ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - গণতন্ত্র: বাংলাদেশ স্টাইল

গণতন্ত্র: বাংলাদেশ স্টাইল

মাসুদ কামাল‘গণতন্ত্র’ শব্দটি নিয়ে আমাদের মতো এত বেশি চর্চা পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় কি না তা নিয়ে প্রায়ই আমার সন্দেহ হয়। আমি কারণটা বোঝার চেষ্টা করি। এটা কি এই কারণে যে, গণতন্ত্র আমরা খুবই পছন্দ করি, তাই এটা খুব করে চাই, অথচ পাই না বলে এ নিয়ে হা-হুতাশ এবং আলোচনা করি? হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, আসলে গণতন্ত্র কে চায়, জনগণ নাকি রাজনৈতিক দলগুলো? এসব প্রশ্নের পরই অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলো, কার কাছে চায়? সরকারের কাছে? সরকার যদি অগণতান্ত্রিক হয় তাহলে সে গণতন্ত্র দেবে কিভাবে? আবার যে রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র নিয়ে এত আন্দোলন বা কান্নাকাটি করে, তারা নিজেরাই কি কিছুমাত্র গণতান্ত্রিক?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশজুড়ে যখন বেশ অভাব অনটন বিরাজ করছিল, আমার তখন বোঝার মতো বয়স হয়েছে। নিজের গায়ের চামড়া দিয়েই আমি সেই অভাবের মধ্যে বসবাস করেছি। বয়স্কদের মধ্যে তখন পূর্ববর্তী নৃপতিদের নিয়ে আলোচনা হতে দেখেছি। কে কেমন ছিলেন, কার আমলে অভাব কম ছিল, দেশজুড়ে শান্তিশৃঙ্খলা ছিল বেশিÑএ সব নিয়ে আলোচনা। এই ধরনের আলোচনা এখনো যে হয় না, তা কিন্তু নয়। তুলনামূলক আলোচনা করতে আমরা খুবই পছন্দ করি। অবাক করা ঘটনা হলো, প্রতিবারই কিন্তু দেখেছি সুশাসক হিসেবে ‘গণতান্ত্রিক’ কোনো সরকারের নাম আসেনি। বরং এমন বলতে শুনেছি ‘শাসক ছিলেন আইয়ুব খান, শক্ত হাতে দেশ চালিয়েছেন।’ অথবা ‘এরশাদ হয়ত একটু লুচ্চা ছিলেন, কিন্তু দেশের রাস্তাঘাটের উন্নতি কিন্তু অনেক করেছেন।’ অথবা আরও পরে এমনও শুনেছি ‘১/১১ এর সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজরা সব পালিয়েছিল।’

এ সবই আলোচিত বাক্য। এসব উচ্চারণের পেছনে আর আবেগ কতটা ছিল তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু এমন আলোচনা একেবারেই হয়নি কখনো, তেমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হয় এমন কথাবার্তা? সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গণতান্ত্রিক একটি সরকার প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন না যেতেই কেন মানুষ হারানো দুঃশাসন নিয়ে নষ্টালজিক হয়ে পড়ে? ১/১১ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখন বড় সোচ্চার। মানুষকে প্রায়ই ভয় দেখায়। বলে, এরকম না করলে, ওরকম না করলে আবার কিন্তু ১/১১ আসবে, ওই সময়ের কথা কি ভুলে গেছেন ইত্যাদি। কিন্তু ১/১১ এর ওই সরকার নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা যত বেশি ভয়ে আক্রান্ত, সাধারণ জনগণও কি ততটা আতংকিত?

ইংরেজিতে পারসেপশন বলে একটা শব্দ আছে। ওই সময় দুর্নীতিবাজ হিসেবে যাদেরকে ধরা হয়েছিল, তারা আসলে কতটা সাধুপুরুষ ছিলেন সেটা হয়ত প্রমাণসাপেক্ষ বিষয়। তবে সাধারণ মানুষের পারসেপশন কিন্তু খুব একটা অন্যরকম ছিল না। একটা মানুষ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ২ একর জমি থেকে ২১০০ একর জমির মালিক হয়ে যাচ্ছেন কোন দৃশ্যমান বৈধ আয়ের সঙ্গে জড়িত না হয়েই। এমন লোকের নৈতিকতা সম্পর্কে মানুষের পারসেপশন কি হবে? তখনও তাই হয়েছিল। আসলে মানুষ কোনো অবস্থাতেই অনিয়মতান্ত্রিক শাসনকে পছন্দ করে না। সেটাকে পাল্টাতে চায়। ভোট কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে পাল্টে যখন যায়, নতুন যে সরকার আসে তার কাছ থেকে নিয়মতান্ত্রিক আচরণ আশা করে। আশা করে গণতন্ত্রের কথা বলে আসা এই রাজনৈতিক সরকার গণতান্ত্রিক হবে। সেই প্রত্যাশা যখন মার খায়, তখনই হতাশ হতে শুরু করে। আর হতাশ মানুষ যদি অযৌক্তিক কিছু বলেও বসে, তাতে বিস্মিত হওয়া ঠিক হবে না। আমরা যদি আজকের কথাই ভাবি, কি দেখি। সরকার এবং বিরোধীদল উভয়েই গণতন্ত্র নিয়ে বেশ চর্চা করছে। সরকার বলছে দেশে তারা এমন গণতন্ত্র দিয়েছে, যার তুলনা বিশ্বে আর কোথাও নেই। আর বিরোধীদল কি বলছে? তারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে, দেশের মানুষকে গণতন্ত্র সুবাতাস না দিতে পারা পর্যন্ত তারা থামবে না। ১৯৯১ সাল থেকে যদি ধরি, এ দেশের শাসনক্ষমতায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ এই দুটি রাজনৈতিক দলই ঘুরে ফিরে ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকে তো আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে, আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে তো বিএনপি বিরোধী দলে। প্রতিবারই সরকারে থাকা দলটি দাবি করেছে তারা গণতন্ত্র দিয়েছে। আর মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিবারই সেই সময়কার বিরোধীদল দাবি করেছে এই সরকার গণতন্ত্র হরণ করেছে।

সংসদীয় ব্যবস্থা যদি গণতন্ত্রের প্রতীক হয়, সংসদকে বলতে হবে সেই গণতন্ত্রের চারণক্ষেত্র। ১৯৯১ থেকে এই ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ের সংসদের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রধান এই দুটি দলই প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছে সংসদকে অকার্যকর করতে করতে হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে। একদল সংসদে গেছে তো আর একদল যায়নি। না গিয়ে আবার উল্টো অভিযোগ করেছে। আর যারা গেছে তারা আইন প্রণয়ন বা জনগণের অধিকার নিয়ে চর্চার জন্য যে সময় ব্যয় করেছে, তার কমপক্ষে ১০০ গুণ সময় ব্যয় করেছে দলীয় নেত্রীর স্তুতি এবং বিপক্ষীয় নেত্রীর সমালোচনায়। জাতীয় সংসদে কোনো বিল বা আইন পাস করতে গেলে ভোটাভুটির একটা নিয়ম আছে। কিন্তু আমাদের দেশের সংসদে যে ভোট হয়, তার কোনো অর্থ আছে? সব তো আগেই বলে কয়ে নেওয়া, নিয়ম রক্ষার জন্য সংসদে কেবল উত্থাপিত হয়, তারপর কণ্ঠভোটে পাস।

নিজ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে কোনো সদস্য যদি আনীত বিলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে তার সংসদ সদস্য পদই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এমনই আইন করা আছে। আইনই যদি এমন হয়, তাহলে আর ভোটের ব্যবস্থা করে লাভ কি? দলীয় ফোরামে গৃহীত সিদ্ধান্তকে আইন হিসেবে গণ্য করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আবার যদি দলীয় ফোরামের কথাই ধরি, সেখানেও কি শীর্ষ নেত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হওয়া সম্ভব? তাহলে দাঁড়াল কি? নেত্রীর সিদ্ধান্তে দল চলবে, দলের সিদ্ধান্ত সংসদে উঠবে, উত্থাপিত বিল বিরুদ্ধে কেউ ভোট দিতে পারবে না, ফলে সেটি আইনে পরিণত হবে।

অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেত্রীর ইচ্ছাই এদেশে আইন। তা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাক, আর বিএনপিই থাক। ইহাকেই গণতন্ত্র বলা হয়। ইহাই বাংলাদেশি গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের আরও অনেক সংজ্ঞা দৃশ্যমান আমাদের এই ভূখ-ে। আচ্ছা তাত্ত্বিক কথা বাদ, বরং উদাহরণ দিয়েই বলি। দিন কয়েক আগে, ১৯ মার্চ হয়ে গেল বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল। জাতীয় কাউন্সিল মানেই হচ্ছে সেখানে সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীরা আসবেন। তারা দল, দলের নীতিমালা, দলের আদর্শ, দলের নেতা-নেত্রীদের নিয়ে কথা বলবেন। তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হবে দলের আগামী দিনের কর্মকৌশল। নির্বাচন করা হবে আগামী দিনের নেতৃত্ব। এবং অতি অবশ্য এর সব কিছুই করা হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।

এখন যদি প্রশ্ন করা এর কোনটা কোনটা করা হয়েছে এই কাউন্সিলে? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি নির্বাচন করা হয়েছে? কাউন্সিলের বেশ কয়েকদিন আগেই বেশ ঘটা করে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল এবার নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। এমনকি শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত হবে ভোটের মাধ্যমে। তারপর আরও নাটক করতে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করা হলো। শীর্ষতম চেয়ারম্যান পদে একটিই মাত্র মনোনয়নপত্র বিক্রি হলো, বলা বাহুল্য সেটা গত তিন দশক ধরে থাকা চেয়ারপারসনের নামেই কেনা হলো। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নামে যে পদটি বিগত কাউন্সিলে তৈরি করা হয়েছিল সেই পদেও একটিই মাত্র মনোনয়নপত্র বিক্রি হলো। কার নামে কেনা হলো? যিনি শুরু থেকেই এই পদে আছেন এবং পদটি পাওয়ার পর একদিনের জন্যও দেশের মাটিতে পা রাখতে পারেননি, তার নামে।

আচ্ছা, অন্য কেউ যদি এই পদ দুটিতে মনোনয়নপত্র কিনতেন, তারপর যদি নির্বাচন হতো, এদের কি পরাজিত হওয়ার কোনোই আশঙ্কা থাকত? মোসাহেবরা কেউ কেউ হয়ত ভেবেছেন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নেতৃত্ব এতটাই অবিসংবাদিত যে, তাদের পদে অন্য কেউ প্রার্থী হলেও সেটা তাদের জন্য অপমানজনক হবে। এই ভাবনাই যদি গণতান্ত্রিক ভাবনা হয়ে থাকে, তখন প্রশ্ন ওঠতেই পারে যে, তাহলে আর ঘটা করে মনোনয়নপত্র বিক্রির নাটকটা কেন করা হলো? কেনই বা একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো? এই যে হাস্যকর একটা নাটকের মঞ্চায়ন, এর দায় কি মূল নেতৃত্বের গায়ে গিয়েই শেষ পর্যন্ত লাগছে না? তাহলে মোসাহেবের দল কি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সেরকমই একটা ইমেজ সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে চান?

১৯ মার্চের কাউন্সিলে দুই পদে ওই একক প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো। প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন হলেও ধরনটা কিন্তু বহুল সমালোচিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীদের বৈধতা দিতে বলা হয়েছিল যে, তারা এতই জনপ্রিয় যে, তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাহস পর্যন্ত পায়নি। কেমন যেন একই রকম শোনাচ্ছে না? কাউন্সিলে কিন্তু দুজন মাত্র নেতার নামই নির্বাচিত হিসেবে ঘোষণা করা হলো। বাকি পদগুলোর কি হবে? কে নির্বাচন করবেন? সেখানে কাউন্সিলরদের কি ভূমিকা হবে? এসব প্রশ্নের জবাবও আগে থেকেই জানা। সবকিছু করবেন চেয়ারপারসন। তাকে কাউন্সিলররা সেই দায়িত্ব দিয়েছেন।

শোনা যাচ্ছে আগামী ১০ জুলাই নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হবে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেখানেও হবে এই একই দৃশ্যের অবতারণা। শীর্ষ পদে আর কেউ প্রার্থীই হবেন না, বাকি পদগুলোকে নেতা নিয়োগের জন্য শীর্ষ নেত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এভাবেই গঠিত হবে একটি গণতান্ত্রিক দলের গণতান্ত্রিক কমিটি। আসলে গণতন্ত্রের যে নতুন সংজ্ঞা এখন বাংলাদেশে দৃশ্যমান, তার মূল সূত্র হচ্ছে নেতা বা নেত্রী যিনি থাকবেন তিনিই হবেন গণতন্ত্রের প্রতিভূ। তিনি যা কিছু করবেন, যা কিছু ভাববেন সবই গণতন্ত্র। যা কিছু তাঁর চিন্তার বাইরে ঘটবে সেটাই অগণতান্ত্রিক।

বিষয়টা বোধকরি বিএনপির কাউন্সিলরা উপলব্ধিও করতে পেরেছেন। তাই তারা গঠনতন্ত্রেও একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছেন। চেয়ারম্যানকে তারা আরও বেশি ক্ষমতাবান করেছেন। আগে যেকোনো উপকমিটিকে চেয়ারম্যান যেকোনো সময় ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। ভেঙে দিতে পারলেও একক সিদ্ধান্তে পুনর্গঠনের ক্ষমতা তার ছিল না। এবার সেই গঠনের ক্ষমতাও কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে দেওয়া হলো। অর্থাৎ দলে গণতন্ত্রের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করা হলো! বিকশিত এই গণতন্ত্রের ঢেউ কি লাগবে না মানুষের গায়ে? লাগবে, লাগছে। আর সেই ঢেউয়ের তোড়ে আমরা ভেসে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছি।

Leave a Reply

x

Check Also

প্রতিবেশীর যখন করোনা পজিটিভ

মঠবাড়িয়ায় করোনা এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে। তাই আমাদের অতিরিক্ত সাবধানতা ...