খাইরুল ইসলাম বাকু >
(A+B)2= A2+2AB+B2 বীজগনিতের এই সহজ সূত্রটি গিলতে আমাকে যে মুল্য দিতে হয়েছে তা কখনই ভুলবার নয়, আমি তখন সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র, ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার ভালো ছাত্র বড়ভাই সেদিনই বাড়িতে আসে, সন্ধায় আমার পড়ালেখার খোজ খবর নিতে গিয়ে অঙ্ক বিষয়ে আমার অগাধ জ্ঞান (!!!)এর সন্ধান পেয়ে তার তো চক্ষু চরকগাছ, বীজগনিতের একটি সুত্র ও আমার জানা নাই, জান পরান দিয়ে ঘন্টা খানেক চেষ্টার পরেও প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে (উল্লেখিত সূত্রটি বাদে একটি সুত্র ও ভালো করে গিলতে পারি নাই) স্কুলের বিখ্যাত ব্যাত জাতীয় লাঠির আশ্রয় নেন, অসতর্ক শাসনের একপর্যায়ে লাঠির সামনের দিকের কোনো অংশ লেগে চোখ ও গালের মাঝামাঝি অংশে ক্ষতর সৃষ্টি ও রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়, হাসপাতাল থেকে দুটো সেলাই দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি আমার মনে তখন প্রগার প্রশান্তি, অন্তত আগামী দুএক মাসে বাসায় কেউ আমাকে দুর্বোধ্য বীজগণিত শিখাতে আসবে না, এতদিন পরে আমার ছোটবেলার অংক শেখার গল্প মনে হলো প্রথমআলো পত্রিকার সাম্প্রতিক একটি খবর দেখে.. “সাম্প্রতিক প্রকাশিত SSC এর ফলাফল প্রকাশের পর অংক বিষয়ে অকৃতকার্য এক ছেলে আত্মহত্যা করে”, ছেলেটির অপরিণত আবেগ থেকে নেয়া সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল কিন্তু কি এমন পরিস্থিতি তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে সহাযতা করেছে তা আমার মত অঙ্কে আজীবন ফেলটুস (ও মাঝে মাঝে টেনে টুনে পাস) করাদের জন্য সহজে বোধগম্য, ষষ্ঠ শ্রেনীর ভর্তি পরীক্ষায় আমার সিরিয়াল যখন ৩৬ হলো পরিচিত এক শিক্ষকের সে কি ভত্সনা “তোমার অগ্রজদের সবার ক্লাস এ ১ বা ২ রোল তোমার ফলাফল এর এমন শ্রী কেন” (আমরা সব ভাইবোন একই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম) পরিবার, সমাজ আমাদের পরাজয়কে অভিনন্দন বা গ্রহণ করতে শিখায় না, সকল ক্ষেত্রে কেবল বিজয়ীর সাধুবাদ, পরাজিতের সান্তনা বা নতুন উদ্যমে শুরু করার প্রেরণা যোগানোর সময় যেন কারো নেই সকলকে কেবল জিততে হবে, ক্লাস্সের এক, দুই, তিন বা প্রথম সারির (পরীক্ষার উত্তরপত্রে প্রকাশিত মেধা ভিত্তিক) ছেলেমেয়েদের প্রতি শিক্ষকদের যে বাড়তি আগ্রহ, আদরের অসম প্রকাশ পায় তা পিছিয়ে থাকা বা সমান মেধার একইভাবে বিকশিত না হওয়া ছেলে বা মেয়েটির মনে সকলের অগোচরেই যে হৃনাত্মক দাগ কেটে যায় তা বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের সকল আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে দেয়, পরিবারেও অধিকংশ পিতামাতার আগ্রহ কেবল বলিউডের “তারে জামিন পার” সিনেমার যুহানের মত কোনো চরিত্রকে ঘিরে, ইসানের কেউ খবর রাখে না… J.S.C, S.S.C বা H.S. C পরীক্ষায় ভালো ফল করা তেমন কাউকে এখনো বলতে শুনিনি বড় হয়ে “আমি চিত্রশিল্পী হতে চাই” “সিনেমার ডিরেক্টর হতে চাই” “উদ্যোক্তা হতে চাই” “সাংবাদিক হতে চাই” “সাহিত্যিক হতে চাই” সবার কেবল একই চাওয়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট সবার চাওয়াতে এই অদ্ভুত মিলটা একারণেই যে পিতামাতারা সন্তানকে তার স্বপ্নটা নিজেদের চোখ দিয়ে দেখায়, অধিকংশ পিতামাতা তাদের নিজেদের জীবনের অপূরণীয় স্বপ্ন পূরণের বোঝাটা সন্তানের মাথায় তুলে দেয়… সবাইকে কেবল বড় হতে হবে, ধনী হতে হবে, টাকা তৈরির মেশিন হতে পারাটাই যেন জীবনের চরম সার্থকতা… মনুষত্বে, জ্ঞানে বড় হওয়া, বা সত্যিকারের মানুষ্ হওয়া টা যেন বড় মুল্য হীন…. সমাজ, পরিবারের সকল মূল্যায়ন কেবল সংকীর্ণ সফলতাকে ঘিরে..
লেখক : মঠবাড়িয়া প্রবাসি, দক্ষিণ সুদানে একটি মানবিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ।