ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - সোনালী দিনের স্বপ্ন

সোনালী দিনের স্বপ্ন

সাইফুল বাতেন টিটো >

২০০৪ সালে আমি যখন যুদ্ধ বিদ্যায় পড়তে যাই তখন একবার আমার গ্রামের বাড়ি ফুলঝুড়ী তে গিয়েছিলাম বড় ছোট সবার সাথে দেখা করতে। আমার যেমন সরকারের উঁচু স্তরের কর্তা কিংবা বড় কোম্পানির মালিক বন্ধু রয়েছে তেমনি রিক্সা ওয়ালা, কুলি, মেথরও আমার জানের দোস্ত আছে। আমার এক রিক্সা ওয়ালা বন্ধু রয়েছে যাকে ছাড়া আমি আর্মিতে যাওয়ার আগে মনেহয় কিছুই করতাম না। এখনও বাড়িতে গেলে ও আর ওর বউ দুজন দুই পাশে বসে আমি রাগ করে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত খাওয়াবে। তো আজ যার কথা বলছি ও আমার প্রাইমারী থেকে বন্ধু। আমি নাম বলতে চাই না। তো আমি মঠবাড়িয়া থেকে ফুলঝুড়ী যাচ্ছিলাম ওর রিকশায়। দুজনেই গল্পে মসগুল। ওর ছেলে মেয়ে কয়টা কি ইত্যাদি। একসময় ও আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি এখন কিছু করি কি না, না এখনও পড়াশুনা করছি। আমি বললাম
-দোস্ত আমি তো আর্মিতে চাকরি পাইছি। জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ট্রেনিং শুরু।
-আ, কও কি? তুই এতো সকালে চাকরীতে গেলি ক্যান? বছর দুই আগে তুই মোডে আইএ পাস করলি।
-দোস্ত আর্মির চাকরীতে গেলে আইএ পাস করেই যেতে হয়।
-তোর বাপে জানে?
-হুম, জানে তো।
-তোরে মারে নাই? ইস স্যারের কত ইচ্ছা ছিলো তোরে ডাক্তার বানাবে……… তুই আর্মির চাকরীতে যাইস না, আবার পড়াশুনা শুরু কর। ডাক্তারি ভর্তি হ দোস্ত।
বলে ও রিক্সা থামাল। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরল। আমি কি করব বা কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি স্বাভাবিক ভাবে ওকে বললাম
-দ্যাখ দোস্ত সেটা তো আর সম্ভব না, ডাক্তারি পড়তে হলে সর্ব প্রথম কথা হল মেট্রিকে আর আইএ তে সাইন্স নিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমি তো আর্টস -এ পরেছি। আমি ডাক্তারি পড়তে পারব না।
জবাবে ও বলল
-হ বালের আলাপ করো, টাকা পয়সা দিলে আইজ কাইল কি না হয়? লাখ খানিক মাইর‍্যা দে ব্যাডা। দেখ আব্বা আব্বা কইরা তোরে ডাক্তারি পড়তে নেবে।
আমি এ কথার কি জবাব দেব বুঝে উঠতে পারলাম না। ও বিড়ি ধরাতে ধরাতে আবার বলল
-কিন্তু তা তো দিবি না তোর বাপে হইল মাস্টের মানুষ। আর যাই হউক ঘুষ হে দেবে না।
তার পড় কেটে গেছে অনেক গুলো বছর। এক যুগ। আমি ওর কথা মতো আর্টস পড়ে লাখ খানিক মেরে দিয়ে ডাক্তারি না পড়ে আর্মি তে গিয়ে ছিলাম।
সেখানকার চাকরি বছর চারেক পড় ছেড়ে দিয়ে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। অর্থাৎ ২০০৭ এর শেষের দিকে অনিমেষ দা’র সাথে কাজ শুরু করে মিডিয়ার ২য় জীবন শুরু করলাম। ২০১২ সালের দিকে মাথায় ভূত চাপল বাণিজ্যিক ভাবে ইউটিউব চ্যানেল করব। সবাই বলল ভাতে মরবি কাপড়ে মরবি। আমিও দেখলাম তাই। কয়জন দেখে ইউটিউব? হিসেব করে দেখলাম তাতে ভাত কাপড় মাথা গোঁজার ঠাই মিলবে না। তবে স্বপ্নটা মুছে ফেললাম না। জিইয়ে রাখলাম। তত দিনে ইন্টারনেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ ইউটিউবে গড় গড় করে সিনেমা দেখছে নাটক দেখছে, অনেকেই ব্যাবসা করছে কনটেন্ট বানিয়ে। আমার স্বপ্নটা আবার তাজা হতে শুরু করল। একটু বলে নেই ২০১২ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম আমাকে ডেকে আমাকে দিয়ে গোটা কয়েক নাটক বানিয়েছিলো। আমি সেখান থেকে একটি নাটক আমার স্বপ্নের দূরপাল্লায় আপলোড করি।
