ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - ফেসবুক সংস্কৃতি তরুণদের বই বিমুখ করছে

ফেসবুক সংস্কৃতি তরুণদের বই বিমুখ করছে

জাসেম আলম শুরুতেই আমি ফেসবুক জন্মের ইতিহাস দিয়ে শুরু করি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে মার্ক জুকারবাগ ২০০৩ সালে ফেসবুকের পূর্বসূরি সাইট ফেসম্যাপ তৈরী করেন। ফেসম্যাপের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে মার্ক তার নতুন সাইটের কোড লেখার কাজ শুরু করেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে The facebook.com প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। তারপর ২০০৫ সালে The facebook.com এর নাম পাল্টে নাম রাখা হয় Facebook ২০০৬ সালে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৫ লাখ। অবশ্য পরে কৌশলগত কারণে ফেসবুকের সঙ্গে মাইক্রোসফট সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তারপর সর্বসাধারণের জন্য ফেসবুক উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর আগে শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই ছিলেন এর ব্যবহারকারী।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে ভার্চুয়াল গিফট্ শপ চালু হয় এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা পৌঁছায় ২ কোটিতে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে ফেসবুক চ্যাট চালু হয় এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটিতে। তারপর ২০০৯ সালে এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ কোটিতে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তা পৌঁছায় ৫৫ কোটিতে আর বর্তমানে তা শত কোটি পেরিয়ে সহস্র কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। এভাবেই দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। সুতরাং বর্তমানে ফেসবুক হয়ে উঠেছে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের একটি জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনীর হাসান তার নিজস্ব ব্লগ পোস্টে জানিয়েছেন যে বর্তমানে ধারণা করা যায় বাংলাদেশের Facebook ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪২ লাখ পুরুষ আর ১২ লাখ মহিলা যার বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে তরুণ-তরুণীদের বয়স হল ১৫ থেকে ২৬ বছর যাদের মধ্যে বৃহত্তম অংশই অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী। এখন ইন্টারনেটের রাজা হিসেবে খ্যাত ফেসবুক বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। তবে বর্তমানে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তরুণরা এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে যে পকেটে খাবার জোগাড়ের পয়সা না থাকলেও এমবি (মেগাবাইট) কেনার কাজটি আগে সেরে নেয়। প্রোফাইল পাতায় অন্যের ছবি দিয়ে, একই ব্যক্তির একাধিক আইডি দিয়ে বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে সম্পর্কের জাল বোনে। তারপর চ্যাটিংয়ের নামে সম্পর্কের এমন গভীরতা ধারণ করে যাতে উভয় পক্ষই প্রতারণা ও ধোঁকার শিকার হয়। এখানে যৌন সম্পর্কিত ও আবেদনময়ী এমন কিছু ছবি ছাড়া হয় যা অন্য ফেসবুক বন্ধুদের অনায়াসে দেখতে বাধ্য করে। মেয়েদের বিরক্ত করা, চরিত্র হনন করা, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে কুৎসা রটনা, ভুয়া আইডির মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের গালমন্দ করা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপরপক্ষে, সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের পাঠাভ্যাসের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু আজ আমি এই ২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই তরুণ সমাজ বই বিমুখ হয়ে পড়ছে। অথচ বর্তমান সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে পাঠ্যাভাসের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের