ব্রেকিং নিউজ
Home - অন্যান্য - তালপাখায় ভর করে বেঁচে আছে গৌরনদীর শব্দকর সম্প্রদায়

তালপাখায় ভর করে বেঁচে আছে গৌরনদীর শব্দকর সম্প্রদায়

গৌরনদী থেকে বিশ্বজিত সরকার বিপ্লব: আমাদের দেশে এমন অনেক জনগোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছে যাদের চিরদরিদ্র বলাই যুক্তিসঙ্গত। এই দরিদ্রজনদের সাথে জাতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির সংশ্রব খুব কমই। বিচ্ছিন্ন এসব গোষ্ঠী দুঃখে-দুর্যোগে নিজেরাই সাধ্যমতো লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সামাজিক অত্যাচার, অনাচার শোষণ-বঞ্চনার বিষয়াদি তাদের নিত্য সহচর।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার প্রত্যন্ত উত্তর চাঁদশী গ্রামের প্রায় শতাধীক পরিবার এমনই এক সবহারা জনগোষ্ঠী। দেশীয় নানা বাদ্যযন্ত্র বাজানো তাঁদের বংশানুক্রমিক পেশা আজ যা বলতে গেলে বিলুপ্ত। বাপ-দাদার পেশা হারিয়ে শব্দকররা আজ অন্য নানান পেশা গ্রহণ করেছেন কিন্তু তাতে দারিদ্র্যতা কমেনি। আবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। তাঁদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে নানান ধরনের পশ্চাদপদতা। আছে নেশার প্রকোপ, যৌতুক আর বাল্যবিয়ের আরোগ্যহীন ক্ষত আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। সব মিলিয়ে এ সম্প্রদায়ের মানুষ এক নিদারুণ দুষ্টচক্রের মধ্যে জীবন কাটিয়ে চলেছেন।

এ গ্রামের শব্দকর পরিবারগুলোর ৫৮টির গড় লোকসংখ্যা ৪.৫৭ জন এবং মাসিক আয় ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা। এসব পরিবারের মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক কাঠারও কম। আবার এ ৫৮টি পরিবারের ৩৮টিই ভূমিহীন। বাকি পরিবারগুলোর অবস্থা কিঞ্চিৎ ভাল। বংশানুক্রমিক পেশা হারানোয় দিনমজুরি, রিকশা চালানো আর ফেরি করে জিনিস বিক্রিই এখন তাঁদের জীবিকার মূল উপায়। অভাবের চাপে কাউকে কাউকে ভিক্ষাও করতে হচ্ছে।

তবে গত প্রায় দু’দশক ধরে চাঁদশীর শব্দকর পরিবারগুলোকে হস্তশিল্পের দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। হস্তশিল্প মানে তালপাখা তৈরির কাজ। পাখা তৈরির কাজ মূলত মেয়েরাই বাসায় বসে করেন। আর বিক্রির দিকটা দেখেন পরিবারের ছেলেরা। এ গ্রামের ৮০টির মতো পরিবারের জীবিকা এখন তালপাখার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কেউ পাখা বানাচ্ছে, কেউ বা তালপাতা ও বাঁশ সংগ্রহ বা বিক্রি করছে।

হাচেন খলিফা এ গ্রামেরই বাসিন্দা, বয়স পঞ্চাশের ওপর। তিনি জানালেন প্রায় ১৫ বছর ধরে তাঁর পরিবার পাখা বানানোর কাজ করছেন। ‘পাখা বানানোর কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। আমার পরিবারের মেয়েদের পরিশ্রমের কারণেই আমরা এখনও এ কাজ চালিয়ে যেতে পারছি,’ বললেন হাচেন। কিন্তু ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরে গাছপালা উপড়ে যাওয়ার পর পাখার উপকরণ তালপাতার সংকট দেখা দেয়, ফলে দামও বেড়ে যায় অনেকটা। তারপর থেকে গৌরনদীসহ আশপাশের উপজেলা ঘুরে অনেক খুঁজে বেশি দামে তালপাতা ও বাঁশ কিনতে হচ্ছে।

শব্দকর পরিবার যারা এ কাজ করছে বছরের নয় মাসই পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। হাচেনের পরিবারের সাত সদস্যই এ কাজ করেন। পাখা বানিয়েই পরিবারটি চলছে। তাঁর স্কুল পড়–য়া মেয়েরাও স্কুল থেকে ফিরেই তারা বাবা-মায়ের সঙ্গে পাখা বানানোর কাজে যোগ দেয়।

আছিয়া বেবগম ৪৫ জানান প্রতিদিন ২১টির মতো পাখা তৈরি করা যায়। একটা পাখা তৈরিতে খরচ হয় দুই টাকা আর পাইকারের কাছে তা বিক্রি করছেন তিন টাকায়। আরেক শব্দকর কাসেম খলিফা জানালেন সপ্তাহে একদিন পাইকার এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাখা কিনে নিয়ে যান। এসব পাখা বিক্রি হয় মূলত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মেলা, হাট-বাজারে, বাস স্ট্যান্ডে, দোকানে। শদ্বকর রহিম খলিফা জানালেন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াতে অনেক পরিবার পাখা বানানো ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে শীতকালে লেপ তোষক বানানোর কাজ করেন। তিনি আরো জানান হস্তশিল্প নির্মাণের এ দক্ষতা যাতে পরিবারগুলো ধরে রাখতে পারে সেজন্য দরকার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুদমুক্ত ঋণ প্রদানে জোড় দাবি জানালেন।

চাঁদশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কৃষ্ণকান্ত দে বললেন, ‘শব্দকররা যেমন পরিশ্রমী এবং হস্তশিল্পের কাজে তেমনই নিপুণ। এ কাজে টিকে থাকতে হলে এদের এখন উপযুক্ত পৃষ্টোপোষকতা প্রয়োজন’ ।

শদ্বকরদের সরদার এবং নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য বাদশা খলিফা জানালেন, ‘সহযোগিতা পেলে শব্দকররাই শুধু বাঁচবে তা না, বেঁচে যাবে পাখাশিল্পের ঐতিহ্যও। আরো অনেক হস্তশিল্পের কাজ আমার সম্প্রদায় জানে যে গুলো সম্প্রসারন করতে পাড়লে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।

Leave a Reply

x

Check Also

এফ-কমার্স ভিত্তিক মঠবাড়িয়া ই-বাজারের সাফল্যগাথা

মঠবাড়িয়া ই-বাজার, একটি এফ কমার্স বা অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম। আর অনলাইন ভিত্তিক ব্যাবসার নতুন ধারণাকেই ...