্থ ‘প্রিয়াঙ্গনে রণাঙ্গনে’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে এবং সর্বশেষ বইমেলায় সাহিত্যদেশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া’ নামক তার দ্বিতীয় কলামগ্রন্থ। এছাড়াও একই প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে কবিতা সংকলন ‘গণকবিতাতন্ত্রী বাংলাদেশ।’ ‘সর্বাধিক বিক্রীত’, ‘বেস্ট সেলার ‘ ‘আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ শব্দগুলোর প্রতি অনুরক্ত না হলেও এবারের বইমেলায় প্রকাশিত তার কলামগ্রন্থ ও কবিতা সংকলন দুটি উক্ত তকমাগুলো পেয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আজাদের একেকটি বইয়ের নামই যেন একেকটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা। একটি আস্ত বই রচনা করতে তার যতটা কষ্ট হয়, তার এর চেয়ে বেশি কষ্ট হয় বইটির নাম নির্ধারণে। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম ‘শুদ্ধ হব, হবে?’, ‘পর্দা ছেঁড়ার স্পর্ধা’, ‘সামরিক কবি, বেসামরিক প্রেমিক’, ‘বিষময় বিস্ময়’ এবং ‘জনতার মাঝে নির্জনতা’। তার বিদ্রূপাত্মক ছড়াগ্রন্থ ‘এবং ইয়াম্মি সিরিজ’ ও ‘ইয়াম্মি সিরিজ রিটার্নস’। বানান ও ব্যাকরণের ব্যাপারে আজাদ আপসহীন। তিনি কেবল নিজেই বানানচর্চা করেন না, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করেন এবং অন্তর্জালে ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্য করেন শুদ্ধ বানানে লিখতে। ফেসবুকে ‘আখতারুজ্জামান আজাদের বাংলা ক্লাস’ নামে তার একটি পেজ আছে, যেখানে তিনি শুদ্ধ বানানের ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ দেন। রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার বিরুদ্ধেও তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এমন স্বভাবের কারণে অনেকে তাকে গ্রামার নাৎসি, ভাষা-পুলিশ, বানান-মৌলবাদী ইত্যাদি অভিধায়ও অভিহিত করে থাকেন এবং এসব অভিধাকে তিনি মাথা পেতে নিয়েছেন।

আজাদ লেখাপড়া করেছেন বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা জিলা স্কুল ও নটর ডেম কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেছেন এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম ডিগ্রি। তার জন্ম বরগুনায়। বাবা নুর মুহাম্মদ, মা আমেনা বেগম। আজাদের রচিত ‘নষ্ট হব, হবে?’ কবিতার শেষ দুই চরণ দিয়েই শেষ করা যাক আজাদ-কথন— অবাক প্রেমের মিলবে দেখে নষ্ট হলেই তবে; এক পৃথিবী, এক আহ্বান—নষ্ট হব, হবে?

লেখক > সাব্বির মো: খালিদ। সহকারী জজ(সুপারিশপ্রাপ্ত) এল,এল,বি; এল,এল,এম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...