তরুণ-তরুণীরা যারা এখন ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত, টিভিতে লাইভ শো সিরিয়াল ও রাতের ঘুম নষ্ট করে ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত, তাদেরই এখন উপযুক্ত সময় ছিল পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে বই পড়ার যে সংস্কৃতি আমাদের মতো তরুণদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছিল আজ তা বিনষ্টের পথে। একটা সময়ে আমাদের তরুণরা অবসর সময় কাঁটাতো বই পড়ার মাধ্যমে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছিল বইয়ের মাধ্যমে কিন্তু নব্বই এর দশককে যখন আমাদের দেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবেশ ঘটে। এই মুক্ত বাজার অর্থনীতি তারপর আমাদের সমাজ জীবনে তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে ফেসবুক-এর মত বই।
আমাদের এই ফেসবুক জেনারেশন এখন আর বই পড়ে না। মলাটে আবৃত বাঁধাই করা কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কোন লেখকের লেখা বাঙালীর জীবন মুখী কালজয়ী উপন্যাস, আমাদের এই গর্বিত ইতিহাস, জাতীয় নেতাদের জীবনী, বাংলার রূপকথার গল্প কেউ পড়ে না। আমি আজ আমাদের তরুণ জেনারেশনের সৃজনশীলতা নিয়ে সন্ধিহান। এরা যতই বাইরে স্মার্টনেস দেখাক আসলে বই বিমুখ একটি অন্তরসার শূণ্য প্রজন্ম উপহার পেতে যাচ্ছি। একুশের বই মেলায় বই বিক্রির সংখ্যা তুলনামূলক কম। নতুন প্রকাশনীর সংখ্যাও কম। তরুণ লেখকের বই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। বই মেলাগুলোতে দর্শকের উপস্থিতি ভাল থাকলেও তা এখন সেলফি ও ছবি নিয়ে ফেসবুক কেন্দ্রীক। যারা বই ক্রয় করছে তারা পড়ছে না। বেশির ভাগ সময়েই ইন্টারনেট,ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থায় কর্মরত ডা. নাজমুল হাসান কর্তৃক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইন্টারনেটে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ৮৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী কিন্তু এর মাত্র ৫ ভাগ তরুণ-তরুণী বিভিন্ন খবর ও গবেষণার কাজে এটি ব্যবহার করছে। এই ৮৫ শতাংশ তরুণ-তরুণীদের বেশির ভাগই ঘুমের জন্য ৮ ঘন্টা এবং খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য কাজের জন্য ব্যায় করে ২ ঘণ্টা আর ফেসবুক ব্যবহারে ব্যস্ত থাকে ৬ ঘন্টা। তারা মাত্র ২ ঘন্টা পড়াশুনা করে। তদের পড়াশুনা শুধু পাঠ্যবই আর সিলেবাস অনুযায়ী। আজ সহপাঠীদের মধ্যে বই আদান-প্রদান হয় না। অনেক স্কুলেই গ্রন্থাগার নেই। পাবলিক লাইব্রেরীতেও নেই পর্যাপ্ত বই। শিক্ষাক্রম এখন আর বই বান্ধব নয়। আমাদের সংস্কৃতি, আর ঐতিহ্য বিকৃত হচ্ছে ফেসবুক সংস্কৃতির জন্য। তাই আমি বলতে চাই, নতুন প্রজন্মের হাতে বই তুলে দেওয়ার এখনই সময়। বই পড়তে হবে। জ্ঞান আহরণ করতে হবে। বই পড়ার অভ্যাস সব ধরণের মানুষের মাঝেই ছড়িয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর বুকে আমাদের যে গর্বিত ইতিহাস তা জানা ও বোঝার জন্য বই পড়তেই হবে। সঠিক বুদ্ধির বিকাশ ও প্রতিফলন করে কর্ম দক্ষতা বাড়াতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য একাত্ব হতে হবে। জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তরুণ সমাজকে ধ্বংশের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
আমরা চাই এই তরুন সমাজ ফেসবুকে কপি-পেস্ট না করে নিজেদের কিছু প্রতিভার বিকাশ ঘটাক। আমরা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকারী একটি জেনারেশন চাই যারা আগামী বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর জন্য হবে গর্বিত অহংকার। এক্ষেত্রে বই পড়ার যে কোনো বিকল্প নেই তা বোঝাতে হবে এই নতুন প্রজন্মকে। বই তুলে দিতে হবে তাদের হাতে। আলোকিত সমাজ গড়তে তাই ফেসবুক নয় আলোকিত বই চাই।

Leave a Reply

x

Check Also

প্রতিবেশীর যখন করোনা পজিটিভ

মঠবাড়িয়ায় করোনা এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে। তাই আমাদের অতিরিক্ত সাবধানতা ...