ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - টাঙ্গুয়ার হাওরে একদিন

টাঙ্গুয়ার হাওরে একদিন

মোঃ রাজিউল ইসলাম রাজিব >

টাঙ্গুয়ার হাওরের কাচ স্বচ্ছ জলে উড়াল বায়ু বয়। উপরে সুনীল আকাশ, স্ফটিক স্বচ্ছ জলের তলায় ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের খেলা আর হাজারো পরিযায়ী পাখির কলকাকলীতে মুখর যেন এক স্বপ্নীল জগৎ। জলের তলায় মাছ ও জলজ উদ্ভিদগুলো এতো স্বচ্ছভাবে ধরা পরে যা সত্যিই অভাবনীয়। সাঁঝ বিকেলে ডুবন্ত সূর্যের সোনারঙ্গে রঙ্গিন হাওরের জল। সূর্যের আলোতে হাওরের জল চিকচিক করছে। হাওরের ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়াবিনী মেঘালয়, যার আঁচলে সদা খেলা করে রূপের রাগিণীরা। চোখে দেখে বাস্তব বলে বিশ্বাস হয় না, মনে হয় বিশাল কোন ক্যনভাসে আঁকা কোন ছবি। নিশি রাতে কাচ টলটলে জলের বুকে চাঁদের ছায়া। পানির এমন অপরুপ রূপ চোখকে দ্বিধান্বিত করে, মনকে উদাসী করে। সারিবদ্ধ হিজল করচের গাছ, জলকেলিতে মত্ত নানা রকম পাখিরা। মেঘালয়ের কোল ঘেসে প্রকৃতির এমন অপরুপ রুপ যেনো অন্যরকম এক মায়াপুরী।DSC_0815

যার কথা বলছিলাম সেটা হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। বিশাল এই জলাভূমিতে প্রকৃতি বেড়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। আর তার যে সৌন্দর্য, চোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮ মৌজায়, ৫১টি জলমহালের সমন্বয়ে নয় হাজার ৭২৭ হেক্টর অঞ্চল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর গড়ে উঠেছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর।DSC_0418

ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিশেছে হাওরের পানিতে। সারিসারি হিজল-করচশোভিত, পাখিদের কলকাকলি সদা মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম শুধু সুনামগঞ্জ বা বাংলাদেশে নয়, বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওরকে বলা হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল। সুন্দরবনকে ধরা হয় প্রথম। (ইরানের রামসার অঞ্চলে প্রথম জলাভূমি শনাক্ত করার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখান থেকেই এই নামটি এসেছে।)

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারিসারি হিজলগাছ। দেখে মনে হবে এই গাছগুলো হাওরে আগত অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। মূল হাওরে প্রবেশ করলে হাওরের পানিতে নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলবে হরেক রকম লতাপাতা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। দেখে মনে হবে পানির নিচে অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে আরো পাবেন করচ, বরুন, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসি, নলখাগড়া, বল্লুয়া ও চাল্লিয়া জাতের উদ্ভিদ।DSC_0641

এই হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। এখানে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। এ ছাড়া ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, বেশ কয়েক প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির কিছু উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বসবাস এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর। আমাদের দেশীয় পাখিগুলো সারা বছরই খুনসুটি, জলকেলি আর খাবারের খোঁজে এক বিল থেকে আরেক বিলে ওড়াউড়ি করে মাতিয়ে রাখে এই হাওরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। আর শীত এলে আমাদের দেশি পাখির সাথে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। এতে হাওরের শোভা বেড়ে যায় কয়েকশ গুণ। প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শুরুতেই সুদূর সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসে অতিথি পাখি। শীতের তীব্রতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নানা প্রজাতির এসব অতিথি পাখি আসে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায়। সেখানে তারা গড়ে তোলে ক্ষণস্থায়ী আবাস। তার মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর অন্যতম। পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল, পাতিকুটসহ নানা প্রজাতির পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, যা আমাদের দেশে কুড়া ঈগল নামে পরিচিত, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। পাখি বিশেষজ্ঞরা টাঙ্গুয়ার হাওরে বিরল কিছু পাখির সন্ধান পেয়েছেন কয়েক বছর আগেই। এসব বিরল পাখির মধ্যে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (লাল ঝুটি), পিন টেনল (ল্যাঞ্জা হাঁস), সভেলার (খুন্তে হাঁস), মালার্ড (নীলমাথা হাঁস), গাডওয়াল (পিয়াং হাঁস), ঠাফটেউ (টিকিহাঁস), কঁনপিগমি (ধলা বালিহাঁস), বেগুনি কালেম, পান মুরগি, সরালি, রাজসরালি, পাতিমাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ও চখাচখি উল্লেখযোগ্য।DSC_0338

