ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষতি নেই তবে দলীয়করণের সংস্কৃতি বদলাতে হবে

দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষতি নেই তবে দলীয়করণের সংস্কৃতি বদলাতে হবে

শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ বদিউল আলম মজুমদার। তিনি ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর। সচেতন ও চিন্তাশীল নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত নাগরিক আন্দোলন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন)-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমেরিকার দুটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এ ছাড়া সৌদি রাজপরিবারের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। তিনি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, গেজেট পাস, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শারমিনুর নাহার

কালের কণ্ঠ : সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে গেজেট জারি হয়েছে। চলমান বাস্তবতায় স্থানীয় নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকে করার যৌক্তিকতা কী বলে মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার : আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। এর পক্ষে একটা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে এতে দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে এবং দলের মনোনয়ন নিয়ে জয়ী প্রার্থীরা কোনো অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা যাবে। সে ক্ষেত্রে মনোনীত ব্যক্তিরা দায়িত্বশীল আচরণ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমাদের কোথাও কি শৃঙ্খলা আছে? অন্তত আমার জানা নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত বিষয় ছাড়া সরকারি দল কি তাদের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বা ব্যবস্থা নিয়েছে? কেবল স্পর্শকাতর বা ধর্মীয় বিষয়ে দলের কেউ কথা বললেই ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। তারা দলীয় শক্তিতে সব রকমের অপকর্ম করে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে গাইবান্ধা, টাঙ্গাইলে, এমন বহু ঘটনা আছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিককালে দেখা গেল রাজন ও রাকিবের ঘটনার রায় হলো। এটা দ্রুত রায় হয়েছে। এর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু অনেক কিছুরই কোনো বিচার হয়নি।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের পক্ষে আর একটা যুক্তি বলা হয়, এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। যারা ঠিক এই কথাটা বলে তাদের রাজনীতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা আছে বলে মনে হয়। নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিরাজনৈতিকীকরণ হয় বলে একটা স্লোগান ব্যবহার করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে।’ এখন সংসদ সদস্যদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ী। এটা তো নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি। দলভিত্তিক মনোনয়নের মাধ্যমে হয়েছে। দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে এবারের পৌর নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী। খোদ দলগুলোই যদি অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের এনে মনোনয়ন দেয়, তাহলে আর কী করার আছে!

কালের কণ্ঠ : স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না থাকলেও কিন্তু দলীয় সমর্থনে নির্বাচন হতো…

বদিউল আলম মজুমদার : রাজনৈতিক দলগুলো বিধিবিধান, নিয়মকানুন মানে না। এর মানে কি সব আইনকানুন আমরা ডাস্টবিনে ফেলে দেব? অবশ্যই না। দলীয় নির্বাচনের যদি যৌক্তিকতা থাকে, তাহলে হতেই পারে। কিন্তু আমি কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। বরং এর মাধ্যমে যেটা ঘটতে পারে তা হলো, দলবাজি, ক্ষমতার প্রভুত্ব বিস্তার, মনোনয়ন বাণিজ্য, পেশিশক্তির দৌরাত্ম-এগুলো ব্যাপক আকার ধারণ করবে। ২০১০ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে লিখিত এক চিঠিতে বলেন, দলীয় ক্যাডাররাই যদি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে, তাহলে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা কী? সুতরাং দলভিত্তিক হলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। এর জন্য যার যার দায়িত্ব তাদের নিজেদের পালন করতে হবে। পরিস্থিতি এমনটা ঘটার কারণ আমরা দলবাজিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছি যে দলের নামে খুনোখুনি করি। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছিলেন, বাঙালি দলাদলিই করতে পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না। দল মানে যারা জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। যারা মারামারি, খুনোখুনি করবে না। যারা আইন মেনে চলবে। তাদের মূল শক্তি হবে জনগণ। দলগুলোর মনোনয়ন-বাণিজ্য দূর করতে হবে।

কালের কণ্ঠ : আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : পৃথিবীর নানা দেশে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতে হচ্ছে। সেখানে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তো কারচুপি করার প্রয়োজনই আসে না। তারা সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচন কমিশনকে সেই অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমাদের যদি এটা করতেই হয়, সরকার যদি এর যৌক্তিকতা দেখে, করতেই পারে। কিন্তু এ জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। দলগুলোকে সংস্কার করা দরকার। এ জন্য একটা ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনার জন্য একটা সংলাপ হওয়া দরকার। সংলাপের ভিত্তিতে যদি আমাদের দলগুলো সংস্কৃতির পরিবর্তন করে, তাহলে করতে পারে। আর যেটা আমার কাছে ভয়ানক মনে হয় তা হলো, এর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম হবে। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে একদলীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।

কালের কণ্ঠ : স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বেসিক ডেমোক্র্যাট পদ্ধতিতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার মত কী?

বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ, সংসদীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারের যে কাঠামোর প্রস্তাব এসেছে তার সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই। এভাবে হলে তো দলভিত্তিকই হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দলীয় ভিত্তিতে মেয়র, চেয়ারম্যান ইত্যাদি সবাই নির্বাচিত হবেন। কিন্তু আমাদের পাকিস্তান আমলের যে অভিজ্ঞতা সকালে এক প্রধানমন্ত্রী আর বিকেলে আরেক প্রধানমন্ত্রী। দলীয় সংস্কৃতি যদি পরিবর্তিত না হয়, তাহলে এটাও পরিবর্তন হবে না। আমাদের চর্চার মধ্যে পরিবর্তন আনা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা। দেখা যাবে এখানে হয়তো একজন আরেকজনকে কিনে নিয়ে আসবে। টাকা দিয়ে কিনে এনে অনাস্থা দেবে। তখন আবার আইনে নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হবে-‘এক দল থেকে আরেক দলে যাওয়া যাবে না।’ যেটা আমি বলার চেষ্টা করছি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে। আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করার মানসিকতা রাখতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। এটা দিয়েই গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু। এগুলো করার জন্য আমাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। দলভিত্তিক নির্বাচনের জন্য যথার্থ দল থাকতে হবে। এখন রাজনীতি ও ব্যবসা এক হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মতো আয়োজন করে। কারণ কিছু ব্যবসায়িক ব্যক্তি রাজনীতি করতে আসে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে। এই পরির্তনগুলো না করে যদি যেসব দেশে এসব সমস্যা বিরাজ করে না তাদের যখন অনুসরণ করতে যাই, তখন তো সমস্যা হবেই। আমাদের কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনা করা দরকার। এ জন্য সবাই বসে আলাপ-আলোচনা করা দরকার।

কালের কণ্ঠ : সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নানাভাবে হয়রানি, মামলা-হামলা ইত্যাদি করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবারও যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

বদিউল আলম মজুমদার : আমারও ভয়টা এখানে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু একদলীয় ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হবে। বিরোধী দল মামলা-হামলার কারণে কিন্তু মাঠে নেই। গত সিটি করপোরেশনে তো একটা বড় অংশের লোক ভোট দিতে পারেনি। বিরোধী দলের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থে কথাগুলো বলছি। বর্তমানে আমাদের রাজনীতির যে বেসামাল অবস্থা, তা শুধু বিরোধী দল না থাকার কারণে। তাই আমি মনে করি, এটা একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত। আর একটা তো বড় বিষয় রয়েছেই যে তাদের সব ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ। এমন অনাকাক্সিক্ষত নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা হলে, ভালো মানুষ নির্বাচনে আসবে না। স্থানীয় নির্বাচনে অনেক সময় ভালো মানুষদের জনগণ দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি হয়তো সবার জন্য কাজ করেন কিন্তু কোনো দলে যেতে চান না। জনগণ নিজেরা অর্থ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। এখন এটার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা যে কথা বলি, এর মাধ্যমে তা ব্যাহত হবে। যেদিকে তাকাব দেখব নব্য ধনীরা, পেশিশক্তির মালিকরা ক্রমান্বয়ে ক্ষমতায় চলে আসছে। এটা অশনিসংকেত। সামনে হয়তো আরো খারাপ হবে।

কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য দলগুলো কিভাবে অগ্রসর হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : এটা ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব। তাদের সবাইকে ডাকতে হবে। এখন সংসদে একটি বিরোধী দল আছে, তারা সরকারি না বিরোধী ঠিক বোঝা যায় না। এটা আমাদের সংস্কৃতি যে বিরোধী দলে গেলে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলে। কিন্তু সরকারি দলে গেলে তারা সেটা ভুলে যায়। তখন তারা বিশেষ ক্ষমতা আইন করে, নতুন নতুন নীতি করে। এটা এখানকার চিত্র।

কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

বদিউল আলম মজুমদার : সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা। নির্বাচন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়, তাহলে তারা অনেক কিছু করতে পারে। তবু তাদের পক্ষেও পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ থাকে। পক্ষপাতদুষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই যে অবস্থা হলো। চাইলে কিন্তু নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বাতিল করতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। তবুও চাইলেই তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। দলতন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমান যে সিইসি, তিনিও সম্মানিত লোক। সম্মানের সঙ্গেই তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলে যেকোনো সময় নির্বাচন সম্ভব। তারা ফলাফল বাতিল করতে পারে।

কালের কণ্ঠ : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

বদিউল আলম মজুমদার : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় বিএনপির নির্বাচন বিরোধী প্রচারপত্র বিলি

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আওয়ামীলীগের একতরফা নির্বাচন বন্ধের দাবী ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে না ...