যাই হোক এ বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আমি আমার স্যারের সততা ও আদর্শে আগে থেকেই মুগ্ধ ছিলাম। একজন এসোসিয়েট প্রফেসর একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন এই বিষয়টি আমি খুব পজিটিভলি নিয়ে আমি স্যারের নির্বাচনে কাজ করতে আমার গ্রাম ফুলঝুড়ী তে গেলাম। আমার সেই প্রাইমারী স্কুলের রিক্সা ওয়ালা বন্ধু যে কিনা আমাকে ডাক্তারি পড়তে বলেছিল সেও আমার মতো স্যারের একজন কর্মী। আমরা দিনরাত একসাথেই থাকতাম। ও ছাড়া আমার আরো অনেক প্রাইমারী হাইস্কুলের বন্ধুরা মিলে আমরা একত্রে থাকতাম। যাই হোক একদিন রাত আটটার সময় আমরা আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পাশে কাটা ধানের শুকনা মাঠে বসে মার্চের বাতাস খাচ্ছিলাম। তখন আমার অন্য এক বন্ধু বলল
-দোস্ত তুই এখন কি করস?
-দোস্ত আমি একটা টিভি চ্যানেলে চাকরি করি।
-কি কাজ করস?
-আমি ওখানকার নাটকের আর্ট ডিরেক্টর।
-তোর কাম কি? পরিচালনা করা?
ওরা আর্ট ডিরেক্টরের কাজ কতটা বোঝে না বোঝে এই ভেবে বললাম
-দোস্ত, মনেকর সহকারী পরিচালক আরকি। পরিচালকের হেল্পার ও বলতে পারস।
-তুই নিজে কিছু নাটক সিনামা পরিচালনা করস নাই?
-হুম করছি কয়েকটা।
-আ কও কি? আমাগো দেহাবি না?
-দোস্ত এবার তো আমি ল্যাপটপ আনিনাই পরেরবার যখন আসব তখন ল্যাপটপ নিয়ে আসব, তখন সবাইকে দেখাব।
তখন আমার সেই রিক্সা ওয়ালা বন্ধুটি যে কিনা একযুগ আগে আমাকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ডাক্তারি পড়তে বলেছিল সে বলল
– হইছে হইছে ঢাকা গেলে আর তোর দেখা পাওয়া যাবে না। তোর নাটকের নাম কি? ইউটিউবে আপ দেওনাই?
আমি থ হয়ে গেলাম। বলেকি ছেলে? আমি চরম বিস্ময়ে বললাম
– হ্যাঁ দিয়েছি দোস্ত।
-কি নামে ক
আমি নাটকের নাম বললাম। ও ১০ সেকেন্ডের মধ্যে নাটক চালান শুরু করল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর মোবাইলের উপর।
আমার বুকের মধ্যে রক্ত ছলাত করে উঠল। আমাদের গ্রামে কারেন্ট নাই এখনও। আমার বন্ধু টি ক্লাস থ্রি’র পড় অর্থনৈতিক কারণে আর পড়তে পারেন। পেশায় রিক্সা চালক। সে এখন আমাদের শুকনা ধান খেতে কাটা খ্যার পিঠের নিচে দিয়ে চিত হয়ে বিড়ি টানছে আর আমার নির্মিত নাটক দেখছে নিজে সার্চ করে।আমরা সেই একযুগ আগে কি এমন কথা স্বপ্নেও ভেবে ছিলাম? কোথাকার প্রযুক্তি কোথায় গেছে?
তার মানে সামনে আমার জন্য অতি সোনালি সুদিন অপেক্ষায় আছে। শুধু আমার জন্য না, এদেশের সকল তরুনের প্রযুক্তি নির্ভর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই।
কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যও টাকা লাগে।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...