ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - দলিতরাও মুক্তিযোদ্ধা : কেউ তাঁদের মনে রাখেনি

দলিতরাও মুক্তিযোদ্ধা : কেউ তাঁদের মনে রাখেনি

২২ নভেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকার মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে ১০ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। যাঁদের অনেকেরই লাশও আজ অবধি পাওয়া যায়নি…
রঞ্জন বক্সী নুপু >
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন করতে সর্বস্তরের মানুষের যে সহায়তা ছিল দেশের দলিতরাও এর বাইরে নয়। আর এ কারণে মহাণ মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র ঢাকাতেই তাদেরও অন্ততঃ ১০ জন শহীদ হয়েছেন। এতসবের পরেও এই দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা পায়নি শহীদের মর্যাদা। কোন শহীদ পরিবারের জন্য বরাদ্দ হয়নি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কিংবা অন্য কোন ধরনের ভাতা। তারা এই বিষয়টির জন্য বহু দেন দরবার করেও কোন ফল আনতে পারেনি। অথচঃ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলিত সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার কোন স্বীকৃতি যেমন রাষ্ট্র দেয়নি তেমনি সামাজিক ভাবেও পায়নি এই জনগোষ্ঠি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ঢাকার আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লা সিটি কলোনীর দলিত (হরিজন) সম্প্রদায়ের অনেকেই। ২২ নভেম্বর ১৯৭১ এ একই দিনে শহীদ হয়েছেন তাদের হিসাবানুযায়ী ১০ জন। ওই কলোনীর শহীদ ১০ জন হলেন, মাহাবীর লাল সামুন্দ, আনোয়ার লাল, নান্দু লাল, ঈশ্বর লাল, ঘাসিটা লাল, খালবাল, রামচরণ, নান্দা লাল, লাল্লু হেলা ও শংকর হেলা। শুধু এরাই নয় রাজধানীর ওয়ারী সিটি কলোনীর একজন এবং নগর বেলতলী চৌধুরী বাজার এলাকার রমেশ দাসও শহীদের তালিকায় নাম লেখান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দলিত সম্প্রদায়ের যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলেন তাদের নামটিও শহীদের তালিকায় ওঠেনি। অথচঃ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের অনগ্রসর অংশ সমুহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।’ বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই।
রাজধানীর আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লা সিটি কলোনী। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় ১০ জনকে ২২ নভেম্বর বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। সেই যাওয়াই তাদের শেষ যাওয়া। পরবর্তীতে আর তাদের লাশও পাওয়া যায় নি। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন শহীদ রামচরণ দাসের বিধবা স্ত্রী রানী দাস (৭৯)। এখন বয়সের ভারে নুব্জ। কেউ বাসায় গেলেই তার মধ্যে আতঙ্ক। কেন আবার কে এসেছে কোন অজুহাতে। দীর্ঘ ৪৫ বছর তাকে তাড়া করে ফিরেছে এই যন্ত্রনা। রানী দাসের স্বামী ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের চাকরী করতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশ মাতৃকার টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ৮ মাস যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে ২০ নভেম্বর আসেন স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ের সাথে দেখা করতে। কে জানতো এই আসাই তার জীবনের শেষ আসা। তাইতো যা ঘটবার তাই ঘটে গেল। ২২ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় অন্য ৯ জনের সাথে তাকেও মিরনজিল্লা সিটি কলোনীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি রামচরণ দাস। এই সুদির্ঘ সময়ে রানী দাস তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার সংসার চলে মেয়ের উপর নির্ভর করে। তার স্বামীই নয়, বাবা লালু দাসও শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধে। এত কিছুর পরেও তাকে থাকতে হচ্ছে পরের মুখাপেক্ষি হয়ে। এই যন্ত্রনা সারাক্ষণ তাকে তাড়া করে ফেরে।
