রঞ্জন বকসী নুপু >
১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্বের মানচিত্রে লেখা হয় বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূ-খন্ডের নাম। তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী পায় লাল সবুজের একটি পতাকা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, আদিবাসী, হরিজন সহ সর্বস্তরের মানুষের মনে একই চেতনা ছিল; আর তা হলো একটি স্বাধীন দেশ। ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে সকল ধর্ম, গোত্রের মানুষই ছিল। ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরাও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ স্বপ্ন স্বজাতির কাছে মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার স্বপ্ন। ৫টি মৌলিক অধিকারকে আঁকড়ে ধরে সকল মানুষের সাথে একত্রে বসবাসের স্বপ্ন দেখেছিল এদেশের অন্ত্যজ জনগোষ্ঠি। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। এই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে এদেশের অন্তজ্য জনগোষ্ঠির একটি অংশ হরিজন সম্প্রদায়। স্বাধীন দেশের জনসাধারণ হয়েও তারা এখন পরাধীনতার শৃঙ্খলেই আবদ্ধ। সমাজের আর ৫ জনের সাথে মিশতে পারে না। এক স্রোতধারায় তাদের বাস নেই। তাদের জন্য আলাদা বাসস্থান। তাও আবার খুবই খুপড়ি। হরিজনদের হোটেলে বসিয়ে এখনও খাওয়াতে চায় না হোটেল কর্তৃপক্ষ। স্কুলে এখনও হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা পড়ালেখা করতে যেতে পারে না। অচ্ছ্যুত হিসেবে তাদেরকে বিবেচিত করা হয়। কোথাও কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অংশ নিতে পারে না। পারে না নির্বাচনে অংশ নিতে। সামাজিক ব্যাধি তাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অথচঃ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই হরিজন যুব সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অথচঃ তার কোন স্বীকৃতিও এই সমাজে এবং রাষ্ট্রে আজ অবধি মেলেনি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ঢাকার আগা সাদেক রোডের মিরন জিল্লা সিটি কলোনীর হরিজন সম্প্রদায়ের লোকরা। তারা দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যুদ্ধ করেছেন আর দশ জনের মতো। শহীদ হয়েছেন তাদের হিসাবানুযায়ী ১০ জন। ওই কলোনীর শহীদ ১০ জন হলেন, মাহাবীর সামুন্দ, আনবার লাল, ইন্দু লাল, ঈশ্বর লাল, ঘাসিটা, খালবাল, রামচরণ, নান্দা লাল, লাল্লু হেলা ও শংকর হেলা। এ ছাড়াও রাজধানীর ওয়ারী সিটি কলোনীর একজনও শহীদের তালিকায় নাম লেখান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, হরিজন সম্প্রদায়ের যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলেন, তাদের নামটিও শহীদের তালিকায় ওঠে নি।
হরিজনরা এই দেশেরই মানুষ। তারাও এই দেশের অন্য সকলের মত বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের অনগ্রসর অংশ সমুহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।’ বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই।
হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা এদেশেরই সন্তান। মাটির সাথে লড়াই করে তারা জীবন-যাপন করে। তারা নারী-পুরুষ উভয়েই উপার্জন করে সংসার চালায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করলেও তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পায় না। তাদের নানাভাবে ঠকানো হয়। এ ছাড়াও হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা সামান্য লেখাপড়া করে জানে বা শিক্ষিত তারা বিভিন্ন অফিস-আদালতে বা বেসরকারী সংস্থায় চাকরী করলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে সামাজিক ও মানসিক ভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর একটাই কারণ, আর তা হলো; হরিজন বলে তাদেরকে নিচু জাত মনে করা।
১৮৫৩ সালে গ্রেট-ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানী কর্তৃক ভারতে প্রথম রেল ব্যবস্থা চালু করার পরে ব্রিটিশ প্রশাশন বিহার, পাটনা, মনিহারী, ভাগলপুর, এলাহাবাদ, ছাপড়া সহ বিভিন্ন স্থানে ওই এলাকার চন্ডাল বংশদ্ভুতদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দিয়ে চাকরী দেয়। তাদের একমাত্র কাজ ছিল রেল স্টেশনের এবং অফিসগুলোর পয়োঃ নিস্কাশন ও পরিচ্ছন্ন করা। পরবর্তীতে তারা ওই এলাকায় তাদের কাজের পাশাপাশি এই উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা বাংলাদেশে অবস্থান নেয়। যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের সেই অস্পৃশ্য লোকগুলো গান্ধির দেয়া হরিজন নাম পরিগ্রহ করে আজও মনুষ্য মর্যাদা পায়নি।
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের জন্য গৃহিত বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য একটি তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। The Indigenous People Thirst Solidarity COMDECA-১৯৯৫’ এর প্রকাশিত ওই তালিকায় ৫৮টি সম্প্রদায়কে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও হরিজনদের ওই তালিকায় রাখা হয়নি। জাতিসংঘ Indigenous People এর ব্যাখ্যায় বলেছে চার বৈশিষ্ট যাদের রয়েছে তারাই হবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি। এই চার বৈশিষ্ট হলো; যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিসমুহ একটি রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে সেখনে বাস করছে, যারা রাষ্ট্রে প্রান্তিকতার শিকার, যাদের উপর অন্যায় আধিপত্য বিস্তার করা হয়েছে অর্থাৎ যারা Non-Dominent এবং যারা নিজেদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি হিসেবে দাবী করে। হরিজনরা এই বৈশিষ্টের আওতায় হলেও কোন অজ্ঞাত কারণে তাদেরকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির আওতায় নেয়া হয়নি। ঢাকার গণকটুলী সিটি কলোনীর হরিজন সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ভোটার তালিকায় তাদের নাম লিখিয়েছে। জাতীয় পরিচয় পত্রও পেয়েছে। বিগত বছরও তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। অথচঃ তারা প্রার্থী হতে পারছে না, শুধুমাত্র সামাজিক বৈষম্যেও কারনে।
হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা সামাজিক এই নিপীড়নের কারণে কোথাও উঁচু মাথা নিয়ে দাঁড়াতে উৎসাহ বোধ করে না। ফলে নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত কোথাও তাদের কোন প্রতিনিধি থাকছে না। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। “সংবিধানের ১৯ এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে। আবার ওই একই ধারায় ২ উপধারায় বলা হয়েছে, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যক্রর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের বেলায় এর কোনটাই কাজে আসছে না। কোথাও সমতা সৃষ্টি হয়নি তাদের সাথে। তারা পারেনি মূল স্রোত ধারায় মিশতে। যে কারণে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজকে নিয়োজিত করতে তারা কোনভাবেই পারছে না।
সমাজের সামাজিক অবস্থা এবং অবস্থান পরিবর্তন করতে হলে হরিজন সম্প্রদায়কে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিষয়টি সমাজ থেকে উপরে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রের পরিচালন প্রক্রিয়া সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নামে যে ধারাটি আছে তা বাদ দিতে হবে। জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই এদেশের মানুষ বিবেচনায় নিয়ে হরিজনদেরকেও আর ৫জনের মতো সমাজে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সর্বত্র তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন পাস করতে হবে, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি নামে কোন জনগোষ্ঠি না রেখে সকলকে একই জনগোষ্ঠির আওতায় আনতে হবে। তাহলেই হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে উৎসাহ বোধ করবে। #
> লেখক: সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শারি’র প্রকল্প সমন্বয়কারী