টাঙ্গুয়ার হাওর হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি মিঠাপানির মাদার ফিশারিজ। স্থানীয়ভাবে ছয়কুড়ি কান্দা আর নয় কুড়ি বিল নামে পরিচিত এই বিশাল জলাভূমি শুধু পাখি নয়, মাছের জন্যও বিখ্যাত। একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ ছিল। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটি প্রজাতি পাওয়া যেত এই হাওরে। এ ছাড়া রয়েছে গাং বাইম, কালবাউশ, তারা বাইম, বাইম, গুতুম, গুলশা, টেংরা, তিতনা, গইন্না, রুই, কাতল, চিতল, বোয়ালসহ আরো নানা প্রজাতির দেশি মাছ। টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি করা। টাঙ্গুয়ার হাওরে মা মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়বে আর বর্ষাকালে এই মাছগুলো ছড়িয়ে পড়বে দেশের অন্যান্য নদীনালা ও খালবিলে। সেজন্য টাঙ্গুয়ার হাওরের ইজারা প্রথা বিলোপ করে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়।DSC_0939

R-60th বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে মাঠ সংযুক্তিতে আমরা এসেছি সুনামগঞ্জে। আজ ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজকে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাবার ইচ্ছা ছিলোনা। আগেরদিন ভেবেছিলাম সকালে ঘুম থেকে উঠে টেকেরহাট ঘুরতে যাবো। কিন্তু যেখানে ভাগ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর ছিলো সেখানে আমার কি করার আছে। দুপুর বারোটা নাগাদ আমাদের ৮ জনের ছোট্ট দলটা সুরমা ব্রিজের কাছ থেকে মোটরসাইকেল করে রওনা দিলাম সুলেমানপুরের উদ্যেশ্যে। ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ টাকা। যাওয়ার পথে পলাশ আর তাহিরপুরে বিরতি ধরে লাগে ২ ঘন্টা। সুলেমানপুরে পৌঁছলে সামস শামিম ভাইয়ের (সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি, কালের কন্ঠ) পরিচিত মাঝি খায়ের ভাইকে বলতেই পল্টু মাঝিকে ঠিক করে দিলো আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওর ঘোরানোর জন্য। স্যালো ইঞ্জিন নৌকায় করে দলের ৮ জনকে নিয়ে শুরু হল দেশের ২য় রামসার জলাধার “টাঙ্গুয়ার হাওর” এর উদ্দেশে যাত্রা।DSC_0852

আহ চারদিকে পানি, তার বুক চিরে চলেছে আমাদের জলযান। সারি সারি হিজল, করচের গাছগুলো হাওরে প্রবেশের শুরুতেই আমাদের স্বাগত জানায়। হাওরের মধ্যে কদাচ বড় বড় গাছের শাখা-প্রশাখা দন্ডায়মান। হাওরের যৌবনের কাছে তারা পরাজিত। পথে দেখা মেলে হাজারো পরিযায়ী পাখি, বক, পানকৌড়ি আরও নাম না জানা অচেনা পাখি। নিজের ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় বারবার মনে পড়ছিল আমার ফটোগ্রাফিক দীক্ষাগুরু দেবদাস মজুমদার (আঞ্চলিক প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ, পিরোজপুর) দাদার কথা।DSC_0661

সঙ্গী মতিনের আবার জলের তলের হাজারো মাছের সাথে খেলা করার শখ জাগে তাইতো সে শুভ্রর দেয়া তোয়ালে পরে ঝাপিয়ে পড়ে হাওরের কালো স্বচ্ছ জলে আর আমি শুভ্র জসিম ভাই, মুসা ভাই, তপু ভাই রুপস ভাই আর ডা: আতিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।DSC_0828

একটা বিশেষ ব্যাপার খেয়ালে আসে যে হাওরের বুকে এক ফোঁটাও ঢেউ নেই যেনো প্রকৃতি এখানে এসে থমকে গেছে। হাতছোঁওয়া ব্যাবধানে অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয় পাহাড়। এমন প্রকৃতির রূপ দেখেইতো প্রেমরসে সিক্ত বাঊল শাহ আবদুল করিমের অনন্য অমর সৃষ্টি গানগুলো। মন উচ্ছ্বসিত হচ্ছিলো মেঘালয় পাহাড়ের রূপ দেখে। মেঘের মিতালীতে স্নাত মেঘালয়য়ের পাদদেশ ঘেঁষে টাঙ্গুয়ার হাওরের শেষাংশের স্বচ্ছ নীল জলরাশি, সাথে সূর্যাস্তের কাঁচাসোনা রোদ। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ, তার মাঝে মেঘেদের দল বেঁধে ছুটে চলা। পুরোটা পথ হাসি-গল্প-আড্ডায় কাটিয়ে গোধূলিলগ্নে যখন সুলেমানপুরে সবাই নামলাম, তখন সবার মুখে পরম পরিতৃপ্তির ছায়া।DSC_0347

শুভসঙ্গীঃ আব্দুল মতিন, শুভ্র সরকার, তপু ভাই, জসিম ভাই, ড. আতিক, রুপস ভাই এবং মুসা ভাই।
কৃতজ্ঞতায়ঃ দেবদাস মজুমদার (আঞ্চলিক প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ, পিরোজপুর) এবং সামস শামিম (সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কন্ঠ)DSC_0435

টাঙ্গুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ।
১৫/০১/২০১৬

ছবি > লেখক
———————–

লেখক পরিচিতি > উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, বামনা, বরগুনা

 

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...