একই কথা বললেন শহীদ খালবাল দাসের পুত্র জীবন দাস। তার পিতা পিডব্লিউডিতে চাকরী করতেন। ওই ভয়াল রাতে পাক হানাদার বাহিনী তার পিতাকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি তিনি। জীবন দাসের অভিযোগ সরকারী কোন সহানুভূতি কখনও না পাওয়ায় তারা আর কোন সরকারের কাছেই যাবেন না। তিনি তার পৈত্রিক চাকরীর জন্য অনেক দেন দরবার করেও কোন ফল বয়ে আনতে পারেন নি। শহীদ ঘাসিটা দাসের পুত্র নুরেশ দাস। অনেকটা ক্ষোভের সাথেই বললেন, দেশ স্বাধীন করে কি হয়েছে? তার শহীদ পিতার মর্যাদা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেই। তাদের সংসার এখন চলে না চলার মত। কিন্তু কোন সরকারী উদ্যোগ নেই। এমন অনেক কথাই বলেছেন সেখানকার শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাদের ক্ষোভ শহীদের তালিকায় তাদের পিতার নামটি অন্তর্ভূক্ত করতে যদি কোন বাধা থাকে, তাহলে এদেশে তাদের নাগরিকত্ব কোথায়? এ ব্যাপারে কথা হয়, বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও মিরনজিল্লার নাগরিক শ্রী কৃষ্ণালালের সাথে। তারও চোখে মুখে ক্ষোভের আগুন। বললেন অনেকবার বিভিন্ন সরকারের কাছে, সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের কাছে অনেক ধরনা দিয়েও এই মহল্লার শহীদদের নাম তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অথচঃ আমরা এদেশের ভোটার, বৈধ নাগরিক। ভোট এলেই অনেকের মতো আমাদের কাছে ধরনা দিতে থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। নানা ধরনের আশ্বাস দিতে থাকে। ভোট চলে গেলে আর তাদের কোন হদিস পাওয়া যায় না। ওই কলোনীরই মহেশ লাল রাজু বললেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিবার কিছুই পায়না। তাদের রাজনৈতিক অধিকার যেমন নেই, তেমন শহীদ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ারও অধিকার নেই। ১৯৭২ সালে এখানে নির্মান করা হয় একটি শহীদ মিনার। প্রতি বছর ২২ নভেম্বর তারা দিবসটি পালন করেন শহীদ দিবস হিসেবে। সম্পুর্ন নিজেদের অর্থায়নে এই শহীদ বেদীতে তারা ২২ নভেম্বর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
রাজধানীর লালবাগ এলাকার নগরবেলতলীর চৌধুরী বাজারে বসবাস করতেন রমেশ দাস। চিত্র পরিচালক দারাশিকোর সাথে চিত্র জগতে কাজ করতেন তিনি। একই কলোনীর নরেশ ও পরেশ ছিলেন তার সহযোগী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশ মাতৃকার টানে রমেশ যুদ্ধে যান। মাত্র ৪ মাসের মাথায় পাক হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরে হাতির ঘাট নামক এলাকায়। সেখানে তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে রমেশ দাসকে হত্যা করা হয়। শহীদের খাতায় নাম লেখান তিনি। কথাগুলো বললেন, বাংলাদেশ দলিত পঞ্চায়েত ফোরামের সভাপতি রামানন্দ দাস। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি আরও জানালেন, এই শহীদের নাম কোন তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি। বিভিন্ন সময় সরকার পরিবর্তন হলেই শহীদের খাতাও পরিবর্তন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রমেশ দাসের নাম শহীদের তালিকায় আনা সম্ভব হয় নাই। তিনি জানালেন, ১৯৭২ সাল থেকে রমেশ এর মৃত্যু দিনটি বিভিন্ন ভাবে পালিত হলেও ৭৫ এর পট পরিবর্তনের পরে আর এ দিনটি উদযাপিত হয় না। সকলে যেন ভুলেই গেছে রমেশ নামের এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন আমাদের মহাণ মুক্তিযুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পরেও আমাদেরকে লিখতে হচ্ছে শহীদের খাতায় যাদের নাম ওঠেনি তাদের সম্পর্কে। সমাজে এবং বাস্তব জীবনে প্রতিদিন যাদের প্রয়োজন তারা থাকছে অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও তারা পাচ্ছেনা শহীদের সম্মান। দলিত সম্প্রদায়ের শহীদদের অনতিবিলম্বে শহীদের মর্যাদা দেয়ার দাবী সমাজের সকল উন্নয়নকর্মীর।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...