ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - স্বাধীনতা যুদ্ধ : যেভাবে শুরু ও বিজয়

স্বাধীনতা যুদ্ধ : যেভাবে শুরু ও বিজয়

নূর হোসাইন মোল্লা >

(পর্ব – ৭)
১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনী গভর্নর হাউজে বোমা বর্ষণ করলে গভর্নর ডাঃ এ,এম,মালিক এবং তাঁর মন্ত্রীসভা পাকিস্তানের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে নিরপেক্ষ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে আশ্রয় গ্রহন করেন। জেনারেল নিয়াজি আলোচনার জন্যে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ডেকে পাঠান। দু’জনে আলোচনা করে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার জন্যে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল এম,পিভ্যাককে অনুরোধ করেন। মিঃ পিভ্যাক জেনারেল নিয়াজিকে বলেন যে, আমি মধ্যস্থতা করতে পারি না, তবে আপনাদের বার্তাটি যথাস্থানে পৌছিয়ে দিতে পারি। মি. পিভ্যাক অফিসে বসেই ভারতের সেনা বাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ এর নিকট বিশেষ বার্তা লেখেন। এতে বলা হয়ঃ- (১) পাকিস্তান সেনা বাহিনী এবং সহযোগী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা (২) মুক্তি বাহিনীর হামলার মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা এবং (৩) আহত ও রুগ্ন সৈন্যদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির জন্যে আমরা রাজী আছি। এ বার্তাটি মি. পিভ্যাক সরাসরি জেনারেল মানেকশ এর কাছে কিংবা দিল্লীতে না পাঠিয়ে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে প্রেরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করার পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়। ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল মানেকশ বেতার মারফত জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পনের আহবান জানিয়ে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। আহবানের শেষে বলা হয় যে, এর পরও যদি আমার আহবান মোতাবেক আপনি পুরো বাহিনীসহ আত্মসমর্পন না করেন তাহলে পুর্ণোদ্যোমে আঘাত হানার জন্যে আমি ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর নির্দেশ দিতে বাধ্য হব। ঢাকা শহর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদ অতি দ্রুত সৈন্য সংগ্রহ করে মিরপুর ব্রিজ পাহারা দেয়ার জন্যে মেজর সালামত আলীকে নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ারও নির্দেশ দেন। মেজর সালামত আলী তাঁর সৈন্য নিয়ে পজিশন নেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই শিখ মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নগরা তাঁর অগ্রবর্তী কমান্ড বাহিনী নিয়ে মিরপুর ব্রিজের অপর পাড়ে পৌছেন। সাথে ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর বাহিনীর কিছু সদস্য। ১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় জেনারেল নাগরা জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসর্মপনের আহবান জানিয়ে চিঠি পাঠান। উল্লেখ্য, মেজর জেনারেল নাগরা এবং জেনারেল নিয়াজি কলেজ জীবনে বন্ধু ছিলেন। চিঠিতে জেনারেল নাগরা লেখেনঃ
প্রিয় আব্দুল্লাহ,
আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। ঘটনার পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। পরামর্শ হচ্ছে তোমরা আমার কাছে আত্মসমর্পন কর। সেক্ষেত্রে আমরা তোমাদের দেখাশুনার দায়িত্ব গ্রহন করব। শিঘ্রই তোমার প্রতিনিধি পাঠাও। ইতি তোমার নাগরা, সকাল ৮.৩০ মিনিট, তারিখ-১৬/১২/৭১। জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পনের ইচ্ছা ব্যক্ত করার পর জেনারেল নাগরা যৌথ বাহিনীসহ সকাল ১০.৪০ মিনিটে ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন। পাকিস্তান বাহিনীর ঢাকার জি,ও,সি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানান। আত্মসমর্পনের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্যে ভারতের ইস্টার্ণ কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে,এফ,আর জ্যাকোপ দুপুরে ঢাকায় আসেন। বিকেল ৪টার আগেই ভারতের ইস্টার্ণ কমান্ডোর প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিগন ঢাকায় অবতারণ করেন। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সাথে প্রায় ৯ মাস ব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪.৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে লক্ষাধিক লোকের উপাস্থিতিতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি বাংলাদেশে অবস্থিত সকল পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে (৯১,৪৯৮ জন অফিসার ও সৈন্যসহ) বিনা শর্তে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পন দলিলে স্বাক্ষর করায় পরিসমাপ্তি ঘটে মানব ইতিহাসের এক করুণতম এবং বেদনাদায়ক ঘটনা। আমরা অর্জন করি এক মহিমান্বিত ও গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। আত্মসমর্পনের পূর্বে যে দলিলটি তৈরী করা হয় তাতে লেখা হলোঃ “পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বাহিনী ভারতের পূর্ব রণাঙ্গণে ভারত ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট বাংলাদেশে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্যই আত্মসমর্পনে স্বীকৃত হয়েছে। এ আত্মসমর্পন পাকিস্তানের সকল সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনীর এবং আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সশস্ত্র বাহিনীর যারা যেখানে আছেন, সেখানকার নিকটস্থ লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃতাধীন নিয়মিত সেনা বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন ও সকল অস্ত্র সমর্পন করবে।” কিন্তু দলিলে অন্তর্ভূক্ত বাংলাদেশ শব্দটিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয় এবং বাংলাদেশ শব্দটি বাতিল করার দাবী জানান। কারণ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করা তাঁদের আত্মসম্মানে বাঁধে। এরপর জেনারেল নিয়াজি দলিলটি এক নজরে দেখে কোন মন্তব্য না করে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর হাতে দেন। ফরমান আলী বলেন,এটি মেনে নিবেন,না প্রত্যাখান করবেন তা আমাদের অধিনায়ক বলতে পারবেন। জেনারেল নিয়াজি মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারা দিলেন। সবাই বুঝতে পারলেন যে, নিয়াজি আত্মসমর্পন দলিলে স্বাক্ষর করিতে রাজি আছেন। নিয়াজির আত্মসমর্পনের পর সন্ধ্যায় দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, ঢাকা এখন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গণে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন।
চলবে……
লেখকঃ (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক)

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...